বিশ্বজগতের সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, লালনকারী ও পালনকারী হলেন মহান আল্লাহ। তাঁর মহত্ত্ব ঘোষণা, শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা হলো তাকবির, আর তাকবির হলো আল্লাহু আকবার অর্থাৎ আল্লাহ সবচেয়ে বড়। আল্লাহ এমন এক সত্তা যাঁর সমকক্ষ কেউ নেই, তিনিই অতুলনীয়, তাঁর সাদৃশ্য বা অনুরূপ কেউই নেই। এক কথায়- সত্তা, স্বকীয়তা, গুণ, কর্ম ও ক্ষমতায় তাঁর সমপর্যায়ের কেউই নেই, তিনি লা শরিক। দৃশ্য ও অদৃশ্য জগতের সব কিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন।
তাই মানবজাতির প্রতি মহান রবের নির্দেশনা- তোমরা আমার শ্রেষ্ঠত্ব ও কৃতজ্ঞতা ঘোষণা করো। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক বলেন, ‘তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ করব। আর তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং অকৃতজ্ঞ হয়ো না।’ (সূরা বাকারাহ-১৫২) ‘আর আপনার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন। (সূরা মুদ্দাসসির-৩) তিনি আরো বলেন, বলুন, তোমরা আল্লাহ নামে ডাকো বা রহমান নামে ডাকো, তোমরা যে নামেই ডাকো সব সুন্দর নামই তো তাঁর। আর আপনি সালাতে স্বর খুব উচ্চ করবেন না আবার খুব ক্ষীণও করবেন না; বরং এ দুইয়ের মধ্যপথ অবলম্বন করুন। বলুন, ‘প্রশংসা আল্লাহরই যিনি কোনো সন্তান গ্রহণ করেননি, তাঁর সার্বভৌমত্বে কোনো অংশীদার নেই এবং দুর্দশাগ্রস্ততা থেকে বাঁচতে তাঁর অভিভাবকের প্রয়োজন নেই। আর আপনি সম্ভ্রমে তাঁর মাহাত্ম্য তথা তাকবির ঘোষণা করুন।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ১১০-১১১) তিনি আরো বলেন, ‘এ জন্য যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ, তিনিই সত্য এবং তারা তাঁর পরিবর্তে যাকে ডাকে তা তো অসত্য। আর নিশ্চয় আল্লাহ, তিনিই সমুচ্চো, সুমহান।’ (সূরা হজ-৬২) অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘আর তিনি সুউচ্চ সুমহান’। (সূরা বাকারা-২৫৫) তিনি আরো বলেন, ‘তিনি গায়েব ও প্রকাশ্যের জ্ঞানী, মহান, সর্বোচ্চ’। (সূরা রা’দ-৯)
তাকবির তথা আল্লাহু আকবার। এটি ইসলামী পরিভাষা। প্রতিটি মুসলমানের কাছে সবচেয়ে প্রিয় উদ্দীপনামূলক শব্দ এটি। শিশুকাল থেকে শুরু করে অতি বৃদ্ধকালেও শব্দটির নিত্য ব্যবহার বেশ লক্ষণীয়। জন্মের পর মুসলিম শিশুর ডান কানে ‘আজান’ ও বাম কানে ‘ইকামাত’ দেয়া হয়, যাতে বরাবরই ‘আল্লাহু আকবার’ তাকবিরের শ্রেষ্ঠতম শব্দ দিয়ে আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করা হয়, আবার এ-ও স্বীকার করা হয় যে, প্রতিটি মানবশিশু আল্লাহর দেয়া আমানত।
তাকবির তথা ‘আল্লাহু আকবার’-এর আমল বা প্রয়োগ মুসলিম জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো হলো-
১. প্রাত্যহিক সালাতে তাকবির : দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের আজানে ৩০ বার, ইকামাতে ৩০ বার, ফরজ সালাতগুলোতে মোট ৯৪ বার তাকবির বলা হয়। এ তাকবিরগুলো সালাতের বাইরে আজানে সুউচ্চ আওয়াজে আর ইকামাত ও ১৭ রাকাত ফরজ সালাতে স্বাভাবিক আওয়াজে সুন্দরতম উপায়ে আল্লাহর মহিমা প্রকাশ করা হয়। উল্লেখ্য, ফরজ, সুন্নাত, স্বাভাবিক নফল সালাতে ৪৫৭ বার তাকবির উচ্চারিত হয়।
২. নতুন চাঁদ দেখে তাকবির বলা : আরবি মাস চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল। প্রত্যেক আরবি মাসের নতুন চাঁদ উদিত হওয়ার পর তাকবির উল্লেখ করা দোয়া পড়া সুন্নত। রাসূল সা:, সাহাবায়ে কেরাম এ আমল করতেন। হাদিসে এসেছে, ‘আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: যখন নতুন চাঁদ দেখতেন তখন বলতেন আল্লাহু আকবার, হে আল্লাহ! এ চাঁদকে ঈমান ও নিরাপত্তা, শান্তি ও ইসলাম এবং যে জিনিসটি আপনি পছন্দ করেন ও সন্তুষ্ট হন সেটির তাওফিকের সাথে উদিত করুন। আমার ও তোমার প্রভু আল্লাহ।’ (সুনানে দারিমি-১৬৯৭)
৩. জিলহজে তাকবির : জিলহজ মাসের প্রথম দশকে তাকবিরের আমল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাসূল সা: জিলহজ মাসে বেশি বেশি তাকবিরের বলার ফজিলত বর্ণনা করেছেন। হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘এ ১০ দিন নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় ও মহান কোনো আমল নেই। তাই তোমরা এ সময় তাহলিল তথা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, তাকবির তথা, আল্লাহু আকবার ও তাহমিদ তথা আলহামদু বেশি বেশি করে পাঠ করো।’ (বায়হাকি-৩৪৭৪)। আইয়ামে তাশরিক তথা জিলহজের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত তাকবির পড়া ওয়াজিব।
৪. তাকবির পবিত্র হজের অন্যতম আমল : পবিত্র হজে হাজীরা আল্লাহু আকবার তাকবির ধ্বনিতে জামরায় শয়তানকে লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করেন। হাজীরা মিনা থেকে আরাফাতে গমনাগমনে, এ ছাড়াও হজের গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলিতে তাকবির উচ্চারণ করেন। ইবনে উমার রা: থেকে বর্ণিত- তিনি মিনার নিকটবর্তী জামরাকে (ছোট জামরা) সাতটি কঙ্কর মারতেন এবং প্রতিটি কঙ্কর নিক্ষেপের সাথে তাকবির (আল্লাহু আকবার) পাঠ করতেন। তার পর সামনে এগিয়ে কিবলামুখী হয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে দোয়া করেন। অতঃপর জামরাহ উসতায় (মধ্যবর্তী জামরা) পাথর নিক্ষেপ করে বাম দিকে এগিয়ে যান এবং সেখানে কিবলামুখী হয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে দোয়া করেন। তার পর উপত্যকা থেকে জামরা আকাবায় (বড় জামরা) পাথর নিক্ষেপ করেন, কিন্তু সেখানে (দোয়ার জন্য) না থেমে ফিরে আসেন। অতঃপর বলেন, এভাবেই নবী সা:-কে এসব কাজ সম্পাদন করতে দেখেছি। (সহিহ বুখারি-১৭৫২)
৫. ঈদ উৎসবে তাকবির : ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার রাত থেকে ঈদের সালাত পর্যন্ত বেশি বেশি তাকবির বলা, এ বিষয়ে কুরআন ও হাদিসে নির্দেশনা রয়েছে। তাই সব মুসল্লি এ আমল করে থাকেন। পবিত্র ঈদের দুই রাকাত সালাতে ছয়বার তাকবির বলা ওয়াজিব।
