১৩ অক্টোবর ১৯৭১। সেই ভয়াল দিন। যে দিন কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার বড়ইতলা নামক স্থানে ইতিহাসে সবচেয়ে কাপুরুষোচিত ও নৃশংস নারকীয় হত্যাযজ্ঞটি সংঘটিত হয়েছিল নিরস্ত্র ও মুক্তিকামী ৪ শতাধিক মানুষের উপর। এ ঘটনায় নিহত হয় ৩শত ৬৫ জন। যা কিশোরগঞ্জ জেলার ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ দুঃসময়ের স্মৃতি নিয়ে আহত ও পঙ্গুত্বের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে আজও। জেলা সদরের দক্ষিণ পূর্ব দিকে হাওর অভিমুখে চলে গেছে কিশোরগঞ্জ নিকলী সড়ক। এ পিচ ঢালা পথ ধরেই প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার গেলেই যশোদল ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নে বড়ইতলা (বর্তমান শহীদ নগর) রেল ক্রসিং থেকে কিছু দূরে কিশোরগঞ্জ নিকলী সড়কের বাম পাশে কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের শেষ সীমানা। কালো অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে লাল বেদির উপর একটি স্মৃতি স্তম্ভ। ১৯৭১ সনের ১৩ অক্টোবর পাক সেনা ও তাদের দোসরদের নৃশংস অত্যাচারে চিকনীরচর, গোবিন্দপুর, দামপাড়া, তিলকনাথপুর, ঘাগৈর ও কালিকাবাড়ি গ্রামের নিরপরাধ শান্তিপ্রিয় মানুষ স্বাধীনতার বেদী মূলে জীবন উৎসর্গ করেছিল তারই জ্বলন্ত এক প্রতিবাদ এই শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ। স্তম্ভের শ্বেত পাথরের ফলকে খোদাই করা আছে উচ্ছ্বাসময় মিনতি ভরা উদাত্ত আহবান “দাঁড়াও পথিক বর- জন্ম যদি তব বঙ্গে তিষ্ঠ ক্ষণকাল- এ সমাধি স্থলে” শহীদের স্মারণে নির্মিত এ স্তম্ভটির গায়ে কোন কারুকার্য নেই। দেশে জাতীয়ভাবে নির্মাণ করা কোন স্মৃতি সৌধের সাথে এর কাঠামোগত কোন মিল নেই। তবু স্থানীয় এলাকাবাসীর কাছ এ স্তম্ভটি মুক্তিযুদ্ধের শ্বাশ্বত চেতনা। এখানে সংঘটিত ঘটনাগুলো যেমনি মর্মান্তিক তেমনি ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল। যশোদল এলাকায় স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম স্থপতি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি (মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন সময়ে) শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের গ্রামের বাড়ী। ফলে পাকহানাদার ও স্থানীয় রাজাকারদের শ্যেন দৃষ্টি ছিল এ এলাকাটির উপর। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে এলাকার দামাল ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠন করতে শুরু করে। “বড়ইতলা গণহত্যার” প্রত্যক্ষদর্শী এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আজিজুল হক মাস্টার, আজিম উদ্দিন হাই স্কুলের প্রাক্তন সিনিয়র শিক্ষক এ প্রতিনিধিকে জানান, এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে তৎপরতা শুরু হওয়ার পর পরই রাজাকার ও আলবদরদের মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে উঠে। আর এরই প্রথম শিকার হয় দামপাড়া গ্রামের নরেন্দ্র চন্দ্র সরকার ও তার বড় ভাই সুরেন্দ্র চন্দ্র সরকার। কর্শ্বাকড়িয়াইল ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুর রশীদ নিনু মিয়ার ইঙ্গিতে কয়েকজন রাজাকার এসে উল্লিখিত দুই ভাইকে ডাক বাংলাতে নিয়ে যায়। ঐ দিন সন্ধ্যায় হত্যার উদ্দেশ্যে দুই ভাইকে গচিহাটা রেল ব্রীজে নিয়ে যাওয়া হয়। ছোট ভাই সূরেন্দ্র চন্দ্র সরকার গাড়ী থেকে লাফ দিয়ে জীবন রক্ষা করে। কিন্তু বয়োবৃদ্ধ নরেন্দ্রের ভাগ্যে ঘটে মৃত্যুর হিমশীতল ছোঁয়া। এর কিছুদিন পরেই মুক্তিযোদ্ধারা এক রাজাকারকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। এ ঘটনার পর ১৩ অক্টোবর বুধবার গাড়ি ভর্তি পাকসেনারা অজ্ঞাত শক্তির ইঙ্গিতে গ্রামটিকে দুদিক থেকে ঘিরে ফেলে। প্রথমে এলোপাথারি গুলি বর্ষণের মাধ্যমে গ্রামবাসীর মনে ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। এলোপাতাড়ি গুলি বর্ষণের ফলে আব্দুল মান্নান, গুরুদয়াল সরকার, কডু নমদাস গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। কুখ্যাত রাজাকার মৌলানা হাফিজ উদ্দিন প্রায় ৪ শতাধিক গ্রামবাসীকে একত্রিত করে নিয়ে যায় বড়ইতলায়। এর কিছুক্ষণ পরেই অধিনায়ক মেজর ইফতেখারের নির্দেশে পাকবাহিনীর সদস্যদের গণনা করা হয়। হিসাবে এ সময়ে একজন মিলিশিয়াকে কম পাওয়া যায়। এরপর চিকনীরচর গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার আবুল হাশেম, পিতা- মফিজ উদ্দিন হাজী মিথ্যা খবর দেয় যে, মুক্তিযোদ্ধারা এক পাকসেনাকে মেরে ফেলেছে। একথা শুনা মাত্র পাঞ্জাবী অধিনায়ক হুঙ্কার দিয়ে দুশমনদের খতম করে দিতে বলে। মুহুর্তেই শুরু হয়ে যায় রক্তের হোলিখেলা। চারদিকে শুরু হয় কালেমা তায়্যেবার সুস্পষ্ট উচ্চারণ। প্রত্যক্ষদর্শী আজিজুল হক মাস্টারের বর্ণনায় কালেমা তায়্যেবার উচ্চারণ ছাপিয়ে নিরীহ নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ও সবশেষে চালানো হয় মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ার। এ ঘটনার পর আজিজুল হক মাস্টার এবং কর্শ্বাকড়িয়াইল ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম নুরুর নেতৃত্বে বড়ইতলায় একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়। নিহতদের ভাগ্যে জীবনের শেষ প্রাপ্তি জানাযা ও কবর জুটেনি অনেকের ভাগ্যে বরং ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল অজানার উদ্দেশ্যে নরসুন্দার জলে। এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা এ হত্যাকান্ডের জন্য যাদেরকে দায়ী করেছে তাদের মধ্যে মৌলানা হাফিজ উদ্দিন, মৌলানা আব্দুস সাত্তার, আব্দুর রশীদ নিনু মিয়া, আবুল হাসেম প্রমুখ। প্রত্যক্ষদর্শী যাদেরকে এই গণহত্যার সাথে জড়িত বলে জানিয়েছেন, সেই ঘাতকদের আজও কোন বিচার হয়নি। বরং তারা দাপটের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে শহীদ নগরে প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে।