হাসি-কান্না, দুঃখ-বেদনা, উত্থান-পতন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আল্লাহ তায়ালা সময় নামক চক্রটি এমনভাবে সাজিয়েছেন যে, এর কোনো অংশে দুঃখ, কান্না, বেদনা, পতন ও অপ্রাপ্তি রয়েছে, আবার কোনো কোনো অংশে রয়েছে হাসি, সুখ, উন্নতি, উত্থান ও প্রাপ্তিতে ভরপুর। পৃথিবী যেমন সূর্যের চারদিকে নিজস্ব কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে তেমনি সময় নামক চক্রটি মানুষের জীবনকে প্রদক্ষিণ করে। মানুষের জীবন যখন সময় চক্রের দুঃখ-বেদনার অংশ প্রদক্ষিণ করে তখন সে দুঃখ-বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়। আর যখন সুখের অংশ প্রদক্ষিণ করে তখন সুখে আরামে দিনাতিপাত করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এখন যদি তোমাদের আঘাত লেগে থাকে, তাহলে এর আগে এমনি ধরনের আঘাত লেগেছে তোমাদের বিরোধী পক্ষের গায়েও। এ তো কালের উত্থান-পতন, মানুষের মধ্যে আমি আবর্তন করে থাকি’ (সূরা আলে ইমরান-১৪০)। এখানে বদর ও ওহুদ যুদ্ধের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। আমরা সবাই জানি, বদর যুদ্ধে কুফফার শক্তি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। যুদ্ধে তাদের নেতৃস্থানীয় লোকজন ছাড়াও অনেকেই আহত ও নিহত হয়েছিল। পক্ষান্তরে ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানরা পরাজিত হয়। রাসূলুল্লাহ সা:-সহ অনেক সাহাবায়ে কেরাম আহত হয়েছিলেন এবং মদিনার প্রায় প্রতিটি ঘরেই একজন বা দু’জন শহীদ হয়েছিলেন। উল্লিখিত আয়াতে সে দিকেই ঈশারা করে বলা হয়েছে, বদর যুদ্ধের আঘাতে যখন কাফেররা হিম্মতহারা হয়নি তখন ওহুদ যুদ্ধের এই আঘাতে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলছ কেন?
দুঃখ-বেদনা, পতন ও অপ্রাপ্তি মানুষকে বিষণ্ন করে তুলে। সে মানসিক চাপের মধ্যে নিপতিত হয়। মানসিক চাপ তার জীবনকে অস্থির করে তুলে। অস্থিরতা তার পারিপার্শ্বিকতাকেও অস্থির করে তুলে। তার মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব বাসা বাঁধে। তার আত্মবিশ্বাস নড়বড়ে হয়ে যায়। বিষণ্নতা ও অবসাদ রোগে আক্রান্ত হয়। ফলে সে অশালীন ও অসংলগ্ন আচরণ করে এবং যেথায় সেথায় কথায় কথায় অযথা উত্তেজিত হয়ে উঠে। এক সময় কিছু মৌলিক বদাভ্যাস ও আচরণ তার মধ্যে গড়ে ওঠে। যেমন- সে চরম পরশ্রীকাতর হয়। পরনিন্দা, পরচর্চা, গিবত ইত্যাদি তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়।
প্রথমত, দুঃখ-বেদনা ক্লেশ ও পতন ইত্যাদিকে জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নিতে হবে এবং এগুলোকে ধৈর্য নামক অস্ত্র দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। আল কুরআন ও হাদিস মুসলমানদেরকে ধৈর্যের উপদেশ দেয়া হয়েছে। তা ছাড়া দুঃখ, ক্লেশ, বেদনা, ক্ষয়ক্ষতি হতাশা, নিরাশা ও বিষণ্নতার কারণ ও এগুলো থেকে পরিত্রাণের পথও বলে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর নিশ্চয় আমি ভয়-ভীতি, ক্ষুধা-অনাহার, সম্পদ ও প্রাণের ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে এবং উৎপাদন হ্রাসকরণের মাধ্যমে তোমাদের পরীক্ষা করব’ (সূরা বাকারা-১৫৫)। আর এগুলো থেকে পরিত্রাণের জন্য বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! সবর ও সালাতের দ্বারা সাহায্য গ্রহণ করো, আল্লাহ সবরকারীদের সাথে আছেন’ (সূরা বাকারা-১৫৩)।
এই পৃথিবী মানুষের জন্য ফুলের বিছানা নয়। জীবনের এই পথটুকু বড়ই বন্ধুর ও কণ্টকাকীর্ণ। কখনো সমতল কখনো বা উঁচু-নিচু। বিপদসঙ্কুুল এ পথে চলার সময় চতুর্দিক থেকে বিপদ-আপদ ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ঠেলে দেয়া হবে। অগণিত ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। সবর, দৃঢ়তা, অবিচলতা ও দ্বিধাহীন সঙ্কল্পের মাধ্যমে সমস্ত বিপদ-আপদের মোকাবেলা করে যখন আল্লাহর পথে এগিয়ে যেতে থাকবে তখনই তাদের ওপর বর্ষিত হবে আল্লাহর অনুগ্রহরাশি। অর্থাৎ এই কঠিন পথ যা মানুষের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে, মানুষ বিষণ্নতার রোগে আক্রান্ত হয়। তখন তাদের অভ্যন্তরীণ দুটো শক্তির প্রয়োজন। একটি হচ্ছে, নিজের মধ্যে সবর, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার শক্তির লালন করতে হবে। আর দ্বিতীয়ত, সালাত পড়ার মাধ্যমে আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
মনে রাখবেন, আপনি একজন বিশেষ জাতির প্রভাবশালী সদস্য, আপনাকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি এমন এক বিশেষ সত্তা, যিনি আপনাকে সৃষ্টি করার পর পৃথিবী নামক অথই সমুদ্রে ছেড়ে দিয়ে নিজের দায়িত্ব গুটিয়ে নিয়েছেন- তা কখনো নয়। এটি মহান সত্তার বৈশিষ্ট্যও নয়; বরং আপনি তাঁর সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে আছেন। তিনি আপনার প্রতিটি অবস্থা গভীরভাবে নিরীক্ষা করছেন। তাঁর নাম মহাদ্রষ্টা, তিনি সূক্ষ্মদর্শী। তাই বিষণ্নতা দূর করার জন্য তাঁর ওপর পূর্ণ নির্ভরশীল হোন এবং তাঁকে বেশি করে স্মরণ করতে থাকুন, তাঁর দরবারে বেশি বেশি ধরনা দিতে থাকুন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এবং তিনি তাকেই তাঁর দিকে আসার পথ দেখান যে তাঁর দিকে রুজু করে। তারাই এ ধরনের লোক যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর স্মরণে তাদের চিত্ত প্রশান্ত হয় সাবধান হয়ে যাও। আল্লাহর স্মরণই হচ্ছে এমন জিনিস যার সাহায্যে চিত্ত প্রশান্তি লাভ করে’ (সূরা রা’দ : ২৭-২৮)।
যারা সব কিছুর ব্যাপারে আল্লাহর দিকে রুজু হয় না; বরং তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাকে জোর করে সত্য সঠিক পথ দেখানো আল্লাহর রীতি নয়। এ ধরনের লোকেরা সত্য-সঠিক পথ পরিত্যাগ করে উদভ্রান্তের মতো যেসব ভুল পথে ঘুরে বেড়ায় এবং সমস্যা সমাধানের জন্য চেষ্টা করে তাতে সমাধান তো দূরের কথা; বরং সমস্যা তাকে আরো ঘিরে ধরে। আল্লাহ তাকে সেই সব পথে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ দান করেন। দুঃখ, কষ্ট, বেদনা থেকে সৃষ্ট বিষণ্নতাকে ঢাকার জন্য উদ্ভট সিনেমাটিক সাময়িক সমাধান খুঁজে ফিরে। অর্থাৎ নিজেকে ধ্বংস করার বিশেষ কোশেশ। একজন সত্যসন্ধানীর জন্য যেসব কার্যকারণ সত্য পথ লাভের সহায়ক হয়, একজন অসত্য ও ভ্রান্ত পথপ্রত্যাশী ব্যক্তির সেগুলো বিভ্রান্তি ও গোমরাহির কারণে পরিণত করে দেয়া হয়। উজ্জ্বল প্রদীপ তার সামনে এলেও তা তাকে পথ দেখানোর পরিবর্তে তার চোখকে অন্ধ করে দেয়ার কাজ করে। আল্লাহ কর্তৃক কোনো ব্যক্তিকে গোমরাহ করার অর্থ এটিই।
