৯ জিলহজ ইয়াওমে আরাফা বা হাজীদের আরাফার ময়দানে অবস্থানের দিন। এই দিনকেই হজের দিন বলা হয়। এ বছর ৮ জুলাই শুক্রবার ইয়াওমে আরাফা। এ দিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মুসলমানরা আরাফাতের ময়দানে সমবেত হন। এ দিনের ফজিলত ও তাৎপর্য অপরিসীম। এ দিনকে মুসলমানদের জন্য ঈদের দিন, আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত এবং গুনাহ থেকে পরিত্রাণের দিন হিসেবে ঘোষণ দেয়া হয়েছে। আরাফা দিবসের পরিচয় : আরাফা শব্দের অর্থ হলো- পরিচিতি, হজরত দ্বাহহাক রহ: বলেন, হজরত আদম আ:-কে হিন্দুস্তানে ও হাওয়া আ:-কে জেদ্দায় বেহেশত থেকে অবতরণ করা হয়েছিল। অবতরণের পর তারা পরস্পর পরস্পরকে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে একদিন উভয়ে আরাফাতের ময়দানে আরাফার দিনে মিলিত হলেন এবং একে অপরের মধ্যে পরিচয় ঘটল। এ কারণে ওই স্থানের নাম হলো আরাফাত, আর ওই দিনের নাম হলো আরাফার দিন।
আরাফা দিবসের ফজিলত : আরাফার দিনের ফজিলত সম্পর্কে বুখারি শরিফে বর্ণিত আছে, ইহুদিরা হজরত ওমর রা:-কে বলল, আপনারা এমন একটি আয়াত পড়ে থাকেন তা যদি আমাদের ওপর নাজিল হতো, তবে আমরা সেটিকে ঈদ হিসেবে উদযাপন করে দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতাম। হজরত ওমর রা: বললেন, এটি কখন ও কোথায় অবতীর্ণ হয়েছে আর নাজিলের সময় রাসূলুল্লাহ সা: কোথায় ছিলেন তা আমি জানি। আল্লাহর শপথ! আমরা সবাই এ সময় আরাফাতে ছিলাম। এ দিন আমাদের জন্য দু’টি ঈদ ছিল, প্রথমত সে দিন ছিল জুমাবার যাকে আমরা ঈদ হিসেবে উদযাপন করি, দ্বিতীয়ত- সে দিন ছিল ইয়াওমে আরাফা, যাকে হাদিসে ঈদের দিন হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে (বুখারি-৪২৫১)।
জুমার দিন ও আরাফার দিন ঈদের দিন : জুমার দিন ও আরাফার দিন ঈদের দিন। কেননা, হাদিসের মধ্যে এ দুই দিনকে ঈদের দিন হিসেবে উল্লেøখ করা হয়েছে। হজরত ওমর রা: সূত্রে বর্ণিত- তিনি বলেন, এ আয়াত আরাফাতের ময়দানে জুমার দিন নাজিল হয়েছিল। আল্লাহর শোকর যে, এ উভয় দিন (জুমা ও আরাফা) আমাদের জন্য ঈদের দিন। যতক্ষণ পর্যন্ত একজন মুসলমানও পৃথিবীতে থাকবে ততদিন এ দু’টি দিন মুসলমানের জন্য ঈদের দিন হিসেবে গণ্য থাকবে। একটি হলো জুমার দিন, আরেকটি হলো ইয়াওমে আরাফা তথা আরাফার দিন (আবু দাউদ-২৪১৯)।
আরাফা দিবসে দ্বীন পূর্ণতার ঘোষণা : আরাফার দিনে আরাফাতের ময়দানে নবীজী ও সাহাবায়ে কেরাম যখন উকুফে আরাফা করছিলেন তখনই আল্লাহ তায়ালা নবীজী সা:-এর ওপর কুরআনুল কারিমের সর্বশেষ আয়াত নাজিল করে দ্বীনকে পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। আর সেটি হলো সূরা মায়েদার ৩ নং আয়াত। এই আয়াত নাজিল করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের ওপর আমার নিয়ামতকে পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য চূড়ান্ত দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।’ এ আয়াত নাজিলের পর নবীজী সা: মাত্র ৮১ দিন পৃথিবীতে জীবিত ছিলেন (আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া : ২/২৪২)।
আরাফার দিন সর্বোত্তম দিন : হজরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা: সূত্রে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘আরাফা দিবসের চেয়ে উত্তম কোনো দিন নেই। এই দিনে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীবাসীকে নিয়ে গর্ব করে বলেন, তোমরা আমার ওইসব বান্দাদেরকে দেখো, যারা বিক্ষিপ্ত ও এলোমেলো চুল নিয়ে অনেক দূর-দূরান্ত থেকে আমার রহমতের আশায় ও শাস্তির ভয়ে আমার কাছে এসেছে। সুতরাং আরাফা দিবসের চেয়ে বেশি দোজখ থেকে মুক্তির আর কোনো দিন নেই। এই দিনে যে পরিমাণ লোক দোজখ থেকে পরিত্রাণ লাভ করবে অন্য কোনো দিন করবে না (সহিহ ইবনে হিব্বান-৩৮৫৩)।
আরাফা দিবস গুনাহ মাফের দিন : হজরত নাফে রা: হজরত ইবনে ওমর রা: থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা আরাফার দিন স্বীয় বান্দার প্রতি দৃষ্টিপাত করেন। যার অন্তরে বিন্দুমাত্র ঈমান থাকবে তাকে অবশ্যই ক্ষমা করে দেয়া হবে।’ হজরত নাফে রা: বলেন, আমি ইবনে ওমর রা:-কে জিজ্ঞেস করলাম, এই ক্ষমা কি সব ঈমানদারের জন্য নাকি শুধু আরাফাবাসীর জন্য খাস? উত্তরে তিনি বলেন, ‘এই ক্ষমা সব ঈমানদারের জন্য’ (ইবনে রজব হাম্বলি রহ:, লাতায়েফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা-৪৭১)।
আরাফার দিন জাহান্নামীদের মুক্তির দিন : আরাফার দিনে অসংখ্য মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হয়। হজরত আয়েশা রা: সূত্রে বর্ণিত- নবীজী সা: ইরশাদ করেন, ‘আরাফা দিবসের চেয়ে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের জন্য অন্য কোনো দিন নেই’ (সহিহ ইবনে খুজাইমা-৪/৪৪২)।
সহিহ মুসলিম শরিফে আবু কাতাদা রা: সূত্রে বর্ণিত- নবীজী সা: ইরশাদ করেন, ‘আরাফা দিবসে রোজা রাখলে আশা করি আল্লাহ তায়ালা রোজাদারের এক বছরের আগের ও এক বছরের পরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন’ (মুসলিম-১১৬২)।
তবে হজরত আবু হুরায়রা রা: সূত্রে বর্ণিত- নবীজী সা: আরাফা দিবসে হাজীদের আরাফাতের ময়দানে সমবেত হওয়ার দিন রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন (হুলিয়াতুল আউলিয়া : ৩/৩৯৭)। অনেকেই হাজী সাহেবানদের জন্য এই দিনে রোজা রাখা মাকরূহ বলেছেন। কারণ এই দিন তাদের অধিকারে জিকির, দোয়া ও মুনাজাতে লিপ্ত থাকতে হয় এবং অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। রোজার কারণে যাতে তারা দুর্বল হয়ে না যায় সে কারণে হাজীদের সে দিন রোজা রাখা থেকে বিরত থাকার জন্য বলেছেন। তবে যারা সামর্থ্যবান তথা রোজার কারণে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকবে না, তাদের জন্য রোজা রাখাই উত্তম।
আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা হাজীদের জন্য ফরজ। আরাফাতের ময়দানে হাজীগণ হাজির হয়ে আল্লাহর রহমত তালাশ করেন। সমবেত সবাই ইবাদত-বন্দেগি ও গুনাহ মাফের জন্য কান্নাকাটি করে আল্লাহর জিকির, দোয়া, মুনাজাতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে থাকেন। আর আল্লাহ তায়ালাও বান্দাদের ইবাদত-বন্দেগি ও কান্নাকাটির বিনিময়ে তাদের ক্ষমা ও জান্নাত লাভের ঘোষণা দেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে জীবনে অন্তত একবার হলেও আরাফাতের ময়দানে হাজির হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের তৌফিক দান করুন, আমীন। লেখক : সহকারী মাওলানা, চরণদ্বীপ রজভিয়া ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসা, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম