দেশে কেন ১৫০ আসনে
উন্নত দেশেগুলোতে বন্ধ হচ্ছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ভোটগ্রহণ। তারপরও সিংহভাগ রাজনৈতিক দলের মতামত তোয়াক্কা না করে গত ২৩ আগস্ট আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসির ভাষ্য, ইভিএমে ভোট কারচুপির কোনো সুযোগ নেই। অথচ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে বিভিন্ন দেশে বিতর্ক রয়েছে। ভোটদানের ক্ষেত্রে শতভাগ স্বচ্ছতা এবং নিরাপত্তা না থাকায় ইতিমধ্যে অনেক দেশ ইভিএম পরিত্যাগ করেছে। তবুও আগামী নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। প্রশ্ন হলো সংখ্যা গরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের মতামত উপেক্ষা করে কেনো এমন সিদ্ধান্ত ? কার স্বার্থে ইভিএম ? এ প্রশ্ন দেশ তথা বিশ্ব বিবেকের নয় কি? বিশেষ করে গত ১৭ বছরে পৃথিবীর যতগুলো দেশ ইভিএম গ্রহণ করেছে, তার চেয়ে বেশি দেশ ইভিএম বাতিল করেছে। বাতিল করেছে এমন দেশের তালিকায় আছে জার্মানি, স্পেন, ইতালি, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ড, বেলজিয়াম, নরওয়ে, ভেনেজুয়েলা, ইউক্রেন, মালয়েশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো রাজ্য।
বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে বিগত ২২ বছর ধরে ইভিএম চালু রয়েছে। কিন্তু ২০০৯ সাল হতে ইভিএমের বিরুদ্ধে ব্যাপকহারে অভিযোগ উঠতে থাকে। ভারতের আদালতে ইভিএমের বিরুদ্ধে একাধিক পিটিশন রয়েছে। ২০১৮ সালে দেশটির সিংহভাগ রাজনৈতিক দল এ পদ্ধতির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে। কংগ্রেস দলের মুখপাত্র অভিষেক মনু সিংভির মতে, শুধু তাদের দলই নয় দেশের অন্তত ৭০ শতাংশ রাজনৈতিক দলই মনে করে যত দ্রুত সম্ভব কাগজের ব্যালট আবার ফিরিয়ে আনা উচিত। এ দাবিতে তারা অনড়। ইভিএমের প্রতি তাদের বিশ্বাস নেই। ২০২০ সালে ভারতে বিরোধী দলগুলো ইভিএমের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছে। ভারতীয় কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ ভরদ্বাজ মনে করেন যে, একটি গোপন কোড জানা থাকলেই ই-ভোটিং মেশিনের গণনাপদ্ধতি সম্পূর্ণ পাল্টে দেওয়া সম্ভব। মেশিনের মাদারবোর্ড তখন সে অনুযায়ীই কাজ করবে। মেশিন আগে হাতে পেলে এ কাজ খুবই সহজ। এমনকি মেশিন আগে হাতে না পেলেও ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া চলাকালীন মাঝপথে মাত্র ৯০ সেকেন্ডে এ কাজ করা যায়। বর্তমানে পুরোপুুরি ইভিএম চালু আছে শুধুমাত্র ভারত, ব্রাজিল, ফিলিপাইন এবং এস্তোনিয়ায়। তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে জানা যায়, ভোট ব্যবস্থাপনাকে সহজতর করার লক্ষ্য থেকেই সর্বপ্রথম ১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ইভিএম পদ্ধতি চালু হয়। আবিষ্কারের ছয় দশক অতিক্রান্ত হলেও বিশ্বের কোনো দেশেই পুরোপুরি মানুষের আস্থা অর্জন হয়নি ইভিএম পদ্ধতিতে। এ পর্যন্ত অন্তত ৩৪টি দেশ ইভিএম ব্যবহার কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। এরমধ্যে ১৪টি দেশ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে ইভিএম। ১১টি দেশে আংশিক ব্যবহার হচ্ছে। পাইলট প্রকল্প হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে ৫টি দেশে। ২০২০ সালেরও আগে ভারতের ইকোনমিক টাইমস পত্রিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের ২০০টি দেশের মধ্যে মাত্র যে ৪টি দেশে ইভিএম ব্যবহার করা হয়, ওইসব দেশেও আছে ইভিএম নিয়ে তুমুল বিতর্ক। