করোনাসৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগ, রেকর্ড মূল্যস্ফীতিসহ নানা অর্থনৈতিক সংকটে দেশের মানুষ সঞ্চয় ভেঙে জীবিকা নির্বাহ করেছে। সমাজের একটি শ্রেণীর কাছে অর্থের প্রাচুর্য থাকলেও বেশির ভাগ মানুষের কোনো সঞ্চয় নেই। বছর দুয়েক আগেও যেসব মানুষের কিছু সঞ্চয় ছিল, জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় তারাও ভেঙে ফেলেছে। জিডিপির অনুুপাতে সঞ্চয় না বাড়ার বিষয়টি অর্থনীতির জন্য অশুভ বার্তাই দিচ্ছে। কোনো দেশের বিনিয়োগ সক্ষমতার অন্যতম মাপকাঠি হলো সঞ্চয়-জিডিপি অনুুপাত। যে দেশের সঞ্চয়-জিডিপি অনুুপাত যত বেশি, সে দেশের বিনিয়োগ সক্ষমতাও শক্তিশালী। অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশে সঞ্চয়-জিডিপির ন্যূনতম প্রত্যাশিত অনুপাত ৩২-৩৪ শতাংশ। তিন বছর আগেও দেশে এ অনুপাত ছিল প্রত্যাশিত মাত্রার কাছাকাছি। এরপর গত তিন বছরে জিডিপির আকার লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বাড়লেও সে অনুপাতে সঞ্চয় বাড়েনি। উল্টো গত অর্থবছরে সঞ্চয়-জিডিপির অনুপাত আশঙ্কাজনক হারে কমেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির চাবিকাঠি হলো বিনিয়োগ। সরকার ও ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ দেশ ও দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে তোলে। উন্নত হয় জনগণের জীবনমান। আর বিনিয়োগের বড় একটি অনুঘটক হলো জাতীয় সঞ্চয়। সামগ্রিক সঞ্চয় থেকেই বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের জোগান আসে। এজন্যই অর্থনীতিবিদরা সঞ্চয়-জিডিপি অনুুপাত শক্তিশালী করার ওপর জোরারোপ করেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও দেশে সঞ্চয়-জিডিপি অনুপাত ছিল ৩১ দশমিক ১৪ শতাংশ। পরের অর্থবছরে এ অনুপাত কিছুটা বাড়লেও তার পর থেকে কমছে। এরপর ২০২০-২১ অর্থবছরে সঞ্চয়-জিডিপির অনুপাত নেমে আসে ৩০ দশমিক ৭৯ শতাংশে। সর্বশেষ গত অর্থবছরে (২০২১-২২) দেশের সঞ্চয়-জিডিপির অনুপাত নেমেছে ২৫ দশমিক ৪৫ শতাংশে। জিডিপির অনুপাতে সঞ্চয় কমে যাওয়ার এ প্রবণতাকে অর্থনীতির জন্য অশুভ লক্ষণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর জাতীয় সঞ্চয় কমে যাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এ উপদেষ্টা বলেন, উচ্চমূল্যস্ফীতির অভিঘাত ও কভিড-১৯-এর প্রভাবে দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। আগে ১০ কেজি চাল কিনতে মানুষের যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হতো, এখন তার চেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে। বাড়তি এ ব্যয় নিজেদের আয় থেকে সংস্থান হচ্ছে না। এ কারণে মানুষ বাধ্য হয়ে নিজেদের সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে। আবার বাড়তি ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে নতুন কোনো সঞ্চয় হচ্ছে না।
তিনি বলেন, জিডিপির অনুপাতে সঞ্চয় কমে গেলে বেসরকারি খাতের নতুন বিনিয়োগ সংকুচিত হয়ে যায়। নতুন বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান ও উৎপাদন কমে যাবে। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত হবে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, সেটি অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বিনিয়োগের জন্য দেশের বেসরকারি খাত এখনো পুরোপুরি ব্যাংকের ঋণনির্ভর। সরকার ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিতে বাধ্য হবে, ফলে বেসরকারি খাত ঋণবি ত হবে।
ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের বাইরে জাতীয় সঞ্চয়ের বড় উৎসগুলো হলো সরকারি সঞ্চয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব সঞ্চয় এবং প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। বাংলাদেশের সরকার সবসময়ই বাজেট ঘাটতিতে থাকে। এ কারণে দেশে সরকারি সঞ্চয়ের পরিমাণ যৎসামান্য। ব্যক্তি খাতের সঞ্চয়ই বাংলাদেশের জাতীয় সঞ্চয়ের প্রধান উৎস।
