বাংলাদেশে কয়েক বছর যাবত সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে সরকার নানা ধরণের নিয়মকানুন আরোপ করেছে। সুদের হারেও এসেছে নানা পরিবর্তন। সরকারের এ ধরনের ব্যবস্থার পেছনে প্রধানত দু’টি কারণ উঠে এসেছে। প্রথমত, সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ সরকারকে বিপুল টাকা খরচ করতে হয়। জনগণের করের টাকা থেকে এই সুদের টাকা পরিশোধ করা হয়। সেজন্য সরকার চাচ্ছে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কম হলে সুদ বাবদ পরিশোধও করতে হবে কম।
দ্বিতীয়ত, সরকার চায় মানুষ সঞ্চয়পত্র ক্রয় না করে সেই টাকা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করুক। গত ৩ অক্টোবর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সে কথা পরিষ্কার করে বলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর বলেন, আমরা চাই মানুষ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ না করে ক্যাপিটাল মার্কেটে আসুক। সঞ্চয়পত্র থেকে মানুষজনকে টেনে শেয়ার বাজারে আনার জন্য সরকার ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমানো হয়েছে।
সঞ্চয়পত্র সরকারের জন্য একটি ‘উভয় সঙ্কট’ তৈরি করেছে। বিক্রি কমাতে লাগাম টেনে ধরলে সাধারণ মানুষ নাখোশ হয়। আবার সেটি না করলে সুদ বাবদ সরকারকে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধাপের জন্য ভিন্ন-ভিন্ন সুদের হার করা হয়েছে। এছাড়া পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে হলে বিনিয়োগকারীকে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দিতে হবে।
মানুষ শেয়ার বাজারে যাবে? গত কয়েক বছরে স য়পত্রকে অনলাইন সিস্টেমের আওতায় আনা হয়েছে। এর ফলে সর্বোচ্চ সীমার অতিরিক্ত সঞ্চয়পত্র ক্রয় করা এখন সম্ভব নয়।
অনলাইন সিস্টেমের আওতায় না থাকার কারণে অতীতে অনেকে সঞ্চয়পত্রের অপব্যবহার করেছে। অনেকে ইচ্ছে মতো সঞ্চয়পত্র ক্রয় করেছিল। কিন্তু অনলাইন হওয়ার ফলে সে সুযোগ আর নেই। বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে টাকা বিনিয়োগ করে অতীতে অনেকে নিঃস্ব হয়েছে। সরকার উৎসাহ দিলেও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের ওয়েব সাইটে সতর্ক করা হচ্ছে- পুঁজিবাজার ঝুঁকিপূর্ণ। জেনে ও বুঝে বিনিয়োগ করুন।
ফলে সঞ্চয়পত্র যতই নিরুৎসাহিত করা হোক না কেন, মানুষ সেখান থেকে টাকা নিয়ে শেয়ার বাজারে কতটা যাবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সঞ্চয়পত্রে উচ্চ সুদের হার থাকলে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে আগ্রহী হয় না।
অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বিবিসি বাংলাকে বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে পুঁজিবাজার যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে, সেখানে বিনিয়োগ করা তাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। সেখানে বিভিন্ন রকম অনিয়মের কথা আমরা শুনতে পাই।
তিনি বলেন, শেয়ার বাজার যদি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে চলত তাহলে স্বল্প পুঁজির মানুষও সেখানে বিনিয়োগ করতে পারত। যারা মধ্যম এবং উচ্চ আয়ের মানুষ আছে তাদের জন্য বন্ড মার্কেট কিভাবে প্রমোট করা যায় সেটিও চিন্তা করতে হবে। সেটা সরকারি কিংবা বেসরকারি যে কোনো ধরণের বন্ড হতে পারে।
সঞ্চয়পত্র কার লাভ, কার ক্ষতি? সরকারের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে কম খরচে অর্থের সংস্থান করা। সেজন্য সবচেয়ে ভালো হচ্ছে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়ানো। রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে সরকারি ব্যয় নির্বাহ করতে পারলে ঋণ নেয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশের ক্ষেত্রে রাজস্ব আদায়ে অনেক ঘাটতি থাকে। ফলে সরকার ঋণ করতে বাধ্য হয়। এজন্য সরকার বিদেশ থেকে যেমন ঋণ নেয় তেমনি দেশের ভেতর থেকেও ঋণ নেয়। দেশের ভেতর থেকে সরকার দু’ভাবে ঋণ গ্রহণ করে। একটি হচ্ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে এবং অন্যটি হচ্ছে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ঋণের সুদ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৮০ হাজার কোটি টাকা। ৭৩ হাজার কোটি টাকা যাবে অভ্যন্তরীন ঋণের সুদ পরিশোধে। সাত হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে বিদেশী ঋণের সুদ পরিশোধে। এর মধ্যে একটি বড় অংকের টাকা খরচ হবে সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধ বাবদ।
অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকার যদি বাণিজ্যিক দিক থেকে চিন্তা করে তাহলে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া সরকারের জন্য লাভজনক। কারণ ব্যাংক ঋণে সুদের হার কম কিন্তু সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বেশি। তবে সরকার যদি ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নেয় তাহলে সেটি বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এখন হয়তো বেসরকারি খাত বড় ধরণের বিনিয়োগে যাচ্ছে না। সেজন্য ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার কারণে বেসরকারি খাতের ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে না। কিন্তু সরকার শুধু বাণিজ্যিক চিন্তা করলেই হবে না। সঞ্চয়পত্রের একটি সামাজিক নিরাপত্তার দিকও আছে।
সঞ্চয়পত্রে উচ্চ সুদ দিয়ে সমাজের বিশেষ বিশেষ জনগোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করে সরকার। যার মধ্যে রয়েছে নারী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারী, সিনিয়র সিটিজেন এবং প্রতিবন্ধী।
সামাজিক চিন্তা করে সরকার ‘মিশ্র পদ্ধতিতে’ ঋণ নেয় বলে উল্লেখ করেন অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সূত্র : বিবিসি