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে ইভিএমের গ্রহণযোগ্য ব্যবহার ঘটেনি। শতকরা ৯০ ভাগ দেশে ইভিএম পদ্ধতি নেই। যে কয়েকটি দেশ ইভিএম চালু করেছিল এখন তারাও এটি নিষিদ্ধ করেছে। আয়ারল্যান্ডও ২০০২ থেকে ২০০৪ সালে ইভিএম ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিতর্কের মুখে দুটি কমিশন গঠন করে। কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইভিএম যন্ত্র ‘বিশ্বাসযোগ্য নয়’। প্রযুক্তিগত রক্ষাকবচ অপ্রতুল। সবদিক বিবেচনায় ২০০৬ সালে আয়ারল্যান্ড ইভিএম পরিত্যাগ করে। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে জার্মানির ফেডারেল কোর্ট ইভিএমকে অসাংবিধানিক ঘোষণা দেয়। একই বছর ফিনল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্ট তিনটি মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনের ফলাফল অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। ২০০৭ সালে নেদারল্যান্ডস ইভিএম ব্যবস্থা বাতিল করেছে কারচুপির কারণে নয়, বরং এই মেশিন টেম্পারিং করা যাবে না, এ ধরনের কোনো নিশ্চয়তা ছিল না বলে। ড. অ্যালেক্স হালডারমেন আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে ইভিএমের ওপর গবেষণা করে প্রমাণ পেয়েছেন, আমেরিকায় ইভিএম টেম্পারপ্রুফ নয়। ফলে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যেও ইভিএম ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। আমেরিকায় ২২টির বেশি অঙ্গরাজ্যে ইভিএম-কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং বাকিগুলোতেও নিষিদ্ধ করার পথে। বাংলাদেশে ইভিএমের সর্বপ্রথম সূত্রপাত ঘটে এক-এগারোর সময়কালের শাসনামলে। তৎকালীন এটিএম শামসুল হুদা কমিশন স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএমের প্রচলন ঘটায়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর সহায়তায় প্রথমে ২০১০ সালে এ প্রযুক্তির ৫৩০টি মেশিন কেনা হয়। ব্যবহার করতে গিয়ে ইভিএমে নানা যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে। পরে ২০১১ সালে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) প্রস্তুত করা ৭০০ ইভিএম কেনা হয়। এগুলোও পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত ছিল না। শামসুল হুদা কমিশন ২০১১ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনে ২১ নং ওয়ার্ডে বুয়েটের ইভিএম ব্যবহার করে। পরে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন, টাঙ্গাইল পৌরসভা ও নরসিংদী পৌরসভায় এ প্রযুক্তি ব্যবহার হয়। পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ায় হুদা কমিশনের স্থলে বিধির নিয়মে নতুন কমিশন হিসেবে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদায়ী রকিব উদ্দিন কমিশন দায়িত্ব নেয়। তাদের মেয়াদে রাজশাহী সিটিতে ২০১৩ সালে ইভিএম ব্যবহার করে পুরো বিতর্কের মধ্যে পড়ে যায় ইসি। পরে কমিশনার হিসেবে মেয়াদ পূর্ণের আগে ইভিএম ব্যবহার করেনি। তবে, নতুন ইভিএমের প্রচলন চালু রেখে যায়। আর ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কেএম নূরুল হুদার কমিশন দায়িত্বে এসে কমিটি করে পুরনো ইভিএমকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। (তথ্যসূত্র : ইত্তেফাক- ২৪.