অপরাধ দমন এবং প্রকৃত অপরাধী শনাক্তে ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে আঙুলের ছাপ বা বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সব মোবাইলের সিম রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা চালু করে সরকার। একটি জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) বিপরীতে সর্বোচ্চ ১৫টি সিম রাখার বিষয় চূড়ান্ত করা হয় তখন। তবে সাত বছর আগে চালু করা এই সুরক্ষিত পদ্ধতির সুফল কতটা মিলেছে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম বিক্রি করা হলেও একজনের এনআইডি বা বায়োমেট্রিকে মোবাইল সিম বিক্রি করা হচ্ছে অন্যদের কাছে। সিম পাওয়া যাচ্ছে রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে অনলাইনেও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন দিয়ে একাধিক চক্র ভিআইপি ও সাধারণ সিম বিক্রি করছে উচ্চমূল্যে। এসব সিম দিয়ে কেউ অপরাধ করলে ফেঁসে যাবেন অন্য ব্যক্তি।
এমন জালিয়াতি বন্ধে দীর্ঘদিন ধরে তাগাদা দিয়ে আসছেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা। যদিও মোবাইল ফোন অপারেটরদের দাবি, যথাযথ প্রক্রিয়া মেনেই সিম সরবরাহ করেন তারা। কুমিল্লার সাফিকুন নেসা (ছদ্মনাম) নামের ৬৫ বছরের একজন বৃদ্ধার জাতীয় পরিচয়পত্র ও হাতের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যবহার করে ১০টির বেশি সিম অ্যাকটিভ করে নেন এক দোকানদার। এরপর প্রতিটি সিম ১ হাজার ২০০ টাকা করে বিক্রি করেন একটি ডাকাত দলের কাছে। এসব সিম দিয়ে যোগাযোগের মাধ্যমে ডাকাতি শুরু করে সেই ডাকাতদল। দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে সংঘবদ্ধ এ ডাকাত দলের পাঁচজনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা (ডিবি) গুলশান বিভাগ।
নরসিংদীর বাসিন্দা জাকির হোসেন (ছদ্মনাম)। মেরামতের জন্য সিমসহ একটি মোবাইল রেখে আসেন সার্ভিসিংয়ের দোকানে। এরপর দোকানদার তাকে জানান মোবাইলটি মেরামতযোগ্য নয়। এ তথ্য জানার পর অল্প দামি মোবাইলটি জাকির আর ফেরত নেন না। সেখানেই ঘটে বিপত্তি। দোকান থেকে তারেক সরকার (৩৫) নামের এক প্রতারক মোবাইল কিনতে গিয়ে জাকিরের নামে রেজিস্ট্রেশনকৃত রবি অপারেটরের সিমটি নিয়ে আসেন। সেই সিম দিয়ে তারেক আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের পরিচয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবকে মোবাইল ফোনে চাকরির সুপারিশ করতে গিয়ে ধরা পড়েন ডিবির জালে। এরপর উন্মোচিত হয় জাকিরের সিমের রহস্য। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ, কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) একের পর এক অভিযানে বেরিয়ে আসে অসংখ্য গ্রাহকের এনআইডি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট ব্যবহার করে নিবন্ধিত সিম দিয়ে প্রতারণার বিষয়টি।
আমরা আধুনিক বা উন্নত সমাজের দিকে যাচ্ছি, কিন্তু সংস্কৃতিক জায়গায় আমাদের পরিবর্তন হয়নি। কোনো কাজে প্রফেশনালিজম বা ইনস্টিটিউশনালাইজেশন কোনোভাবেই আমাদের উন্নতি হচ্ছে না।
এমন জালিয়াতি বন্ধে দীর্ঘদিন ধরে তাগাদা দিয়ে আসছেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা। যদিও মোবাইল ফোন অপারেটরদের দাবি, যথাযথ প্রক্রিয়া মেনেই সিম সরবরাহ করেন তারা। জানা যায়, ২০১৬ সালের ৩ এপ্রিল রাতে বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার জুয়ানপুর গ্রামে জঙ্গিদের ভাড়া করা একটি বাড়িতে বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণে দুজন নিহত হন। এদের মধ্যে একজন ছিলেন জেএমবির চট্টগ্রাম অঞ্চলের সামরিক শাখার প্রধান রাইসুল ইসলাম খান ওরফে ফারদিন। তার ব্যবহার করা সব সিম ছিল অন্যজনের নামে নিবন্ধিত।