বৈশ্বিক অর্থনীতিতে দুর্যোগ চলছে দুই বছরের বেশি সময় ধরে। ২০২০ সালের শুরুতে অর্থনীতিতে টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি করেছিল কভিডের প্রাদুর্ভাব। আর চলতি বছরের শুরুতে অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করেছে ইউক্রেন যুদ্ধ। বৈশ্বিক অর্থনীতি সংকুচিত হওয়ার এ সময়েও বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় হয়েছে। সরকারি হিসাবে বৈশ্বিক মন্দার এ সময়েও দেশের জিডিপির আকার লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। সর্বশেষ হিসাবে বাংলাদেশের জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ৪৬৫ বিলিয়ন ডলারে। জিডিপির আকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জাতীয় সঞ্চয় বাড়েনি। গত অর্থবছরে দেশের ব্যাংকগুলোয় আমানতের প্রবৃদ্ধি কমেছে। একই সঙ্গে সরকারের সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণও অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে ১৫ শতাংশেরও বেশি।
দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ। কয়েক বছর ধরেই এ খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ। যদিও মুদ্রানীতিতে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়লেও সেটি ১৩ শতাংশের গণ্ডি পেরোতে পারেনি। যদিও বিবিএসের তথ্য বলছে, দেশের বিনিয়োগ-জিডিপির অনুপাত স্থিতিশীল রয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত ছিল ৩২ দশমিক ২১ শতাংশ। গত অর্থবছর শেষে কিছুটা কমে এ অনুপাত ৩১ দশমিক ৬৮ শতাংশে নেমেছে। বিদ্যমান সঞ্চয়-জিডিপি অনুুপাত দিয়েই বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ আরো বাড়ানো যেত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত। রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের এ চেয়ারম্যান বলেন, সঞ্চয়-জিডিপি অনুপাত বেশি হলেই অর্থনীতিতে সুফল বয়ে আনবে, বিষয়টি ঠিক নয়। সঞ্চয়কে বিনিয়োগে রূপান্তরের মাধ্যমেই দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। গত কয়েক বছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। তবে আশার কথা, কয়েক বছর ধরেই দেশের বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত স্থিতিশীল। বর্তমান বাস্তবতায় জাতীয় সঞ্চয় বাড়াতে হলে জনগণকে সঞ্চয়ী হতে হবে। জাতীয় সঞ্চয় বাড়লে দেশের পাশাপাশি জনগণও উপকৃত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছিল ১ লাখ ৪৩ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। ওই সময়ে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে ব্যাংক খাতে ৮৬ হাজার ১১১ কোটি টাকার আমানত বেড়েছে। এ হিসাবে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমেছে ৩৯ দশমিক ৯৭ শতাংশীয় পয়েন্ট।
ব্যাংক খাতের আমানতের মতোই অস্বাভাবিক হারে কমেছে সরকারের সঞ্চয়পত্র বিক্রি। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪১ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেছিল সরকার। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে মাত্র ১৮ হাজার ১৫৭ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের মে মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে মাত্র ৬৩৮ কোটি টাকার। যদিও ২০২১ সালের মে মাসে ২ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। সুদহার কমানোর পাশাপাশি সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে বিভিন্ন ধরনের শর্তারোপ করেছে সরকার। এ কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ কমে গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিবিএসের হিসাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে সঞ্চয়-জিডিপি অনুুপাত নেমে এসেছে ২৫ দশমিক ৪৫ শতাংশে। যদিও বাংলাদেশের বাস্তবতায় জিডিপি-সঞ্চয় অনুপাত অন্তত ৩৪ শতাংশ হওয়া উচিত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর বলেন, জাতীয় সঞ্চয় কমে যাওয়া যেকোনো অর্থনীতির জন্যই খারাপ বার্তা। মানুষ যখন সঞ্চয় ভেঙে জীবিকা নির্বাহ করে, তখন জাতীয় সঞ্চয় কমে যায়। নানা ধরনের শর্ত আর সুদহার কমানোর কারণে দেশে সঞ্চয়পত্র বিক্রি উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধিও নিম্নমুখী। ঘাটতি বাজেট পূরণের জন্য সরকার এখন আরো বেশি ব্যাংকঋণনির্ভর হবে। এতে বেসরকারি খাত ঋণবি ত হয়ে বিনিয়োগশূন্যতায় ভুগবে।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের ভাষ্য হলো, সরকারের কর-জিডিপি অনুপাত এখন ৮ শতাংশের ঘরে। দ্রুতই এ অনুপাত বাড়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বিদেশী বিনিয়োগও (এফডিআই) বাড়ছে না। এ পরিস্থিতিতে সরকার ঋণ পাবে কোত্থেকে? সঞ্চয় না বাড়লে জিডিপির প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে অর্থনীতির মৌলিক সব সূচকই বড় ধরনের ধাক্কা খাবে।