তিন কারণে গম, চিনি, মসুর ও মটর ডালের আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন আমদানিকারকেরা। আমদানি কমার পাশাপাশি বাজারে চাহিদাও কমেছে। চার নিত্যপণ্যের আমদানি কমেছে ৩৮ কোটি কেজি।
চার মাস ধরে বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম কমছে। তাতে কোনো কোনো পণ্যের দাম রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরেছে। বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশে ভোজ্যতেল ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় চার পণ্যের আমদানি কমে গেছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-২৬ সেপ্টেম্বর) এসব পণ্যের আমদানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ বা ৩৮ কোটি কেজি। আমদানি কমে যাওয়া চার পণ্য হলো গম, চিনি, মসুর ও মটর ডাল। দেশে এসব পণ্যের উৎপাদন কম, তাই চাহিদা মেটাতে আমদানি করতে হয়। এসব পণ্যের আমদানি কমে যাওয়ার জন্য ব্যবসায়ীরা কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, ডলারের দামে অস্থিরতার কারণে আমদানি করা পণ্য বিক্রি করে মূলধন তুলতে পারবেন কি না, এ অনিশ্চয়তা থেকে আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, বিশ্ববাজারে দাম কমতির দিকে থাকায় ক্রয়াদেশ দেওয়ার পর পণ্যের দাম আরও কমে যায় কি না এবং তাতে লোকসানের শঙ্কায় আমদানি কম করেছেন। তৃতীয়ত, ডলার-সংকট ও ঋণপত্র খুলতে বিলম্বের কারণেও আমদানি কমেছে। নিত্যপণ্যের আমদানি যেমন কমেছে, তেমনি বাজারে চাহিদাও কমেছে। সে জন্য বাজারে কোনো সংকট নেই। তবে ভারত গম রপ্তানিতে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার না করলে গমসহ কয়েকটি পণ্য আমদানিতে আগাম কিছু ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তাহলে ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হবে না।
আমদানি কমলেও দেশে সরবরাহ-সংকট দেখা দেওয়ার কোনো শঙ্কা নেই বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তাঁদের মতে, বাজারে চাহিদা কিছুটা কমেছে। আবার বিশ্ববাজারে দাম কমে যাওয়ায় সামনে আমদানি আরও বাড়বে। নিত্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নিত্যপণ্যের আমদানি যেমন কমেছে, তেমনি বাজারে চাহিদাও কমেছে। সে জন্য বাজারে কোনো সংকট নেই। তবে ভারত গম রপ্তানিতে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার না করলে গমসহ কয়েকটি পণ্য আমদানিতে আগাম কিছু ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তাহলে ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হবে না।
চার পণ্যের আমদানি কমেছে ২১ শতাংশ: চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমদানির তথ্য অনুযায়ী, গম, চিনি, মসুর ও মটর ডালÍএই চার পণ্য আমদানি হয়েছে ১৪ লাখ ৩১ হাজার টন বা ১৪৩ কোটি কেজি। গত অর্থবছরের একই সময়ে এসব পণ্য আমদানি হয়েছিল ১৮ লাখ ১৫ হাজার টন বা ১৮১ কোটি কেজি; অর্থাৎ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গত তিন মাসে চার পণ্যের আমদানি কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ বা ৩৮ কোটি কেজি।
বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও ডলারের উচ্চ মূল্যের কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আবার গ্যাস-সংকটে কারখানার নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে, তাতে বাড়ছে উৎপাদন খরচ। ডলারের দাম কমলে ভোক্তারা আরও বেশি সুফল পেতেন। আমদানি কমার তালিকায় শীর্ষে রয়েছে মটর ডাল। পণ্যটির আমদানি কমেছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। গত অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মটর ডাল আমদানি হয়েছিল ১ লাখ ৫১ হাজার টন। এবার আমদানি ৮২ হাজার টন। মসুর ডালের আমদানিও কমেছে ৩১ শতাংশ। সোয়া লাখ টন আমদানি হয়েছিল গত অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে, এবার তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮৬ হাজার টনে। গমের আমদানি কমেছে ২৫ শতাংশ। গত অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে গম আমদানি হয়েছিল ১০ লাখ টন। এবার তা কমে ৭ লাখ ৫৮ হাজার টনে দাঁড়িয়েছে। চিনি আমদানি অবশ্য সামান্য কমেছে। আগের বছরের তুলনায় পাঁচ শতাংশ কমে চিনি চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে আমদানি হয়েছে পাঁচ লাখ টন।
ভোজ্যতেল আমদানি ২৫% বেড়েছে: ভোজ্যতেল পাম ও সয়াবিনের আমদানি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১ লাখ ১৭ হাজার টন বা ২৫ শতাংশ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার টন। গত অর্থবছরে একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ১ লাখ ২৫ হাজার টন। সেই হিসাবে সয়াবিন তেল আমদানি বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। একইভাবে পাম তেল আমদানিও ১৮ শতাংশ বেড়ে ৩ লাখ ৯৭ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে।
আমদানি খরচ বাড়তি: বিশ্ববাজারে দাম সংশোধনের পরও চলতি অর্থবছরে প্রথম তিন মাসে উল্লিখিত ছয়টি পণ্য আমদানিতে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি খরচ হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সয়াবিনের আমদানি খরচ বেড়েছে ৩৪ শতাংশের বেশি। একইভাবে চিনি, পাম তেল, মসুর ও মটর ডালের আমদানি মূল্যও গত বছরের তুলনায় বেশি।
বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম এখন পড়তি। কিন্তু দেশে তার খুব বেশি সুফল মিলছে না। কারণ, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। মে মাসে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৭ টাকা। তাতে সয়াবিন তেল আমদানিতে প্রতি কেজিতে খরচ পড়েছে ১৫৮ টাকা। এখন আমদানির ক্ষেত্রে ডলারের দাম গড়ে ১০৬-১০৮ টাকা। তাতে প্রতি কেজিতে খরচ পড়ছে ১৬২ থেকে ১৬৫ টাকা।
জানতে চাইলে টিকে গ্রুপের পরিচালক মো. শফিউল আথহার তাছলিম প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও ডলারের উচ্চ মূল্যের কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আবার গ্যাস-সংকটে কারখানার নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে, তাতে বাড়ছে উৎপাদন খরচ। ডলারের দাম কমলে ভোক্তারা আরও বেশি সুফল পেতেন।