প্রকৃতিতে এখন ভরা বর্ষাকাল চললেও নীল আকাশে শরত ও হেমন্তকালের মতো বিক্ষিত মেঘের আনাগোনা এবং তীব্র খড়া। আষাঢ় গেল। চলছে শ্রাবণ মাস। কিন্তু বইছে না শ্রাবণের ধারা। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য উত্তরাঞ্চলে হুমকির মুখে পড়েছে আউশ ও রোপা আমন ধানের চাষাবাদ। এ সময়ের মধ্যে সিংহভাগ জমিতে আমনের চারা রোপণ হওয়ার কথা। কিন্তু বৃষ্টির পানির অভাবে অধিকাংশ জমিতে চারা লাগানো যাচ্ছে না। প্রকৃতির এমন বিরুপ আচরণে চাষিদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। কখনো টিপটিপ, কখনো একপশলা বৃষ্টি হলেও বর্ষানির্ভর আউশ-আমন চাষের জন্য তা যথেষ্ট নয়। রোদের তীব্রতার চেয়ে বাড়তি সেচ খরচের ধকলে পুড়ছেন এ অঞ্চলের কৃষকরা। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বর্ষাকালে যে পুঞ্জিভূত মেঘ বাংলাদেশে অবস্থান করার কথা সেটা এখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আছে। এজন্য বর্ষাকালেও মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে না। গত এক দশক ধরেই আবহাওয়ায় এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে ঋতু পরিক্রমায় এই পরিবর্তন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, এখনই উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। সামনে ভারী বর্ষনের সম্ভাবনা রয়েছে। ভাদ্র মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চারা রোপণ করা যাবে। চাষিদের সম্পূরক সেচ দিয়ে চাষাবাদ করার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর তথ্যমতে, বরেন্দ্র অঞ্চলে গড় বৃষ্টিপাত প্রায় এক হাজার ১০০ মিলিমিটার। ১০ বছর আগে রাজশাহীতে বছরে গড় বৃষ্টি হতো এক হাজার ৫০০ মিলিমিটার। রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, গত বছর আষাঢ় মাসে রাজশাহীতে বৃষ্টি হয়েছিল ২৫ দিন। আর এ বছর আষাঢ়ে বৃষ্টি হয়েছে মাত্র আটদিন। গত বছর ৩৫৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও এবার তা হয়েছে মাত্র ৩৯ দশমিক দুই মিলিমিটার। বৃষ্টিপাত কমেছে প্রায় ৮৯ শতাংশ। তবে এবার যে বৃষ্টি হয়েছে সেটাও বিক্ষিপ্তভাবে কিছু সময়ের জন্য। তাপমাত্রা ছিল গড়ে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রংপুর আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, জুলাই মাসে সাধারণত বৃষ্টিপাত হয় ৪৫৩ মিলিমিটার। কিন্তু গেল ২০ দিনে রংপুর বিভাগে বৃষ্টি হয়েছে মাত্র ১৯ দশমিক ৪ মিলিমিটার। তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ২৮ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। ২০২০ সালে জুলাইয়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৮০৪ মিলিমিটার। ২০২১ সালে বৃষ্টি হয়েছিল ১৯৬ মিলিমিটার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে যে তাপদাহের বিপর্যয়, তা শুধু বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিক সংকট। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষ রোপন করতে হবে। ফলদ ও ফুলের পাশাপাশি পশু-পাখির উপযোগী বৃক্ষরোপন অপরিহার্য। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে ২০২২-২০২৩ খরিপ-২ মৌসুমে ১০ লাখ ১৯ হাজার ৪৬৬ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত উত্তরের ১৬ জেলার চারটি কৃষি জোনে লক্ষ্যমাত্রার শতকরা প্রায় ৯ ভাগ জমিতে চারা রোপণ সম্পন্ন হয়েছে বলে একাধিক বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। সেটিও করতে হয়েছে সম্পূরক সেচ দিয়ে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর-বিবিএস আউশ ফসলের প্রাক্কলিত হিসাব শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছর দেশে আউশের আবাদ হয়েছে ১১ লাখ ৫৯ হাজার ৮০ হেক্টর জমিতে। বরেন্দ্র অঞ্চলের নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার উত্তরগ্রাম গ্রামের কৃষক রেজাউল ইসলাম বলেন, আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বৃষ্টি নেই। কৃষকেরা এটা ভাবতেই পারছে না। এ রকম বৈরী আবহাওয়া আগে কখনই দেখেননি। একই কথা বলেন আরও ২০-২৫ জন কৃষক। সাপাহার উপজেলার গোয়ালভিটা গ্রামের কৃষক ইব্রাহিম হোসেন বলেন, ‘অনাবৃষ্টির কারণে গভীর নলকূপের