০১.২০২০)
অস্ট্রেলিয়ান পাবলিক সার্ভিসের জ্যেষ্ঠ তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সাইফুর রহমানের মতে, ইভিএমের সঙ্গে সংযোজিত যেকোনো ইনপুট পোর্টের মাধ্যমে যন্ত্রটির ভেতর ম্যালওয়্যার-মলিকুলাস কোড প্রবেশ করিয়ে ভোটের ফলাফল বিকৃতি করা কঠিন কোনো ব্যাপার নয়। ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়াই যন্ত্রটির ভেতরে গোপনে মুঠোফোনের সিম-জাতীয় আইসি (ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট) কিংবা গোপন যন্ত্রাংশ বা ডেটা এন্ট্রি পোর্ট সংযোগ স্থাপন করে দূর থেকে ইভিএম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বাংলাদেশে যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে ডিজিটাল অডিট ট্রেইলের ব্যবস্থা আছে (এতে গোপনীয়তা বিঘিœত হওয়ার ঝুঁকি আছে)। তবে ব্যবস্থাটিও যেহেতু সফটওয়্যার-চালিত, তাই সোর্স কোডসংক্রান্ত সমস্যাটি এখানে থেকেই যাচ্ছে। নির্বাচনের ঠিক আগে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দিয়ে প্রতিটি ইভিএম মাদারবোর্ড পরীক্ষা করা, পরীক্ষা শেষে প্রতিটি সফটওয়্যারের ডিজিটাল ছাপ (ডিজিটাল ফিঙ্গারপ্রিন্ট) সংরক্ষণ করা দুরূহ কাজ। সব কটি যন্ত্রের (প্রায় ৪০ হাজার ভোটকেন্দ্র এবং লক্ষাধিক ইভিএম) হার্ডওয়্যারের লিস্ট, সার্কিট ডিজাইন, হার্ডডিস্কের ফরেনসিক কপি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্রধান প্রধান রাজনৈতিক পক্ষকে দেওয়া হচ্ছে না এবং তাদের সেসব যাচাইয়ের কারিগরি সক্ষমতাও নেই। বুয়েটের ডিজাইন করা, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি কিংবা ওয়ালটনের তৈরি করা হার্ডওয়্যার তাদের পছন্দ হয়েছে। ড. কায়কোবাদ ডেইলি স্টারকে বলেছেন, ‘ইভিএম আমরা নিজেরা কিন্তু পরীক্ষা করে দেখিনি।’ ইভিএমের সফটওয়্যার আর্কিটেকচার, অপারেটিং সিস্টেম ও অ্যালগরিদমই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেহেতু ইভিএমে ব্যবহৃত সফটওয়্যারের ওপরই নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করে, তাই এই অংশের নিয়ন্ত্রণ যার হাতে থাকবে, তার পক্ষে নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করা অত্যন্ত সহজ। (তথ্যসূত্র : ডেইলি স্টার-২৮.০৫.২০২২)। মূলত, ইভিএম নিয়ে বিতর্ক ও নানাবিধ জটিলতার কারণে উন্নত দেশগুলো ইভিএম ব্যবহার থেকে সরে গেছে। ইভিএম নিয়ে পশ্চিমা দেশের একাধিক পর্যবেক্ষণে বলা হচ্ছে, মূলত বলপ্রয়োগে পরিচালিত সরকারগুলোয় ইভিএম চাপিয়ে দেওয়ার সুস্পষ্ট লক্ষণ রয়েছে।
