নানা কর্মসূচির মধ্যদিয়ে নড়াইলে বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের ৯৮তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়েছে। বুধবার (১০ আগস্ট) জেলা প্রশাসন ও এসএম সুলতান ফাউন্ডেশনের আয়োজনে কর্মসূচির মধ্যে ছিল সকালে চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের রুহের মাগফেরাত কামনা করে কোরআনখানি, চিত্রাংকন ও রচনা প্রতিযোগিতা, শিল্পীর মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, দোয়া মাহফিল এবং এসএম সুলতান আর্ট ক্যাম্প উদ্বোধন। সকাল ৯টায় শিল্পীর মাজারে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে জেলা প্রশাসন ও এসএম সুলতান ফাউন্ডেশন, এসএম সুলতান বেঙ্গল চারুকলা মহাবিদ্যালয়, নড়াইল প্রেসক্লাব, এসএম সুলতান শিশু চারু ও কারুকলা ফাউন্ডেশন, এসএম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, মূর্ছনা, চিত্রা থিয়েটারসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। পরে মাজার জিয়ারত ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। কর্মসূচির অংশ হিসেবে শিশুস্বর্গে শতাধিক শিশুর অংশগ্রহণে চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এসব কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক মো: হাবিবুর রহমান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায়,অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো: ফকরুল হাসান,সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিয়া ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: রিয়াজুল ইসলাম, নড়াইল পৌরসভার মেয়র আঞ্জুমান আরা। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুর রহমান হিলু, এসএম সুলতান বেঙ্গল চারুকলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ অনাদী বৈরাগী, জেলা কালচারাল অফিসার মো: হায়দার আলী,সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি মলয় কুন্ডু, নড়াইল প্রেসক্লাবের সাধারন সম্পাদক শামীমূল ইসলাম টুলু, সাবেক সভাপতি অতিরিক্ত পিপি অ্যাডভোকেট আলমগীর সিদ্দিকী, সাবেক সহ-সভাপতি সুলতান মাহমুদ, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও সুলতানপ্রেমীরা উপস্থিত ছিলেন। বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান ১৯২৪ সালের ১০ আগষ্ট নড়াইল শহরের মাছিমদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।রাজমিস্ত্রি পিতা মেছের আলীর নান্দনিক সৃষ্টির ঘঁষামাজার মধ্য দিয়ে ছোট বেলার লাল মিঞার (সুলতান) চিত্রাংকনে সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ হয়।অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালিন সময়ে লাল মিঞা নড়াইলের তৎকালীন জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের সুদৃষ্টিতে পড়েন। এসময় তিনি সুলতানকে কলকাতায় নিয়ে খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ও শিল্প-সমালোচক কলকাতা আর্ট স্কুলের গভর্নিং বডির সদস্য অধ্যাপক সায়েদ সোহরাওয়ার্দির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। একাডেমিক যোগ্যতা বিচার না করেই ১৯৪১ সালে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় অষ্টম শ্রেণী পাস সুলতানকে কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি করা হয়। ১৯৪৪ সালে কলেজের তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান দখল করে চতুর্থ বর্ষে উত্তীর্ণ হন শিল্পী সুলতান। কিন্তু প্রথাগত শিক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারেননি তিনি। ছাত্রাবস্থায় তিনি কলেজ ছেড়ে কাশ্মীরের পাহাড়ি অঞ্চলে উপজাতীয়দের সঙ্গে বসবাস ও তাদের জীবন-জীবিকা নিয়ে চিত্রাংকন শুরু করেন। পরে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফরে বেরিয়ে পড়েন। শিল্পী সুলতান যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, পাকিস্তানসহ বিভিন্নদেশ সফর করেন এবং এসব দেশে প্রখ্যাত চিত্রকরদের সাথে তার ছবি প্রদর্শিত হয়। ১৯৫৫-৫৬ সালের দিকে শিল্পী সুলতান মাটির টানে দেশে ফিরে আসেন এবং নিজস্ব উদ্যোগে জন্মস্থান নড়াইলের মাছিমদিয়ায় ফাইন আর্ট স্কুল ও “শিশুস্বর্গ” নামে শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। শিশু-কিশোরপ্রেমী সুলতান ১৯৮০ সালে নিজ বাড়িতে শুরু করেন শিশুস্বর্গের নির্মাণকাজ। তিনি নিজ উদ্যোগে ১৯৯২ সালে ৯ লাখ মতান্তরে ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে ৬০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৫ ফুট প্রস্থের ‘ভ্রাম্যমাণ শিশুস্বর্গ’ নামে দ্বিতল নৌকা নির্মাণ করেছিলেন।এ নৌকায় তিনি শিশুদের নিয়ে চিত্রানদীতে ভ্রমণ করতেন এবং নৌকায় বসেই তাদের চিত্রাংকন শেখাতেন। সুলতানের শিল্পকর্মের বিষয়বস্তু ছিল বাংলার কৃষক, জেলে, তাঁতি কামার, কুমার, মাঠ, নদী, হাওর, বাঁওড়, জঙ্গল, সবুজ প্রান্তর ইত্যাদি। শিল্পী সুলতানের ছবি ভারতের সিমলা, পাকিস্তানের লাহোর, করাচি, নিউইয়র্ক, বোস্টন, মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডন, এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ও জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ঢাকায় খ্যাতনামা বিভিন্ন চিত্রশিল্পীদের সঙ্গে যৌথভাবে প্রদর্শিত হয়। চিত্রাংকনের পাশাপাশি বাঁশি বাজাতে পারতেন সুলতান।তাঁর হাতে প্রায়ই বাঁশি দেখা যেত। পুষতেন সাপ, ভল্লুক, বানর, খরগোশ, মদনটাক, ময়না, গিনিপিক, মুনিয়া, ষাড়সহ বিভিন্ন পশু-পাখি।তিনি বাড়িতে একটি মিনি জ্যু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।হিং¯্র প্রাণীকেও তিনি বশে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। শিল্পী এস এম সুলতান ১৯৮২ সালে একুশে পদক, ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা পদক পান। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের রেসিডেন্ট আর্টিস্ট এবং ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ চারুশিল্পী সম্মাননা হিসেবেও স্বীকৃতি পান তিনি। সুলতানের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য তাঁর নিজ বাড়িতে নির্মিত হয়েছে এস এম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা। ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর চিরকুমার, অসাম্প্রদায়িক শিল্পী এসএম সুলতান যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। নড়াইল পৌরসভার কুড়িগ্রাম-মাছিমদিয়া এলাকায় নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় তাকে সমাহিত করা হয়।