মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩১ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
ভোলার বিভিন্ন চরাঞ্চল অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত লালমোহনে ডা. আজাহার উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের সভাপতিকে সংবর্ধনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহিদ ও আহতদের স্মরণে স্মরণসভা সিংড়ায় পরিবেশ রক্ষার্থে ৫৩৬টি ডাস্টবিন বিতরণ কাজী আজিম উদ্দিন কলেজে শিক্ষার্থীদের সাথে ছাত্রদলের ৩১ দফা নিয়ে মতবিনিময় সভা পটুয়াখালীতে শিক্ষক দম্পতি হত্যাকান্ডের মূল রহস্য উদঘাটনের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন টুঙ্গিপাড়ায় ভিক্ষুক ও হতদরিদ্রদের আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলো সমাজসেবা অফিস জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের আওতায় এনে সহায়ক কর্মচারী অন্তর্ভুক্ত ও বিচার বিভাগের আলাদা সচিবালয় গঠনের নিমিত্তে দাবি পেশ দাউদকান্দিতে সড়কের মাটি ধসে পড়ল খালে, দুর্ঘটনার আশংকা সীতাকুন্ডে বিতর্কিত মাদ্রাসা পরিচালকের করা মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে মানববন্ধন

কোন খাতে শ্রমিকের মজুরি কত?

