আল্লাহ ইসলামের জন্য যার বক্ষ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, ফলে সে তার রবের দেয়া নূরের ওপর রয়েছে, (সে কি তার সমান, যে এরূপ নয়) অতএব দুর্ভোগ সে কঠোর হৃদয় ব্যক্তিদের জন্য, যারা আল্লাহর স্মরণে বিমুখ! তারা সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে। (সূরা আয-যুমার-২২) স্র্রষ্টার গোটা সৃষ্টিজগতই রহস্যঘেরা। তার মধ্যে সবচেয়ে রহস্যঘেরা বোধ হয় মানব হৃদয়। হৃদয় বা অন্তরের স্র্রষ্টা একে সৃষ্টি করেছেন স্বতন্ত্র ধর্মে। বান্দা তার রবকে ভুলে যায়। ডুবে যায় গোমরাহিতে। গুনাহের অতলতলে বুঁদ হয় উন্মত্ততায়। কিন্তু অন্তর সে তো ভিন্নভাবে ভিন্ন ফর্মুলায় তৈরি। হামেশাই আমাদের অভিযোগ আসে, আমার অন্তর পাথুরে হয়ে গেছে। কিন্তু! কেন? হৃদয় কঠিন হওয়ার প্রধান কারণ, দীর্ঘ সময় আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে থাকা। আল্লাহর থেকে দূরত্ব যত বেশি সে হৃদয়ের কাঠিন্য তত বেশি। আল্লাহবিমুখতা যখন দীর্ঘমেয়াদি হয়, ‘অতঃপর বহুকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পর তাদের অন্তরসমূহ কঠিন হয়ে পড়েছিল।’ (সূরা হাদিদ-১৬)
পবিত্র কালামুল্লাহ তিলাওয়াত হলো সবচেয়ে উত্তম জিকির। আর কালামুল্লাহর বাণীকে রব এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন, কঠিন হৃদয়ে তার বিস্ময়কর প্রভাবের দেখা মেলে। এ আর বলার অপেক্ষা রাখে না, আত্মার খোরাক এই কুরআন। যার প্রতি হরফে হরফে যেমন নেকি, তেমনি রয়েছে দুনিয়ার জীবনে কুরআনের বিস্ময়কর বহুমুখী কল্যাণ। বিদগ্ধ পাঠক যখন এর তিলাওয়াত করে, শ্রবণ করি যেই হোক তার হৃদয় বিগলিত তখন। কুরআন চিত্তকে আলোকিত করে। আঁধার মুছে প্রকৃত আলোকমালা হৃদয়ে গ্রোথিত করে। কুরআনের বর্ণমালার সুসমা দৃষ্টির আলোকে উন্নত করে। ঈমানকে করে শাণদার। মুমিন কখনো কুরআন থেকে দূরে গিয়ে প্রকৃত সুখ খুঁজে পায় না। ‘আল্লাহ উত্তম বাণী তথা কিতাব নাজিল করেছেন, যা সামঞ্জস্যপূর্ণ, পুনঃ পুনঃ পঠিত। এতে তাদের লোম কাঁটা দিয়ে উঠে চামড়ার উপর, যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করে, এরপর তাদের চামড়া ও অন্তর আল্লাহর স্মরণে বিনম্র হয়। এটিই আল্লাহর পথনির্দেশ, এর মাধ্যমে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন। আর আল্লাহ যাকে গোমরাহ করেন, তার কোনো পথপ্রদর্শক নেই।’ (সূরা আয-যুমার-২৩) কুরআনের প্রভাব সর্বকালে পাওয়া যায়। কঠিন হৃদয়ের মহৌষধ। আল্লাহ তায়ালা আরো ইরশাদ করেন, ‘আর তারা রাসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা যখন শুনে, তখন আপনি তাদের চোখ অশ্রুসজল দেখতে পাবেন এ কারণে যে, তারা সত্যকে চিনে নিয়েছে। তারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা মুসলমান হয়ে গেলাম। অতএব, আমাদেরও মান্যকারীদের তালিকাভুক্ত করে নিন। (সূরা মায়েদা-৮৩)
কুরআন মানুষের ভেতরকে যেমন সুন্দর করে তেমনি কুরআনের চর্চা এবং তদানুসারে আমল করলে বাহ্যিক সৌন্দর্যও বৃদ্ধি ঘটায়। যে সৌন্দর্য অন্যকে আকর্ষিত করার ক্ষমতা রাখে। ১০৪ খানা আসমানি কিতাবের থেকে মর্যাদাও প্রভাবে কুরআন একেবারে স্বতন্ত্র। কুরআন যেমন হৃদয়ের কাঠিন্য দূর করবে তেমনি জীবনের পঙ্কিলতাকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দেয়। আমরা একশ্রেণীর মানুষ বর্তমানে কুরআনকে শুধু তিলাওয়াতের কিতাব হিসেবে ধরে নিয়েছি। কিন্তু এ মহাগ্রন্থ যে শুধু তিলাওয়াতের জন্য নয়। সৃষ্টিজগত নিয়ে মহান উদ্দেশ্যে কুরআন লাওহে মাহফুজ থেকে নাজিল হয়েছে। কুরআনের সেই মহৎ উদ্দেশ্য সাধন হবে যখন তিলাওয়াতের পাশাপাশি কুরআন নিয়ে তাদাব্বুর তথা চিন্তা-ভাবনা করা হবে।
যান্ত্রিক ব্যস্ততম জীবনে সবাই এক ফোঁটা শান্তির পিছু হন্যে হয়ে ছুটি। অথচ এ পরম শান্তি আমাদের নিকটে। কুরআন থেকে গাফেল হওয়া আমাদের হৃদয়ের অসুখ বৃদ্ধি করে দেয়। হৃদয় করে কঠিন। ফলে অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। আত্মার খোরাককে যখন দূরে রাখা হয়। সে তো ছটফট করবেই।
সেসব হৃদয় উদ্দেশ্যে আল্লাহর ঘোষণা- ‘অতএব, দুর্ভোগ সে কঠোর হৃদয় ব্যক্তিদের জন্য, যারা আল্লাহর স্মরণবিমুখ।’ (সূরা আয-যুমার-২২) হৃদয়ের কাঠিন্যতা যদি কেউ উপলব্ধি করে সে অবশ্যই বুঝতে পারে, এই কাঠিন্য প্রান্তিক কোনো ব্যাপার নয়; বরং এই হালত অত্যন্ত পীড়ার। জীবনের স্বাদ বিনষ্টকারী। প্রকৃত সত্য এই, যে মানুষ তার রবকে ভুলে থাকতে পারলেও কলব তথা অন্তর তার রবের স্মরণ থেকে গাফেল হয়ে কখনোই শান্ত থাকে না। অপূর্ণতা নিয়ে সে বাঁচে। সে তড়পায়, চিৎকার করে মুক্তি খোঁজে, দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পালাতে চায়। কিছু আত্মা এভাবেই ধরাধাম ছাড়ে। সেই অন্তর তালাবদ্ধ! যেখানে কুরআনের স্পর্শ নেই, নেই কুরআনের তাদাব্বুর। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তবে কি তারা কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে না? নাকি তাদের অন্তরে তালা লাগানো আছে?’ (সূরা মুহাম্মদ-২৪) আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরো ইরশাদ করেন, ‘এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার কাছে নাজিল করেছি; যাতে মানুষ তার আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে এবং বুদ্ধিমানরা উপদেশ গ্রহণ করে।’ (সূরা সোয়াদ-২৯)
সমস্যা যখন হৃদয়ে, সমাধান কুরআনে। বুদ্ধিমানরা অবশ্যই তা বুঝে নেয়। ভেতর ও বাইরের সমাধান যখন এই কিতাবে তখন আর দেরি কেন? এই বিলম্ব দূরত্বের অপঘাত থেকে নিজেকে বের করুন। নিন এক শুদ্ধতম জীবনের স্বাদ। রবের সাথে সম্পর্ক মজবুত করার এ সুযোগ সবার সামনে সমানভাবে উন্মুক্ত। লেখক : শিক্ষার্থী, কামিল হাদিস বিভাগ, ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মদরাসা, চাঁদপুর