সুতরাং বিষণ্নতা থেকে মুক্তি পেতে হলে এবং মানসিক প্রশান্তি লাভ করার জন্য অবশ্যই নিজেকে আল্লাহর দিকে রুজু হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর উপায় হলো, দোয়া ও সালাত। এ দুটো বিষয় মানসিক অস্থিরতাকে কমিয়ে দেয় ও মনে দৃঢ় আশার স ার করে। আনাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: যখন কোনো দুঃখ-কষ্ট বা চিন্তা, অস্থিরতা বোধ করতেন তখন বলতেন, ‘ইয়া হাইয়্যু ইয়া কাইয়্যুম! বি-রাহমাতিকা আসতাগিছু’ অর্থাৎ- হে চিরঞ্জীব! হে চিরস্থায়ী! তোমার রহমতের মাধ্যমে তোমার কাছে সাহায্য চাই (তিরমিজি, মুসতাদরাকে হাকিম)। আনাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, নবী সা: যখন চিন্তিত হতেন তখন তিনি এই দোয়া পড়তেন ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাজানি, ওয়া আউজুুবিকা মিনাল আজজি ওয়াল কাসালি, ওয়া আউজুবিকা মিনাল জুবনি ওয়াল বুখলি, ওয়া আউজুবিকা মিন দ্বালা’য়িদ্দাইনি ওয়া গালাবাতির রিজালি।’ অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে দুশ্চিন্তা, দুঃখ, অসহায়ত্ব, অলসতা, কৃপণতা, কাপুরুষতা, ঋণের বোঝা ও মানুষের দ্বারা প্রবলতা থেকে আশ্রয় চাই (বুখারি ও মুসলিম)।
সালাতের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর সবচেয়ে নিকটবর্তী হন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সবর ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য নাও। নিঃসন্দেহে সালাত বড়ই কঠিন কাজ। কিন্তু সেসব অনুগত বান্দাদের জন্য কঠিন নয় যারা মনে করে, সব শেষে তাদের মিলতে হবে তাদের রবের সাথে এবং তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে’ (সূরা বাকারা : ৪৫-৪৬)।
প্রকৃতপক্ষে মনের ধনীই হচ্ছে আসল ধনী। যারা মনের ধনী হতে পেরেছে তাদের কোনো হতাশা বা বিষণœœতা থাকতে পারে না। মনের ধনী হলো- বাস্তবে প্রচুর সম্পদের মালিক নয়; কিন্তু মনের দিক থেকে যিনি ঐশ্বর্যশালী বা ধনী। যেই ঐশ্ব¦র্যশালী বা ধনী চরম অভাবের সময়েও অন্যের অভাবে বা অন্যের প্রয়োজন পূরণে এগিয়ে আসে। আবদুল্লাহ রা:-এর সূত্রে নবী সা: থেকে বর্ণিত- তিনি এই বলে দোয়া করতেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আস আলুকাল হুদা, ওয়াত তুকা, ওয়াল আফাফা ওয়াল গিনা।’ অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে হিদায়াত (পথ নির্দেশনা), তাকওয়া (আল্লাহভীতি), চারিত্রিক উৎকর্ষতা ও সচ্ছলতার জন্য দোয়া করছি (মুসলিম-৬৭৯৭)।
সুতরাং কোনো অবস্থাতেই বিষন্ন হওয়া যাবে না। মহান আল্লাহর ওপর অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা রাখুন। আল্লাহর স্মরণ, তাওবা ও ইসতিগফার এবং সালাতে মনোযোগী হোন। ইনশা আল্লাহ আপনার সব বিপদ-মুসিবত ও দুঃখ-বেদনা মুছে যাবে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট