ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি এখনই কৃষিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে না। তারপরও কৃষি পণ্যের দাম বাড়ছে। কিন্তু, আগামী বোরো মৌসুম পর্যন্ত ডিজেলের বর্তমান মূল্য বহাল থাকলে তা ধানের উৎপাদন খরচ বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে। এতে কৃষি উৎপাদনও ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তবে ভোক্তা পর্যায়ে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাস নাগাদ বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তখন বোরো ধানের চাল বাজারে আসবে। চালের বাজার তখন কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা আন্দাজ করতে পারছেন না কেউ।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণ মূলত দুটি। একটি হলো ডলার সঙ্কটের কারণে নিত্যপণ্য আমদানি কমিয়ে দেয়া। দ্বিতীয়ত সার, ডিজেলসহ জ্বালানি মূল্য বাড়িয়ে দেয়া। কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সার ও জ্বালানির দাম বাড়ানোর ফলে কৃষি উৎপাদনে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রথম ধাক্কা লেগেছে চলমান আমন চাষে। এরপর আসন্ন বোরো মৌসুমে আরো বড় ধাক্কা লাগবে। ইতোমধ্যে শাকসবজি চাষাবাদের প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে বাজারে। সব ধরনের শাকসবজির দাম বেড়েছে কেজিতে ১০-২০ টাকা। ডিমের ডজন ১৫০ টাকায় ঠেকেছে। বেড়েছে মুরগির দাম। ১৬০ টাকা কেজির ব্রয়লার মুরগি এখন ২০০ টাকার উপরে। চালের কেজি রকম ভেদে ২ টাকা থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে গত এক সপ্তাহে। মোটা চালের দাম এখন ৫৪-৫৫ টাকা কেজি, বিআর-২৮ চাল ৫৬-৬০, মিনিকেট ৭০-৭৪ এবং নাজিরশাইল ৭৫-৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বাজারে। ১০ দিন আগেও এই মোটা চালের কেজি ৪৬-৫০ টাকা, বিআর-২৮ জাতীয় চাল ৫০-৫৫, মিনিকেট ৬৮-৭২ এবং নাজিরশাইল ৭০-৮৫ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও আকাশচুম্বী। সবকিছু মিলে নিত্যপণ্যের বাজারে উত্তাপ বেড়েই চলেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ গত শনিবার একটি দৈনিকে ‘সার-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি-অসংগঠিত কৃষক শক্তিহীন’ শিরোনামে একটি কলাম লিখেছেন। তাতে তিনি বলেছেন, সার ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে কৃষি অর্থনীতিতে দুই ধরনের চাপ সৃষ্টি হতে পারে। ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবেন কি না সেই দুশ্চিন্তায় আছেন কৃষক। অন্যদিকে, বাজারে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষ কষ্টে পড়ে যাবে। তিনি বলেন, ডিজেলের দাম বাড়ায় বিঘাপ্রতি সেচের খরচ বাড়বে ৭০০ টাকা। পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর ব্যবহারে এই খরচ বাড়বে ৩০০ টাকা। ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানোর ফলে খরচ বাড়বে ৫০০ টাকা। অন্যদিকে, বর্ষা মৌসুমে কাম্য বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ৩০ শতাংশ জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে না। এই অবস্থাটিও আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি। খাদ্যশস্যের চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে চাল ও গম ব্যাপক আকারে আমদানি করতে হবে। এই আমদানি ব্যয় নির্বাহ করতে প্রয়োজন হবে বৈদেশিক মুদ্রার। ডলারের বাজারে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে এর ফলে খাদ্যশস্যের প্রয়োজন মেটাতে আমদানি করাও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আমরা কি সে জন্য কিছু প্রস্তুতি নিয়েছি?