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

বাংলাদেশে চা শ্রমিকদের আন্দোলনের পর তাদের নিম্ন মজুরি পাওয়ার বিষয়টি সবার নজরে এসেছে। অবশেষে সরকারের হস্তক্ষেপে দৈনিক মজুরি কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র চা শ্রমিকরাই নয়, এমন নিম্ন মজুরি পাচ্ছেন আরো অনেক খাতের শ্রমিক। জ্বালানি ও ভোজ্য তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের চড়া দাম, মূল্যস্ফীতির চাপ নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা আরো কঠিন করে তুলেছে। কোনো কোনো খাতের মজুরি গত কয়েক বছরে পুনঃনির্ধারণ করা হলেও অনেকগুলো খাতের মজুরির কোনো পরিবর্তন হয়নি। আবার সরকার নির্ধারিত মজুরির থেকেও কম দেয়ার অভিযোগ রয়েছে কোনো কোনো খাতে।
বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি: বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশা খাতের শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণে সরকারের একটি বিশেষ বোর্ড রয়েছে। এই বোর্ডের কাজ হলো নিয়মিতভাবে মজুরি পর্যালোচনা করে নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে দেয়া। কিন্তু তৈরি পোশাকের মতো খাতে কিছুটা নিয়মিতভাবে মজুরি নির্ধারণ করা হলেও অন্যসব খাতের শ্রমিকদের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে গেছে। নিম্নতম মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. সেলিনা আক্তার বলেন, ‘আমি কিছুদিন হলো দায়িত্ব নিয়েছি। এখন পুরো বিষয়টি যাচাই করে দেখবো। তবে কোনো সেক্টরে যদি মজুরি সময়োপযোগী না করা হয়, নিশ্চয়ই আমরা ব্যবস্থা নেবো।’ শ্রম সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ছয় কোটি ৩৫ লাখ শ্রমিক রয়েছে, যারা বিভিন্ন খাতে কাজ করেন। বাংলাদেশের সরকার ৪২টি খাত নির্ধারণ করে এ শ্রমিকদের নি¤œতম মজুরি নির্ধারণ করে দিয়েছে।
যদিও যে খাতে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কাজ করে, সেই কৃষি খাতের ক্ষেত্রে আলাদা কোনো মজুরি নেই। বাজারের চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে সেখানে মজুরি নির্ধারিত হয়।
বাংলাদেশের কোন খাতের শ্রমিকরা কেমন মজুরি পান? নি¤œতম মজুরি বোর্ডের গেজেট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, একটি খাত থেকে আরেকটি খাতের মজুরির মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। কোনো কোনো খাতের মজুরি মাত্র তিন হাজার টাকা, আবার কোনো কোনো খাতের মজুরি ১৬ হাজার টাকার বেশি। যেমন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে সর্বনি¤œ মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে আট হাজার টাকা। যার মধ্যে বেসিক হবে চার হাজার এক শ’ টাকা, বাড়ি ভাড়া দু’হাজার ৫০ টাকা ও অন্য খরচ এক হাজার ৮৫০ টাকা। বিদেশী ক্রেতাদের চাপ, সরকারি নজরদারি ও শক্তিশালী শ্রম সংগঠন থাকায় এই খাতে মজুরি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু অন্য খাতে নি¤œতম মজুরি নির্ধারণ করা হলেও অনেক ক্ষেত্রে সেটি পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তার বাইরে রাবার শিল্প, পাটকল, বিড়ি, ম্যাচ শিল্প, জুট প্রেস, সিনেমা হল, হোসিয়ারি, কোল্ড স্টোরেজ, পেট্রোল পাম্প, আয়ুর্বেদিক কারখানা, আয়রন ফাউন্ড্রি ওয়েল মিলস অ্যান্ড ভেজিটেবল প্রোডাক্টস, লবণ শিল্প, ইত্যাদি খাতের মজুরি সর্বশেষ নির্ধারণ করা হয়েছিল বহু বছর আগে। যেমন- কোল্ড স্টোরেজ ও ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্প খাতের শ্রমিকদের সর্বশেষ মজুরি নির্ধারিত হয়েছিল ২০১২ সালে, ম্যাচ শিল্পের ২০১৩ সালে আর বিড়ি শিল্পের ২০১৬ সালে।
আবার পেট্রোল পাম্পের শ্রমিকদের মজুরি বহু বছর আগে নির্ধারণ করা হলেও পরে আর সমন্বয় করা হয়নি। তবে এই খাতে শ্রমিকরা এখন আট থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসে আয় করেন বলে জানা গেছে। বাজারে মূল্যস্ফীতির সাথে মিল রেখে সেগুলো পরে আর সমন্বয় করা হয়নি। তবে কয়েকটি খাতের মজুরি পুনঃনির্ধারণের কাজ চলছে বলে নি¤œতম মজুরি বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
কেন বিভিন্ন খাতের মজুরিতে এত পার্থক্য? বিভিন্ন খাতের মজুরি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, খাত ভেদে নি¤œতম মজুরিতে অনেক পার্থক্য রয়েছে। যেমন- হোটেল ও রেস্তোরায় নি¤œতম মজুরি ৩৭১০ টাকা হলেও নির্মাণ ও কাঠ শিল্পে ১৬ হাজার টাকার বেশি।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের পরিচালক নাজমা ইয়ামসিন বলেন, ‘বিভিন্ন খাতে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা, ঝুঁকি ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে অনেক সময় মজুরির কমবেশি হয়। যেমন- একজন দক্ষ কাঠমিস্ত্রি মজুরি বোর্ডের নির্ধারিত মজুরির চেয়েও বেশি আয় করতে পারেন। আবার অনেকে নির্ধারিত মজুরি কাঠামোর কমও নিতে বাধ্য হন।’ কোনো খাতের মজুরি নির্ধারণ করার পর তিন থেকে পাঁচ বছর পরপর সেটি পুর্নমূল্যায়ন করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু অনেক খাতের মজুরি বছরের পর বছর ধরে কোনো পরিবর্তন হয়নি।
নাজমা ইয়াসমিন বলেন, ‘সাধারণত নতুন মজুরি নির্ধারিত হয় সরকার, মালিকপক্ষ আর ট্রেড ইউনিয়নের আলোচনার মাধ্যমে। অনেক সময় সরকার বা মালিক নিজে থেকে এটা করতে পারে, আবার শ্রমিকদের চাপেও হতে পারে। কিন্তু অনেক খাতে দেখা যায়, যেসব খাতের ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক সংগঠন জোরালো নয়, তাদের মজুরির বিষয়টি ঠিকভাবে মনোযোগ পায় না।’ তিনি জানান, অনেক সময় নিজেদের অধিকার, সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরির বিষয়টি শ্রমিকদের জানা থাকে না। ফলে তারা মালিকদের সাথে দরকষাকষি বা অধিকার আদায় করে নিতে পারে না।
বাংলাদেশে প্রায় ছয় কোটি ৩৫ লাখ শ্রমিক রয়েছে বলে জানায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউ অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)। এর প্রায় অর্ধেক অদক্ষ শ্রমিক।
যেভাবে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়: বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, শ্রমিকদের নি¤œতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়। আইনে বলা আছে, কিভাবে নি¤œতম মজুরি বোর্ড গঠন হবে, কিভাবে কাজ করবে, কী বিষয়গুলো বিবেচনায় নেবে ও কত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করবে, সবই সেখানে বলা হয়েছে।

