আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যে আইএমএফ ঋণ দেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছে বাংলাদেশকে। ধারণা করা যাচ্ছে, আগামী বছরের শুরুতেই ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়া যাবে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ঋণ পাওয়ার ব্যাপারে সরকার যেভাবে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং আইএমএফের দেওয়া শর্ত যদি মেনে নেয়, তাহলে আগামী বছরের শুরুতেই ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়া সম্ভব। তবে সরকার যদি শর্ত পরিপালনে বেশি আন্তরিকতা দেখায়, তাহলে চলতি বছরের শেষ নাগাদ অর্থাৎ ডিসেম্বরেও প্রথম কিস্তি পাওয়ার সুযোগ আছে।’
তিনি উল্লেখ করেন, আগামী ২৬ অক্টোবর দেশে আসছে আইএমএফের প্রতিনিধি দল। এ সময় ঋণ দেওয়ার শর্ত নিয়ে আলোচনা করবেন তারা। এই প্রতিনিধি দলের রিপোর্টের ওপর নির্ভর করছেÍ কতদিন-নাগাদ ঋণ পাওয়া যাবে। তবে আইএমএফের ঋণ নিয়ে কাজ করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে চুক্তিটি সম্পন্ন করে জানুয়ারিতে আইএমএফের বোর্ড সভায় উপস্থাপনের জন্য লক ইন করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আইএমএফের প্রতিনিধি দল আগামী ২৬ অক্টোবর দেশে আসছে। তারা ফিরে গিয়ে যে প্রতিবেদন জমা দেবে, সেই প্রতিবেদন উঠবে আইএমএফের বোর্ডে। এরপরেই ঋণ পাওয়া যাবে। তবে কবে নাগাদ ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়া যাবে, নির্দিষ্ট করে তা বলা মুশকিল।’
উল্লেখ্য, বর্তমানে যে ভ্যাট আইন চালু রয়েছে, সেটা সরকার করেছে মূলত আইএমএফের শর্তের কারণে। এক দশক আগে আইএমএফ থেকে সাত কিস্তিতে প্রায় ১০০ কোটি ডলার বর্ধিত ঋণ সহায়তা (ইসিএফ) নিয়েছিল বাংলাদেশ। বিপরীতে অন্যতম শর্ত ছিল ভ্যাট আইন করা।
জানা গেছে, ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়ার শর্ত নিয়ে আলোচনা করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি দল বাংলাদেশ সফরে আসবে ২৬ অক্টোবর। ১০ দিনের জন্য ঢাকায় এসে দলটি বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে বৈঠক করবে।
এদিকে আইএমএফ থেকে ঋণ পাওয়ার মৌখিক আশ্বাস পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। গত রবিবার (১৬ অক্টোবর) যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের গভর্নর বলেন, ‘আইএমএফ মৌখিকভাবে আশ্বাস দিয়েছে যে, তারা আমাদের ঋণ দেবে। আলাদাভাবে বিশ্বব্যাংক থেকে ১০০ কোটি ডলার পাওয়া যাবে। তবে ঋণ দিতে বাংলাদেশকে নানামুখী শর্তও দেবে আইএমএফ ।’
এর আগে গত জুলাই মাসে আইএমএফের কাছে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানায় বাংলাদেশ। গত ২৪ জুলাই আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভাকে লেখা এক চিঠিতে ঋণের অনুরোধ জানানো হয়।
সরকার অর্থনৈতিক ভারসাম্য এবং বাজেট সহায়তার পাশাপাশি বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমিত করার জন্য এই অর্থ চাওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, মোট সাড়ে ৪ বিলিয়ন ঋণ চাওয়া হয়েছে, যার মধ্যে দেড় বিলিয়ন সুদমুক্ত হবে এবং বাকি ঋণ ২ শতাংশের কম সুদে আসবে। এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করতেই আগামী সপ্তাহে আইএমএফের দলটি বাংলাদেশে আসবে বলে বলে আশা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, ৪৫০ কোটি ডলারের মধ্যে লেনদেনের ভারসাম্য বাবদ ১৫০ কোটি ডলার ও বাজেট-সহায়তা বাবদ ১৫০ কোটি ডলার পাওয়া যেতে পারে। বাকি ১৫০ কোটি ডলার আইএমএফের নতুন উদ্যোগ, সহনশীলতা ও টেকসই সহায়তা তহবিল থেকে পাওয়া যেতে পারে। তুলনামূলক সহজ শর্তে এই ঋণ পাওয়া যাবে। তবে লেনদেন ভারসাম্য ঠিক রাখতে দেওয়া ঋণের শর্ত তুলনামূলক কঠিন হতে পারে।
আহসান এইচ মনসুরের মতে, এমনিতেও সরকারের উচিত ব্যাংক খাত ও রাজস্ব খাতের সংস্কার করা। আইএমএফ হয়তো এই দুটি বিষয়কে শর্ত হিসেবে প্রস্তাব করবে।
ওয়াশিংটনে গত ১০-১৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেন আব্দুর রউফ তালুকদার। বার্ষিক সভার বাইরে তিনি আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আন্তইনেত এম সায়েহ এবং সংস্থাটির এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দের সঙ্গে বৈঠক করেন। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশীয় বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজারের সঙ্গেও পৃথক বৈঠক করেন তিনি।
দুই বৈঠকের পরই মূলত আইএমএফের মৌখিক আশ্বাস ও ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের কী কী শর্ত, তা বাংলাদেশি সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন আব্দুর রউফ তালুকদার।
শর্তের বিষয়ে আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, আইএমএফ চায় বাংলাদেশের রাজস্ব প্রশাসনের আধুনিকায়ন হোক। রাজস্ব সংগ্রহ কার্যক্রম গতিশীল হোক। ব্যাংক খাতে বর্তমানে উচ্চমাত্রার খেলাপি ঋণ রয়েছে। আইএমএফ চায় এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরুক। করপোরেট সুশাসন বলিষ্ঠ হোক।
উল্লেখ্য, এর আগে আইএমএফের প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসেছিলেন। তারা আলাদাভাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে শুরু করে অর্থ বিভাগ, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। সেসময় সার্বিক অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। সরকারের ভর্তুকি কমাতে নানা উদ্যোগ নিয়েও আলোচনা হয়।
জানা যায়, ঋণ পাওয়ার অংশ হিসেবে আইএমএফের সম্ভাব্য শর্ত পূরণে ইতোমধ্যে সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। যেসব উদ্যোগ শিগগিরই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়, সেগুলো নিয়ে আইএমএফের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনা হবে।
সূত্র বলছে, কর-জিডিপি অনুপাত এখনও ৮ শতাংশই ছাড়িয়ে যেতে পারেনি বাংলাদেশ। এ হার শিগগিরই উন্নীত করে ফেলতেও বলবে না আইএমএফ। তবে কোন বছরে কতটা উন্নীত করবে- বাংলাদেশের কাছে তার একটা সময়ভিত্তিক পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন চাইবে সংস্থাটি। সরকার ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে একটি পরিকল্পনা তৈরিও করেছে বলে জানা গেছে।
এছাড়া আইএমএফ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনার হিসাব ঠিক করতে বলবে এবং আয়কর আইন ও শুল্ক আইন পাস করার শর্ত দেবে। এর বাইরে তৃণমূল পর্যায়ে কর আদায়ের প্রশাসনকে ছড়িয়ে দিতে এবং কর প্রশাসনকে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার মধ্যে আনতে শর্ত দিতে পারে।