সার, ডিজেল এবং কেরোসিনসহ কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধিতে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হচ্ছে কৃষককে। এতে কৃষি উৎপাদন খরচ বাড়ছে, যার প্রভাব ইতোমধ্যে পড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যবাজারে। বেড়েছে চালের দাম। শাকসবজি, মুরগি ও ডিমের দামও আকাশচুম্বী। অন্যান্য পণ্যের দামও ঊর্ধ্বমুখী। তবে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সার ও জ্বালানি মূল্য না কমালে দিন যতই যাবে ততই অস্থিতিশীল হতে থাকবে বাজার। মূলত সার, ডিজেল, কেরোসিনসহ জ্বালানি মূল্য বাড়ানোর কারণে এমন সঙ্কট। শেষ পর্যন্ত চালসহ খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তে বাড়তে কোথায় গিয়ে ঠেকে, তা অনিশ্চিত। এমতাবস্থায় আগামীতে আরো কঠিন সময় আসছে কৃষক ও ভোক্তাদের। মানুষের মধ্যে হা-হুতাশ আরো বাড়ার শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই অবস্থায় কৃষক ও ভোক্তা কেউ ভালো নেই।
এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ছিল দীর্ঘদিন ধরে। তার উপর গত ১ আগস্ট কেজিতে ৬ টাকা বাড়ানো হয় ইউরিয়া সারের দাম। এর পরই গত ৫ আগস্ট বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের (ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন ও পেট্রোল) দাম। এর মধ্যে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটার ৮০ টাকা থেকে ১১৪ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ দাম বৃদ্ধির হার প্রায় ৪২ শতাংশ। অন্যদিকে, পেট্রলের লিটার ৮৬ টাকা থেকে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের ৮৯ টাকা থেকে ১৩৫ টাকা করা হয়। অর্থাৎ পেট্রল ও অকটেনের মৃল্যবৃদ্ধির হার ৫০ শতাংশেরও বেশি। এর মধ্যে ডিজেল ও কেরোসিন সরাসরি কৃষির সাথে জড়িত।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) প্রধান প্রকৌশলী (ক্ষুদ্রসেচ) মোহাম্মদ জাফর উল্লাহ বলেন, বোরো মৌসুমে আমাদের (বিএডিসি) প্রায় সাড়ে ১২ লাখ ডিজেল চালিত সেচযন্ত্র ব্যবহার হয়। আর বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্রের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ৩৩ হাজার। মূলত বোরোতেই সেচযন্ত্রের ব্যবহার বেশি হয়। তবে, এ বছর যেহেতু খরা যাচ্ছে, তাই এবার আমনেও সেচ বেশি লাগবে। তিনি মনে করেন সামনে বোরো মৌসুম আসার আগেই সরকার হয়তো এ বিষয়ে বিকল্প চিন্তা করবে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (ময়মনসিংহ) কৃষি অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. হাসনীন জাহান বলেন, আমাদের খাদ্য উৎপাদনের একটা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা থাকে। কোনো কারণে যদি এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হয় তাহলে আমদানির উপর নির্ভর করতে হবে। আমরা যেন অভ্যন্তরীণ উৎপাদন দিয়েই চাহিদাটা পূরণ করতে পারি সেটা অর্জনে যা যা করণীয় সে পদক্ষেপ নেয়া উচিত। যেহেতু এখন গ্লোবাল ক্রাইসিসও চলছে। বাইরের আমদানির উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে। খাদ্য অপচয় যাতে না হয়, পণ্য পরিবহনও যাতে স্মুথ থাকে। ডিস্ট্রিবিউশন, মার্কেটিংয়েও গুরুত্ব দিতে হবে।
এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, এমন সময় দামটা (সার ও জ্বালানি) বাড়লো যখন রোপা আমন চাষ হচ্ছে। বন্যা ও দীর্ঘ খরার কারণে এমনিতেই আমন চাষ এবার বিলম্বিত হয়েছে। সার ও ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ফলে স্বাভাবিকভাবেই রোপা আমন উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে,উৎপাদন কমবে। সামনে আসছে বোরো মৌসুম। তখন প্রচুর পরিমাণ তেলের দরকার (সেচ) হবে। কারণ, আমাদের ইরিগেশন ৬৫ শতাংশ সেচযন্ত্র ডিজেলের উপর নির্ভরশীল। আর এখন তো গ্রামা লে বিদ্যুতই থাকে না। তিনি বলেন, সরকার দাম বাড়িয়েছে ঠিক আছে। সরকারের হাতে কৃষকের তালিকা আছে। আমি মনে করি ফার্টিলাইজার ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিসহ কৃষিতে অন্যান্য খরচ হিসাব করে কৃষকদের নগদ সহায়তা দেয়া উচিত। এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ড. আনোয়ার ফারুক বলেন, ইরিগেশনসহ কৃষি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। পরিবহনসহ সব ধরনের ভাড়া বাড়বে। যার ফলে প্রত্যেকটা জিনিসের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আরো বাড়বে। ভর্তুকি সাপোর্ট দিয়ে ডিজেলের দাম কমিয়ে রাখা গেলে ভালো হতো বলে মনে করেন সাবেক এই কর্মকর্তা। সার ও তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে কৃষিতে প্রভাব প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, বিদ্যুতের দাম বাড়েনি, ফলে বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্রে কোনো সমস্যা হবে না। তবে সার্বিকভাবে কৃষিতে কিছুটা প্রভাব পড়বে। কিন্তু এতে কৃষি উৎপাদন কমবে না, তবে কৃষকের লাভ কমে আসবে। তিনি বলেন, ‘বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে একটু কষ্ট হলেও আমাদের সম্মিলিতভাবে তা মোকাবেলা করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম আরো কমলে দেশেও কমানো হবে।