চাঁদপুরে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইলিশ ধরার অপরাধে ২৪ ঘণ্টায় অভিযানে ৪১ জেলেকে আটক করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার (২১ অক্টোবর) সকালে চাঁদপুর নৌ-পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামরুজ্জামান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, অভয়াশ্রম এলাকার পদ্মা-মেঘনা মোহনাসহ সদর উপজেলার রাজরাজেশ্বর, পুরাণবাজার, লক্ষ্মীচর, চিরারচর, আনন্দবাজার, ইব্রাহিমপুর, লক্ষ্মীপুর, হানাচরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুক্রবার ভোর পর্যন্ত ৪১ জেলেকে আটক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৯ জনের বিরুদ্ধে মৎস্য আইনে একটি নিয়মিত মামলা করা হয়েছে। বাকি ১৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেয়া হয়। এছাড়া তিনজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় তাদের অভিভাবকের জিম্মায় মুক্তি দেয়া হয়েছে। এ সময় মালিকবিহীন প্রায় দেড় কোটি মিটার জাল জব্দ করা হয়। ৯ হাজার ২০০ মিটার জাল মামলার আলামত হিসেবে নৌ থানা হেফাজতে রয়েছে। ৯টি ইঞ্জিনচালিত কাঠের তৈরি জেলে নৌকাও জব্দ করা হয়। এর মধ্যে চারটি নৌকা পানিতে ডুবিয়ে অকার্যকর করা হয়েছে। অবশিষ্ট পাঁচটি নৌকা মামলার আলামত হিসেবে নৌ থানায় রাখা হয়। এছাড়া ১৫১ কেজি ইলিশ মাছ জব্দ করা হয়। এর মধ্যে ২৪ কেজি হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়। অবশিষ্ট ১২৭ কেজি ইলিশ মাছ স্থানীয় এতিমখানায় বিতরণ করা হয়। প্রসঙ্গত, ৭ অক্টোবর থেকে আগামী ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন নদীতে সব ধরনের মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার।
আমতলী (বরগুনা): নদীতে মাছ ধরা বন্ধ। মোগো আর কোন কামাই নাই। সরকারি চাউল এহনো পাই নাই। টাহার অভাবে আড বাজার বন্ধ। ঠিকমত তিন বেলা ভাত খাইতে পারি না। গত দুই বেলা ভাত খাই নাই। আইজ দুহারে ধার কইর্যা চাল ডাল আর আলু আনছি। হেই ডাল আর আলু সিদ্ধ করে খামু। ছোড একটা মাইয়া আছে হ্যারে দুধ কিন্যা খাওয়াইতে পারি না। প্যাডের ক্ষিদায় খালি চিড়ায়।
মাইয়াডার কান্দা দ্যাখলে চোহে পানি আহে। কি করমু। যেহানে মোরা ঠিক মত তিন বেলা খাইতে পারি না হেহানে অর দুধ কিনমু কি দিয়া? এভাবে কষ্টের কথাগুলো বলছিলেন জেলে শহীদুল ইসলাম হাওলাদার।
কাইল রাইতে আর আইজ বেইন্যাকালে ভাত খাই নাই, পোলামাইয়া লইয়া না খাইয়া রইছি। দ্যার শ্যাড় চাউল আর দুইডা আলু ধার কইর্যা আনছি। হেইয়া রাইন্দা পোলা মাইয়া লইয়া দুহারে খামু। কথাগুলো বলতে বলতেই কেঁদে ফেলেন বরগুনা জেলার আমতলী বৈঠাকাটা গ্রামের জেলে ইসমাইলের স্ত্রী শাহিদা বেগম। ইলিশ মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা চলছে নদীতে। ৭ই অক্টোবর থেকে ২২দিন চলবে এই নিষেধাজ্ঞা। বৃহস্পতিবার সরজমিন বরগুনার আমতলী উপজেলার বৈঠাকাটা জেলে পল্লী ঘুরে দেখা যায়, অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে দিন পার করছেন তারা। মাছ ধরায় অবরোধ চলাকালে সরকারি সাহায্যের চাল পাননি উপজেলার অধিকাংশ জেলেরা। চাল না পেয়ে তাদের জীবন যেন এখন ওষ্ঠাগত।
শাহিদা বেগমের স্বামী ইসমাইল হাওলাদার বৈঠাকাটা গ্রামের একজন জেলে। তিন ছেলে আর স্ত্রী নিয়ে পাঁচ জনের বড় অভাবী সংসার। তার ওপরেও রয়েছে এনজিওর ঋণ। তিনটি এনজিওর নিকট থেকে ঋণ নিয়েছেন এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। যে টাকা দিয়ে জাল, নৌকা তৈরি করেছেন। পায়রা নদীতে মাছ ধরে সংসার চালান। মাছ পাওয়া গেলে সংসার চলে, আর না পাওয়া গেলে অনেক সময় না খেয়ে থাকতে হয়। তার বড় ছেলে টাকার অভাবে বন্ধ হয়েছে বড় ছেলের লেখাপড়া। ছোট দুই ছেলেকে স্কুলেই দিতে পারেননি অভাবের তাড়নায়।
শাহিদা আরও বলেন, মোরা জাইল্যা। মাছ ধইর্যা খাই। নদীতে মাছ ধরাও বন্ধ। এহনো সরকারি চাউল পাই নাই। মাছ নাই, টাহা নাই। মোরা এহন না খাইয়া আছি। বুধবার রাইতে আর বৃহস্পতিবার ব্যাইন্যা কালে মোরা কেউ খাই নাই। এর আগের দিন দুহারে পানি দেয়া সামান্য ভাত মরিচ দিয়া খাইছি। আইজ দ্যার শেড় চাউল আর দুইডা আলু আর পাশের বাড়ি গোনে একটি মিনা আনছি হেইয়া রাইন্দা দুহারে খামু। তিনি আরও বলেন, মোগো দ্যাহার কেউ নাই। মোগো বাইচ্যা থাহার চাইয়া মইর্যা যাওয়াই ভালো।
একই গ্রামের ষাটোর্ধ রফিক গাজী ও তার স্ত্রী ইলিশ ধরার জাল মেরামতের কাজ নিয়ে ব্যাস্ত সময় পার করছেন। তিনি বলেন, বাবা বুড়া এই জীবনে অনেক কষ্ট। মাছ ধরা বন্ধ। সরকারি চাউল পাই নাই। জীবন বাঁচানোর জন্য কোন রকম ধার দেনা কইর্যা চলছি। সব জিনিসের দাম বেশি। কেনতে ব্যামালা টাহা লাগে। মোগোডে তো টাহা নাই। হেইয়ার পরও রইছে এনজিওর টাহার কিস্তি। জীবন আর চলে না। মনে চায় মইর্যা যাইতে। কথা হয় জেলে পল্লীর কালাম, খালেক, রিপন, মাইনুদ্দিন, রফিক, নাজমা, বিলকিছ ও রীমা বেগমের সঙ্গে। সবার যেন একই কথা। মাছ ধরা বন্ধ, কাজ নাই। মেলেনি সরকারি চাল।
আমতলী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা হালিমা সর্দার বলেন, আমতলী উপজেলায় ৬ হাজার ৭শ’ ৮৯ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছে। বৃহস্পতিবার আঠারগাছিয়া এবং গুলিশাখালী ইউনিয়নের জেলেদের মধ্যে চাল বিতরণ করা হয়েছে। শুক্র, শনিবারের মধ্যে সবাই চাল পাবেন। আমতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত) এসএম সাদিক তানভির বলেন, চাল বিতরণ শুরু হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে জেলেরা চাল পেয়ে যাবেন।