৬. বাহনে আরোহণের সময় তাকবির : রাসূলুল্লাহ সা: যখন কোনো বাহনে আরোহণ করে সফর শুরু করতেন তখন তিনি তাকবির বলতেন। হাদিসে এসেছে, রাসূল সা: বাহনে আরোহণ করে আলহামদুলিল্লাহ পড়তেন। এরপর তিনি বলতেন, সুবহানাল্লাজি ছাখখারা লানা হাজা ওয়ামা কুন্না লাহু মুকরিনিন, ওয়া ইন্না ইলা রাব্বিনা লামুনকালিবুন। এরপর তিনি বলতেন, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, তার পর বলতেন, সুবহানাকা ইন্নি জলামতু নাফসি ফাগফিরলি ফা ইন্নাহু লা ইয়াগফিরজ জুনুবা ইল্লা আনতা। (সুনানে আবু দাউদ-২৬০২)
৭. উঁচু স্থানে আরোহণের সময় তাকবির : নিচ থেকে উঁচু স্থানে আরোহণের সময় তাকবির বলা সুন্নত। এটি রাসূল সা:-এর নিত্য আমল। হাদিসে এসেছে, জাবের রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘আমরা (সফরে) যখন উঁচু জায়গায় চড়তাম তখন আল্লাহু আকবার বলতাম এবং নিচু জায়গায় নামতাম, তখন সুবহানাল্লাহ বলতাম। (বুখারি-২৯৯৩, আহমদ-১৪১৫৮)
৮. পশু জবাইয়ের সময় তাকবির বলা : হালাল পশু জবাই করার সময় বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলা মুস্তাহাব, তাসমিয়া ও তাকবিরবিহীন জবাইকৃত পশু বা প্রাণীর গোশত খাওয়া হারাম। এ সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, যার ওপর আল্লাহর নাম (বিসমিল্লাহ) উচ্চারণ করা হয়েছে তা থেকে তোমরা আহার করো। (সূরা আনআম, আয়াত-১১৮) রাসূলুল্লাহ সা: দু’টি শিংওয়ালা ভেড়া জবাই করলেন, তখন বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার বললেন। (দারিমি-১৯৮৮)
৯. দুর্ঘটনায় তাকবির বলা : অগ্নিকা-জনিত দুর্ঘটনায় জীবন ও সম্পদ বাঁচানোর জন্য তাকবিরের আমল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নবী সা: বলেন, ‘যখন তোমরা অগ্নিকা-ের প্রজ্ব¡লন দেখবে, তখন তোমরা তাকবির বলো, কেননা তাকবির অগ্নিকা- নিভিয়ে দেয়। (আল মাকাসিদুল হাসানাহ, আল্লামা সাখাবি-১/৮৬)
১০. সালাতুল জানাজায় তাকবির : মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া হিসেবে সালাতুল জানাজা পড়া হয়, ওই সালাতের মধ্যে চারবার তাকবির বলতে হয়। ওই তাকবির বলা ফরজ।
১১. চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণকালে তাকবির বলা : রাসূলুল্লাহ সা: চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণকালে ইবাদতে মশগুল থাকতেন। বেশি বেশি তাকবির বলতেন।
১২. জিহাদের ময়দানে তাকবির : রাসূলুল্লাহ সা: ও তাঁর সাহাবিরা যখন জিহাদের ময়দানে অবতরণ করতেন, শত্রুদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতেন, বিজয় ছিনিয়ে আনতেন, তখন সমস্বরে বজ্র আওয়াজে আল্লাহু আকবার তাকবির বলতেন। পরবর্তীকালে মুসলিম বিজেতারাও জিহাদ অভিযান পরিচালনার আগে, ময়দানে ও বিজয়ী হয়ে ফেরার পথে তাকবির ধ্বনিতে আকাশ-জমিন মুখরিত করে তুলতেন। লেখক : মুহাদ্দিস, নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদরাসা, সোনাপুর, সদর, নোয়াখালী