২০১৬ সালের ৭ মার্চ গভীর রাতে রাজধানীর খিলগাঁওয়ে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন জেএমবি কমান্ডার পিয়াস। তার ব্যবহৃত সিমটি নিবন্ধিত ছিল চট্টগ্রামের রাউজানের মামুনের নামে। ২০১৭ সালের ৭ মে সাভারের আশুলিয়া এলাকা থেকে গ্রেফতার জঙ্গি মো. ইমরান হোসেন ওরফে এমরানের ব্যবহৃত সিমটি নিবন্ধিত ছিল রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার আবদুর রবের নামে। এছাড়া রশিদ খান ও মিজানুর রহমানের নামে নিবন্ধিত একাধিক সিমও ব্যবহার করেন তিনি। ২০১৭ সালের ১ মে রাজধানীর ভাটারা থানার নর্দা এলাকা থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের ‘তথ্য-প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান’ আশফাক উর রহমান অয়নকে গ্রেফতার করা হয়। তার ব্যবহৃত সিমগুলো নিবন্ধিত ছিল রবিউল ও আবদুল্লাহর নামে।
২০১৫ সালের ৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামি থানার বক্সনগর হক টাওয়ারের দ্বিতীয় তলা থেকে জেএমবি সদস্য মো. সুজন ওরফে বাবুকে গ্রেফতার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। বায়েজিদ বোস্তামি থানার বাংলাবাজার এলাকার ল্যাংটা মামা ও তার খাদেম আবদুল কাদেরকে গলা কেটে হত্যা করে বাবুসহ কয়েকজন জঙ্গি সদস্য। বাবু জঙ্গি কর্মকা-ে যে সিমটি ব্যবহার করেছিলেন, তা নিবন্ধিত ছিল ঝিনাইদহের বাবর আলীর নামে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, এনআইডি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট ছাড়াও কয়েকটি চক্র ভুয়া এনআইডি দিয়ে সিম বিক্রি করছে। আমরা খবর পেয়েছি, এসব সিম উচ্চমূল্যে বাজারে কিনতেও পাওয়া যায়। এছাড়া একজনের এনআইডি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে তার অজান্তেই একাধিক সিম রেজিস্ট্রেশন করা হচ্ছে। সেগুলো আবার উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে অপরাধীদের কাছে। এসব সিম দিয়ে অপরাধীরা জড়াচ্ছেন ভয়ঙ্কর সব অপরাধে। অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সিম ব্যবহার করে অপরাধ করলেও তাদের ধরতে বেগ পেতে হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। অভিযানে সিমের সূত্র ধরে নিরপরাধ ব্যক্তিকে পাওয়া গেলেও অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার চেষ্টা করে। রাস্তায় সিম বিক্রিতে বিটিআরসির নির্দেশনা মেনে চলছে কি না জানতে চাইলে মোবাইল অপারেটর রবির জনসংযোগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মারুফ হোসেন বলেন, সিম বিক্রি একটি স্বয়ংক্রিয় বায়োমেট্রিক প্রক্রিয়া। রবি সর্বদা বিটিআরসির নির্দেশনা মেনে সিম বিক্রি করে থাকে। বিটিআরসির নির্দেশনা অনুযায়ী উচ্চমূল্যে সিম বিক্রির কোনো সুযোগ নেই। এ ধরনের কার্যক্রম রবির নজরে আসামাত্রই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হিসেবে সিমগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং পরে অনুসন্ধান সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট রিটেইলারের বিরুদ্ধে কারণ দর্শাও, জরিমানাসহ চুক্তি বাতিল করা হয়। সিম বিক্রি স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া হওয়ায় গ্রাহকের বায়োমেট্রিক যাচাই ছাড়া সিম সচল করা সম্ভব নয়।
গ্রামীণফোনের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মোহাম্মদ হাসান বলেন, বিটিআরসির নির্দেশিত গাইডলাইন অনুসারে যথাযথ নিয়ম মেনে গ্রামীণফোন গ্রাহকদের কাছে মোবাইল সিম বিক্রি করে থাকে।
ডিএমপির গোয়েন্দা ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) জুনায়েদ আলম সরকার বলেন, সিম কিনতে আসা লোকদের কাছ থেকে কিছু অসাধু দোকানদার অতিরিক্ত লাভের আশায় কৌশলে একাধিকবার ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে নেয়। এমন করে দুই থেকে তিনবার ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে সিমগুলো প্রতারকের কাছে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে। মোবাইল অপারেটরগুলো এক্ষত্রে তাদের নজরদারি বাড়ালে এমন কাজ ঘটবে না।