তবে কোনো পেশার মজুরির ক্ষেত্রে নি¤œতম মজুরি বোর্ড নিজেরা উদ্যোগ নিতে পারে না। এ বিষয়ে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে তাদের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানোর পর মজুরি বোর্ড কাজ শুরু করে এবং তাদের পর্যালোচনা শেষে সুপারিশ প্রদান করে। বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী, প্রতি পাঁচ বছর পর পর নি¤œতম মজুরি পুনঃর্বিবেচনা করার বিধান রয়েছে। ফলে কোনো কোনো খাতে যেমন পাঁচ বছর পরে পুনরায় পর্যালোচনা করা হয়, কোনো কোনো খাতে তিন বছর পরে হয়ে থাকে, আবার কোনো কোনো খাতে দীর্ঘসময় ধরে কোনো পর্যালোচনা হয় না। সাধারণত শ্রমিকদের জীবনযাপনের ব্যয়, জীবনযাপনের মান, প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন খরচ, উৎপাদনশীলতা ও দ্রব্যের মূল্য, মূল্যস্ফীতি এগুলোর সাথে কাজের ধরণ অর্থাৎ সেই কাজে ঝুঁকি কতটা আছে ও মালিকপক্ষের কতটা সামর্থ্য আছে, সেগুলোও বিবেচনায় নিয়ে নূন্যতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়।
যেভাবে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ: বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বর্তমানে প্রায় সাড়ে সাত শতাংশ। অর্থাৎ গত বছর কোনো পণ্য বা বা সেবা কিনতে যে টাকা খরচ করতে হয়েছে, এখন তার তুলনায় কমপক্ষে সাড়ে সাত শতাংশ বেশি খরচ করতে হয়। কিন্তু বাস্তবে এ খরচ আরো বেশি। কারণ মূল্যস্ফীতি খাদ্য ও খাদ্য বর্হিভূত বিভিন্ন পণ্যের দাম বৃদ্ধির গড় হিসাব করে বের করা হয়। কিন্তু চালের বা ডালের দাম যদি বাড়ে, সেটা অন্য যে কোনো পণ্যের তুলনায় সাধারণ মানুষের ওপর বেশি চাপ তৈরি করে। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি এখন আট শতাংশের বেশি। মনোয়ারা বেগম ঢাকায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। তার মতো গৃহ-শ্রমিকদের জন্য সরকারের কোনো মজুরি নীতি নেই। আলোচনার ভিত্তিতে প্রতিটি কাজের জন্য তিনি মাসে মাত্র সাড়ে ছয় শ’ করে টাকা পান। এলাকাভেদে এটি বেশিও হতে পারে। তিনি বলেন, ‘এক বাসায় কাজ করলে চলে না। তিনটা বাসায় কাজ করলে দুই হাজার টাকা পাই, তাতে বাসা ভাড়াও ওঠে না। তাই চারটা বাসায় কাজ করতে হয়। তারপরেও বাসা ভাড়া দিয়ে টেনেটুনেও সংসার চলে না।’
বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। সরকারি হিসাবে, জুলাই মাসে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ছিল সাত দশমিক ৪৮ শতাংশ। যদিও অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আরো বেশি। গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলছে, মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় চাপে পড়েছে গরীব মানুষ। আর তাই এ অবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণ করাই বাংলাদেশের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে শুধু বাংলাদেশই নয়, গত এক যুগের মধ্যে পুরো বিশ্বই এখন সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির সামনে আছে।
জ্বালানি ও ভোজ্য তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের চড়া দাম, মূল্যস্ফীতির চাপে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা আরো কঠিন করে তুলেছে। অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য ও দেশে অভ্যন্তরীণ উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়ে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।
তিনি আরো বলেন, ‘মানুষ পণ্য ব্যবহার কমিয়েছে। চাল, ডাল, তেল, চিনি কম ব্যবহার করছে। গরীব মানুষ হয়তো কম খেতে বাধ্য হচ্ছে। এমনকি শিশু খাদ্য নিয়েও সঙ্কটে পড়েছে বহু মানুষ।’

মনোয়ারা বেগমের স্বামী একটি ভবনের দারোয়ান হিসাবে কাজ করেন। তার মাসিক বেতন মাত্র আট হাজার টাকা। এই টাকায় তাদের বাড়িভাড়া, তিনটা সন্তানের পেছনে খরচ, চিকিৎসা খরচ আর খাবার-দাবারের পেছনে খরচ করতে হয়। গৃহকর্মী মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আগে সপ্তাহে দু’দিন মাছ বা মাংস খাইতাম। এখন সেটা মাসে দু’দিন হইছে।’
আশুলিয়ার একটি কারখানায় কাজ করে হাসিনা আক্তার। মজুরি আর ওভারটাইম মিলিয়ে তিনি সাড়ে ১১ হাজার টাকা আয় করেন। কিন্তু এতেও তার সংসার চলছে না। হাসিনা আক্তার বলেন, ‘অর্ধেক টাকা চলে যায় বাসা ভাড়ায়। তারপর নিজের খাওয়া, পোলাপানের পড়াশুনা, বাড়িতে টাকা পাঠানো। আর কুলাইতে পারতেছি না। সংসারের অনেক খরচ বাদ দিছি, তাও চলে না।’
রাজবাড়ীর একজন কৃষক হারুন অর রশিদ এখন প্রতিদিন প্রায় আট শ’ টাকা মজুরিতে কাজ করেন। কিন্তু তিনি জানেন, আর একমাস পরে তার কাজ থাকবে না। তিনি বলেন, ‘বছরের ছয় মাস কাজ থাকে আর ছয় মাস থাকে না। টাকা-পয়সা জমেও না কিন্তু সব জিনিসের দাম বাড়িতেছে।’ সূত্র : বিবিসি বাংলা




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com