পানি দিয়ে আমনের জমি রোপণ করতে গিয়ে শ্রমিক খরচ, হালচাষ ও সার-কীটনাশক দিয়ে বিঘাপ্রতি প্রায় ৪ হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে। যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে বোরোর আবাদ করতে যে ৯-১০ হাজার টাকার মতো খরচ হতো আমনেও তেমন খরচ হবে। দিনাজপুরের হিলির ছাতনি গ্রামের কৃষক আনসার আলী জানান, বৃষ্টি না থাকায় আমন লাগাতে পারেননি। বেশ কিছুদিন ধরে হিলিতে বৃষ্টির দেখা নেই। পাবনার ঈশ্বরদীর সাঁড়া গোপালপুরের কৃষক মোতাহার বলেন, তিনি ৯ বিঘা জমিতে এবার আমন ধান চাষের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। বৃষ্টি না হওয়ায় এখনো চারা রোপণে জমি প্রস্তুত করতে পারেননি। পরিমাণ মতো বৃষ্টি না হলে অনেক কৃষক আমন ধান লাগাতে পারবে না। এদিকে বৃষ্টির অভাবে কৃষকরা আউশ খেতে সেচ দেওয়া নিয়ে পড়েছেন চরম বিপাকে। এবার উত্তরের চাষিরা ধান উৎপাদন ব্যহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন বলে বিভিন্ন বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। আবহাওয়ার এমন পরিবর্তন উত্তরের কৃষির জন্য অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন রংপুর আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একেএম কামরুল হাসান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, স্বাভাবিক বৃষ্টি না হলে আমন চাষে তিন ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েন কৃষকরা। প্রথমত সেচে বাড়তি খরচ, দ্বিতীয়ত খেতে আগাছা, রোগ বালাই ও পোকার আক্রমণ বেড়ে যায় এবং তৃতীয়ত উৎপাদিত ধানে ভালো মানের চাল পাওয়া যাবে না। রাজশাহী আবহওয়া অফিসের জৈষ্ঠ্য পর্যবেক্ষক গাউসুজ্জামান জানান, রাজশাহীতে বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার বৃষ্টিপাত অনেক কমেছে। এটা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হচ্ছে। কেননা রাজশাহীতে যে পরিমাণ গাছ লাগানো হচ্ছে তার চেয়ে কাটা হচ্ছে বেশি। আবার নদীর নাব্যতাও কমেছে। সব মিলিয়ে জলবায়ুর উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়া আবহওয়ার খামখেয়ালিপনা বাড়ছে। আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, প্রকৃতিতে বর্ষাকাল চললেও আকাশে যে পুঞ্জিভূত মেঘের অক্ষ সেটা বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থান করছে। এ কারণে বাংলাদেশে বৃষ্টির দেখা নেই। এই অক্ষ দেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেলেই মুষলধারে বৃষ্টি সম্ভব বলে তিনি জানিয়েছেন তিনি। রংপুর আঞ্চলিক কৃষি অফিসের উপ-পরিচালক মাহাবুবুর রহমান বলেন, ধানের আবাদ যাতে পিছিয়ে না যায়, এজন্য সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা রাখতে হবে। বোরো ধানের ক্ষেত্রে কৃষকরা শতভাগ সেচ নির্ভর। কিন্তু আমনের বেলায় বৃষ্টির পানির ওপরেই বেশি নির্ভরশীল তারা। এবার যেহেতু পরিস্থিতি ভিন্ন, তাই সম্পূরক সেচের দিকেই অনেকে ঝুঁকছেন। রাজশাহী অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ শামছুল ওয়াদুদ জানান, এখনই উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। সামনের সপ্তাহে বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। আমন রোপণে লক্ষ্যমাত্রা অজির্ত হবে বলে আশা করছেন তিনি। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এর নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশীদ জানান, তারা সেচকার্য পরিচালনা করছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডক্টর আবদুল্যাহ আল মারুফ গণমাধ্যমে বলেন, রাজশাহী যে তাপমাত্রা বাড়ার প্রবণতা উর্দ্ধমুখী। আমরা গবেষণা করে যেটা পেয়েছি তা হলো, প্রতিবছর দশমিক ০০৩ করে তাপমাত্রা বাড়ছে। তিনি মনে করেন, রাজশাহী অঞ্চলে তাপমাত্রা বাড়ার কারণ জলাশয় ও পুকুর ভরাট, বৃক্ষ নিধন, বহুতল ভবন নির্মাণ। এজন্য রাজশাহীর তাপমাত্রা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। তিনি আরও বলেন, তাপপ্রবাহ মোকাবেলা করার জন্য এখন থেকে ব্যবস্থা নেয়া জরুরী। আমাদের সবাইকে গাছ লাগিয়ে আবার গ্রীন বলয়ে ফিরে আসতে হবে। নাহলে এই অঞ্চলে প্রতিবছর তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে।