টানা বর্ষণ আর জোয়ারের পানিতে প্রতিদিনই ডুবছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও উপজেলার নিম্নাঞ্চলগুলো। খাতুনগঞ্জ ও আগ্রাবাদের মতো বাণিজ্যিক এলাকা যেমন প্লাবিত হচ্ছে, একইভাবে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বাঁশখালী, হাটহাজারীসহ বেশ কয়েকটি উপজেলার অন্তত ১০টি গ্রামের লোকজন।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ শেখ ফরিদ বলেন, ‘অমাবস্যার কারণে অতি জোয়ারে কর্ণফুলী, হালদাসহ শাখা নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া উত্তর পশ্চিম বঙ্গোসাগর ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপকূলীয় পশ্চিম বঙ্গোপসাগর এলাকায় সৃষ্ট লঘুচাপ একই এলাকায় সুস্পষ্ট লঘুচাপ আকারে অবস্থান করছে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোসাগরে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় রয়েছে এবং বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্য বিরাজ করছে।’
তিনি বলেন, ‘সুস্পষ্ট লঘুচাপের প্রভাব ও বাংলাদেশের ওপর মৌসুমি বায়ু সক্রিয়া থাকার কারণে চট্টগ্রাম ও আশপাশের এলাকায় হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এ কারণেও নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হচ্ছে।’
এদিকে অমাবস্যায় অতি জোয়ারে গত চারদিন ধরে নগর বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদ ও খাতুনগঞ্জসহ বেশকিছু এলাকা হাঁটুপানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন নগরবাসী। জোয়ারের পানিতে আগ্রাবাদ কমার্স কলেজ রোড, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সামনের রাস্তা, মা ও শিশু হাসপাতালের নিচতলা, জাম্বুরি মাঠের দুইপাশ পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। পাশাপাশি দেশের সবচেয়ে বড় খাদ্যপণ্যের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ, পাথরঘাটা, আছাদগঞ্জ শুঁটকি পট্টি, রশিদ বিল্ডিং এলাকায়ও জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিবছর জোয়ারের পানির উচ্চতা বাড়ছে। ভারী বৃষ্টি ছাড়াই খাতুনগঞ্জের নিম্নাঞ্চল জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। চাক্তাইয়ের চালপট্টি, শুঁটকিপট্টি, মকবুল সওদাগর রোড এবং আছাদগঞ্জ ও তার আশপাশের নিম্নাঞ্চল জোয়ারে হাঁটু পানিতে ডুবে যায়। এ সময় বেচাকেনা বন্ধ করে ব্যবসায়ীরা মালামাল রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়।
শাহ আমানত এন্টারপ্রাইজের মালিক আব্দুর রহিম বলেন, ‘জোয়ারের সময় পানি আটকে দিতে চাক্তাই খালের মুখে একটি স্লুইস গেট বসানোর কাজ দুই বছর আগে শুরু করে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। কিন্তু সে কাজ এখনো শেষ হয়নি। খালের মুখে বাঁধ দিয়ে কাজ চলছে। ফলে জোয়ারের পানি ঢুকলেও ভাটার সময়ে দ্রুত পানি সরে যেতে না পারায় পানিবদ্ধতা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। এ অবস্থায় ভারী বর্ষণ হলে পুরো চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ ও আছাদগঞ্জ তলিয়ে যায়।’
এদিকে হালদা নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিদিনই ডুবছে হাটহাজারী উত্তর মাদার্শা, মদুনাঘাট এবং নগরের চান্দগাঁও থানার মোহরা ও আশপাশের এলাকা।
মোহরা এলাকার বাসিন্দা হাজি নাসির উদ্দিন বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে হালদা নদীর পানি বেড়ে মোহরার হামিদচরসহ বেশকিছু এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে। জোয়ারের পানিতে রাস্তাঘাট ডুবে বাসাবাড়িও তলিয়েছে।’
এদিকে বাঁশখালীতে জোয়ারের পানিতে চারটি ইউনিয়নের অন্তত পাঁচটি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। অমাবস্যার ফলে সাগরের পানি বৃদ্ধি পেয়ে বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন বাঁশখালীর উপকূলীয় ছনুয়া ইউনিয়নের আবাহালী ও ৬০ নম্বর পাড়া, খানখানাবাদ ইউনিয়নের সুন্দপি পাড়া, শেখেরখীল ইউনিয়নের ৩ নম্বর ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডে জোয়ারের পানি প্রবেশ করেছে। এছাড় শীলকূপ ইউনিয়নের হেডপাড়া এলাকায় জোয়ারের পানি প্রবেশ করে কাঁচা বাড়িঘরের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ওই এলাকার হাজার হাজার মানুষ। জলকদরে জোয়ারের পানির তোরে ভেঙে গেছে স্লুইস গেট।
স্থানীয়দের আশঙ্কা, অতিদ্রুত স্লুইস গেটে বাঁধ নির্মাণ করা না হলে রাতের জোয়ারে বিলীন হয়ে যাবে হেডপাড়ার নিম্নাঞ্চলসহ আশপাশের মনকিচর এলাকা। সড়কের মাঝ বরাবর ভেঙে যাওয়ায় পশ্চিম মনকিচরের সঙ্গে জালিয়াখালী বাজারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এতে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়বে।
স্থানীয় মাছ চাষি সাহাব উদ্দিন বলেন, ‘জোয়ারের পানিতে আমার পাঁচটি মাছের প্রজেক্ট তলিয়ে গেছে। এতে মাছের পোনাসহ প্রায় ৩৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।’
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য সিদ্দিক আকবর বাহাদুর বলেন, ‘ডাকবাংলো সড়ক দিয়ে কয়েক হাজার মানুষের চলাচল করেন। জোয়ারের পানিতে সড়কের বিভিন্ন অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। জোয়ারের পানি প্রবেশ ঠেকাতে না পারলে মনকিরচর নতুন বাজার, শিলকুপ ইউনিয়ন পরিষদ, বাঁশখালী বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়, স্থানীয় মসজিদসহ অনেক ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে যাবে।
এদিকে পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামের আকাশ মেঘলা থেকে অস্থায়ীভাবে মেঘাচ্ছন্ন থাকতে পারে। সেইসঙ্গে বেশিরভাগ জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা কিংবা ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। উত্তর বঙ্গোসাগরে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় রয়েছে এবং বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্য বিরাজ করছে।
উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্র বন্দরসমূহের ওপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। এ কারণে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত ও নদীবন্দরের জন্য এক নম্বর নৌ-সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
রাত ও দিনের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে। দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্ব দিক হতে ঘণ্টায় ১২-১৫ কিলোমিটার বেগে যা অস্থায়ী দমকা কিংবা ঝড়ো হাওয়া আকারে সর্বোচ্চ ৩৫-৪০ কিলোমিটার বেগে প্রবাহিত হতে পারে।
এমআইপি/প্রিন্স