বলা বাহুল্য যে, ইসির সঙ্গে সংলাপে আওয়ামী লীগের মিত্র জাতীয় পার্টিসহ ১৫টি রাজনৈতিক দল ইভিএম মেশিন ব্যবহারের বিরোধিতা করেছে। সংলাপে অংশ নেয়নি বিএনপিসহ এমন ৯টি দলও ওই মেশিনে ভোটগ্রহণের বিরোধিতা করে আসছে। জামায়াতে ইসলামীও ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করছে। দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করছে। শুধু আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দেশের সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যমসহ অধিকাংশ ব্যক্তি ইভিএমের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অথচ কারও কথা না শুনে ইভিএমের কারিগরি ত্রুটি না দেখে নির্বাচন কমিশন ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোটের ঘোষণা দিলো। কমিশন কী উদ্দেশে এ কাজ করছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, ব্যালট পেপার না হলে তারা (নির্বাচন কমিশন) যা বলবে তাই চূড়ান্ত। এটা যাচাই করা আমাদের পক্ষে কঠিন। আমাদের শঙ্কা নির্বাচন কমিশনের সততা বিশ্বাসযোগ্যতা ও ইভিএমের কারিগরি ত্রুটি নিয়ে। তিনি আরও বলেন, নতুন ইভিএম কিনতে হলে অর্ধ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হবে। অন্যদিকে আমরা বর্তমানে চরম সংকটে আছি। সংকট নিরসনে ৭ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিচ্ছি। এমতাবস্থায় এটি কতটুকু যুক্তিযুক্ত আমার বোধগম্য নয়।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব তাঁর প্রবন্ধে বলেন, দেশের সব নাগরিকের নিখুঁত বায়োমেট্রিক তথ্যশালা ঠিকঠাক তৈরি হয়নি বলে নির্বাচন কমিশনে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বিষয়ক লক্ষ লক্ষ অভিযোগ আছে। নতুন সমস্যা হচ্ছে, প্রায় কোটি নাগরিকের জন্মনিবন্ধনের তথ্য হারিয়ে যাওয়া। ‘ধারণা করা হচ্ছে, সব মিলিয়ে কমপক্ষে ৫ কোটি জন্মনিবন্ধন একেবারেই গায়েব হয়ে গেছে। ২০২৩ সালের মধ্যে কোটি নাগরিকের জন্মনিবন্ধন ও এনআইডি তৈরি-সহ, বিদ্যমান এনআইডির কোটি ভুল শুধরানো অসম্ভব। যেখানে নিখুঁত এনআইডি এবং বায়োমেট্রিক তথ্যশালাই তৈরি হয়নি, সেখানে অর্ধেক (১৫০) আসনে ইভিএমে ভোটের যৌক্তিকতা কোথায়?
তিনি আরও বলেন, একটি কেন্দ্রের সব ভোটারের তথ্য ঐ কেন্দ্রের সব ইভিএমে থাকে না বলে, একটি ইভিএম হ্যাং করলে বা একটি ইভিএমের ভোটারের বায়োমেট্রিক শনাক্ত করা না গেলে তাঁকে অন্য ইভিএমের মাধ্যমে ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করা যায় না। যদিও নির্বাচন কমিশন থেকে ইভিএমকে কাটিং এজ প্রযুক্তি বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা মনে করি, ইভিএম সত্যিকার অর্থে একটা হার্ড কোডেড এবং ভোটার অবান্ধব মেশিন। পোলিং কার্ড ও অডিট কার্ডের সাথে ভোট কেন্দ্রের সমস্ত ভোটারের তথ্য সংযোজন করা নেই বলে, ভুলে এক বুথে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ভোটার অন্য বুথের লাইনে গিয়ে ভোট দিতে পারেন না। এমনকি কেন্দ্রভিত্তিক মাস্টার ডেটাবেজ না থাকায় যে কোনো ভোটার যে কোনো বুথে ভোট দিতে পারেন না। ইভিএম ইন্টারনেটে সংযুক্ত নয়, তবে ইন্ট্রানেটে সংযুক্ত। অর্থাৎ যন্ত্রগুলো নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কম্পিউটার নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত হতে পারে, ফলে ‘বিশেষ প্রভাবশালী’ গোষ্ঠী চাইলে এই প্রাইভেট নেটওয়ার্কেরই অন্য কম্পিউটার থেকে ইভিএম নিয়ন্ত্রন সম্ভব। তদুপুরি যন্ত্রটির ভেতরে আগে থেকেই ইন্সটল্ড করা সিম বা কার্ড জাতীয় আইসি (ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট) স্থাপন করে, ইন্টারনেট সংযোগ ছাড়াই যন্ত্রটিকে দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অন্যদিকে অডিট কার্ডের মাধ্যমে কেন্দ্রের বুথ থেকে ফলাফল হস্তান্তরের পরে ঐ কেন্দ্রের ফলাফল এবং পুরো আসনের সব কেন্দ্রের ফলাফল দুটাই ম্যানুয়াল প্রসেসের। এখানে অডিট কার্ডের চিপের মাধ্যমেও জালিয়াতি সম্ভব। আর পুরো ইভিএম ভোট প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হলেও শুধু ফলাফল তৈরির ম্যানুয়াল প্রক্রিয়ায় অস্ব”চতা করে ভোটের ফলাফল পাল্টে দেয়া সম্ভব। ডিজিটাল অডিট ট্রেইলে গোপনীয়তা বিঘিœত হবার ঝুঁকি আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে ডিজিটাল অডিট ট্রেইলের ব্যবস্থা আছে, যদিও যে কোনো ডিজিটাল অডিট ট্রেইলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বিঘিœত হবার ঝুঁকি আছে। তবে ব্যবস্থাটি যেহেতু সফটওয়্যারচালিত, তাই সোর্স কোড সংক্রান্ত সমস্যাটি এখানে থেকেই যাচ্ছে। নির্বাচনের ঠিক পুর্বে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দিয়ে প্রতিটি ইভিএম মাদারবোর্ড পরীক্ষা করা, পরীক্ষা শেষে প্রত্যেক সফটওয়্যারের ডিজিটাল ছাপ (ডিজিটাল ফিঙ্গারপ্রিন্ট) সংরক্ষণ করা দুরূহ কাজ, বলতে গেলে অসম্ভব। মাঠ পর্যায়ের প্রিজাইডিং অফিসারদের তথ্যমতে, বর্তমান ইভিএমের একটা বড় ত্রুটি হচ্ছে মেশিন হ্যাং হওয়া। ব্যক্তি ভোট পরিবর্তন করতে, অল্প সময়ের মধ্যে একাধিক ব্যালটে চাপ, দ্র“ত একাধিক বাটনে চাপ দিলেই মেশিন টা হ্যাং করে যায়। একবার মেশিন হ্যাং করলেই ৫ থেকে ১০ মিনিট নষ্ট হয়, মেশিন পুনরায় সিনক্রোনাইজেশান বা রিস্টার্ট দিতে হয়। এতে ভোট গ্রহণের হার কমে যায়।
ইভিএমে ভোটগ্রহণ ডিজিটালে করা হলেও ফলাফল ম্যানুয়ালি করতে হয় উল্লেখ করে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, একটি নির্বাচনী আসনের সব কেন্দ্রের মোট ফলাফল হাতে তৈরি করা হয়। কিছু কেন্দ্রের ফলাফল ইভিএমে এবং কিছু কেন্দ্রের ফলাফল হাতে করে একটা অস্বচ্ছ ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। সব কেন্দ্রের ফলাফল ম্যানুয়ালি নিয়ে, ম্যানুয়ালি কেন্দ্রের ফলাফল তৈরির পদ্ধতি একদিকে হাস্যকর এবং অন্যদিকে জালিয়াতপ্রবণ। সবকেন্দ্রের ইন্টিগ্রেটেড ফলাফল তৈরি করতে বর্তমান ইভিএম সক্ষম নয়। পোলিং কার্ডের ‘ভোট প্রদানের তথ্য’ অডিট কার্ডে এনে ফলাফল তৈরি করতে হয়। কিন্তু মাস্টার ডেটাবেইজ নেই বলে এসব ডেটাবেইজ ট্র্যান্সফার করে ম্যানুয়ালি যোগ করার জঞ্জাল আছে, ফলে এখানে অস্বচ্ছতা তৈরি সম্ভব। আব্দুল লতিফ ম-ল বলেন, আমরা বার বার বলেছি, অংশীজনরা যদি না চায়, তাহলে ইভিএম ব্যবহার করা উচিত হবে না। কিন্তু ইসির সাথে বিভিন্ন দলের সংলাপে অধিকাংশ দলই ইভিএম ব্যবহারের বিরুদ্ধে মত দেওয়া সত্ত্বেও জোর করে ইভিএম ব্যবহার করার সিদ্ধান্তের কারণ বোধগম্য হচ্ছে না।