জানতে চাইলে গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান বলেন, আমাদের প্রায় প্রতিটি অভিযানেই দেখা যায়, যে নম্বরটির সূত্র ধরে অভিযান পরিচালনা করা হয় সেই নম্বরটি অপরাধীর নয়। অর্থাৎ অপরাধী তার নাম-পরিচয় ব্যবহার করে সিমটি কেনেনি। সম্প্রতি একটি ডাকাতির ঘটনা উদ্ঘাটন করতে গিয়ে দেখা যায়, ডাকাত দলের কাছ থেকে ৮ থেকে ১০টি ইনট্যাক্ট (নতুন) সিম পাওয়া গেছে। যেগুলো তাদের নামে নয়। এসব সিম তারা কুমিল্লা থেকে কিনে আনে। কুমিল্লার একজন দোকানদার এক বৃদ্ধার জাতীয় পরিচয়পত্র ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে সিমগুলো অ্যাক্টিভেট করে তার কাছে রেখে দেয়। পরে প্রতিটি সিম ১ হাজার ২০০ টাকা করে ডাকাতদলের কাছে বিক্রি করে দেয়।
তিনি বলেন, যারা সাধারণ মানুষের এনআইডি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে সিম রেজিস্ট্রেশন করে অপরাধীদের কাছে বিক্রি করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সম্প্রতি বেশকিছু অভিযানে দেখা গেছে, আসামিরা যে সিমগুলো ব্যবহার করে সেগুলো তাদের নাম, এনআইডি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে নিবন্ধিত নয়। র্যাবের কাছে একটি প্রযুক্তি রয়েছে ‘অনসাইট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ওআইভিএস)’, যা দিয়ে অপরাধীর ফিঙ্গার প্রিন্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, জন্মতারিখ বা নাম সার্চ করে, এমনকি ডিভাইসের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলেও জানা যাবে তার আসল পরিচয়সহ অন্যান্য তথ্য। সুতরাং অপরাধীরা তাদের এনআইডি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে সিম না ব্যবহার করলেও পালিয়ে থাকার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, অন্যের সিম ব্যবহার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য উদ্বেগের বিষয়। কারণ অপরাধীরা যখন তাদের নামে রেজিস্ট্রেশন করবে না তখন তারা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হবেই। যারা এ ধরনের সিম কেনাবেচা ও এর সঙ্গে জড়িত তাদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাস্তায় রাস্তায় সিম বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বলেন, বিটিআরসি থেকে নির্দেশনা দেওয়া আছে তারা কাস্টমার কেয়ারের মাধ্যমে সিম বিক্রি করবে। রাস্তায় রস্তায় সিম বিক্রি করা উচিত নয়। বিটিআরসির নির্দেশনা মেনে সিম বিক্রি না করা অন্যায় এবং এটি ভায়োলেশন বলা যেতে পারে। মোবাইল অপারেটরগুলোর যারা সিম বিক্রি করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদেরও এক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। এক্ষেত্রে মোবাইল অপারেটরগুলোর দুর্বলতা থাকতে পারে। তাদের সতর্ক হতে হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক (ডিজি) এ কে এম হুমায়ুন কবীর বলেন, সিম কিনে যদি অপরাধীরা অপরাধ করে এবং পরবর্তীকালে তাদের এনআইডি দিয়ে শনাক্ত না করা যায়, তাহলে এর দায়ভার জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধনের নয়, দায়ভার বিটিআরসির।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, আমাদের ট্র্যাডিশনাল সমাজের যে বৈশিষ্ট্য তা এখনো ইনট্যাক্ট আছে। আমরা আধুনিক বা উন্নত সমাজের দিকে যাচ্ছি, কিন্তু সংস্কৃতিক জায়গায় আমাদের পরিবর্তন হয়নি। কোনো কাজে প্রফেশনালিজম বা ইনস্টিটিউশনালাইজেশন এগুলো কোনোভাবেই আমাদের উন্নতি হচ্ছে না। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি কোনোভাবেই আমাদের সমাজ থেকে উঠে যায়নি। এর ফলে একদিকে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি আছে, অন্যদিকে এর বাইরেও বিভিন্ন ফাঁক-ফোকর দিয়ে সিম তোলার ব্যবস্থা করছে। একজনের বায়োমেট্রিক বা আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে তোলা সিম অন্যজন ব্যবহার করছে, সেটাও দেখা যাচ্ছে। এছাড়া ব্যবসায়িক চক্রও এর সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। আবার হতে পারে যিনি অপরাধ করছেন, তিনি পরে তা অস্বীকার করছেন। আমাদের মনিটরিং ও রেগুলেশনের দুর্দান্ত অভাব।- জাগো নিউজ