সুন্দরবনের বন্য প্রাণী এবং নদী–খালের মাছের বিচরণ ও প্রজনন কার্যক্রমের সুরক্ষায় আগামী ১ জুন থেকে তিন মাসের জন্য বন্ধ হচ্ছে সুন্দরবনের দুয়ার। এ সময় পর্যটক প্রবেশ, সাধারণ মানুষের চলাচলসহ সুন্দরবনের নদী-খালে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকবে। নিষেধাজ্ঞা সামনে রেখে গহিন সুন্দরবন থেকে লোকালয়ে ফিরতে শুরু করেছেন উপকূলীয় অ লের বনজীবী হিসেবে পরিচিত জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়ালরা। তবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত দীর্ঘ ৯২ দিনের নিষেধাজ্ঞায় কীভাবে সংসার চালাবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তাঁরা। বনজীবীরা বলছেন, বন্ধের দিনগুলোয় তাঁদের জন্য সরকারি যে সহায়তা দেওয়া হয়, তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। সরকারি সহায়তার বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি তাঁদের।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনে মৎস্যসম্পদ রক্ষায় ২০১৯ সাল থেকে প্রতিবছর ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সব নদী ও খালে মাছ আহরণ বন্ধ রাখা হচ্ছে। সুন্দরবনের ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ দশমিক ১ বর্গকিলোমিটার, যা পুরো সুন্দরবনের আয়তনের ৩১ দশমিক ১৫ ভাগ। সুন্দরবনের জলভাগে ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া রয়েছে। জুন থেকে আগস্ট— এই তিন মাস প্রজনন মৌসুমে সুন্দরবনের নদী ও খালে থাকা বেশির ভাগ মাছ ডিম ছাড়ে। এ কারণে ১ জুন থেকে ৯২ দিনের জন্য জেলেদের সুন্দরবনে প্রবেশের সব ধরনের অনুমতি বন্ধ রাখে বন বিভাগ।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে খুলনার সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলার কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীর তীরে গিয়ে দেখা গেছে, সুন্দরবন থেকে লোকালয়ে ফিরেছে শতাধিক মাছ ধরা নৌকা। নৌকা থেকে মাছ ধরার জালসহ অন্যান্য মালামাল সরিয়ে নিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন জেলেরা। কেউ কেউ আবার নৌকা মেরামত করার জন্য বেড়িবাঁধের রাস্তার ওপর উঠিয়ে রাখছেন। সুন্দরবনসংলগ্ন ৪ নম্বর কয়রা গ্রামের বনজীবী আকরাম হোসেন বলেন, টানা ছয় দিন সুন্দরবনের নদী ও খালে মাছ ধরে সকালে লোকালয়ে ফিরেছেন। খুব বেশি মাছ ধরতে পারেননি। সামনের ৯২ দিন বন্ধের সময় সংসার চালানোর মতো স য় করা টাকা নেই। এ নিয়ে বিপদে আছেন।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত কয়রার এক হাজারের বেশি বনজীবী নৌকা নিয়ে সুন্দরবন থেকে লোকালয়ে ফিরে এসেছেন বলে জানিয়েছেন বনজীবীদের সংগঠন সুন্দরবন অ ল সহব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রিয়াসাদ আলী। তিনি বলেন, অন্য জেলে নৌকাগুলোও কাল বুধবার বিকেলের মধ্যে ফিরে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিন মাস সুন্দরবনে প্রবেশ নিষেধ। জেলে, বাওয়ালি, পর্যটক কেউই সুন্দরবনে প্রবেশ করতে পারবেন না। এমন অবস্থায় জেলে, বাওয়ালি, পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সরকারি সহায়তা প্রদানের দাবি জানান তিনি।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কয়রার বানিয়াখালী, কাশিয়াবাদ, কোবাদক ফরেস্ট স্টেশনসহ খুলনা রেঞ্জের আওতায় ২ হাজার ৯০০টি নৌকার সুন্দরবনে প্রবেশের বিএলসি (বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট) রয়েছে। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, কয়রায় নিবন্ধিত জেলে রয়েছে ১৩ হাজার ৫২৬ জন। নিষেধাজ্ঞার সময় ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় এসব জেলেকে ৩ মাসে ৮৬ কেজি চাল দেওয়া হয়।
অবশ্য স্থানীয় বনজীবীরা বলছেন, কয়রায় জেলেদের সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। বিশেষ করে কয়রা সদরের কিছু অংশ, মহারাজপুর, মহেশ্বরীপুর, উত্তর বেদকাশী এবং দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন ভৌগোলিক কারণেই সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল মানুষ–অধ্যুষিত। এসব এলাকায় অন্তত ৫০ হাজার জেলে পরিবারের বসবাস, যারা বংশপরম্পরায় বনজীবী। তারা সারা বছর সুন্দরবনসংলগ্ন নদ-নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। গোবরা এলাকার মোহাম্মদ আবুল হোসেন নামের এক মৎস্যজীবী বলেন, কয় দিন আগে গেল ঘূর্ণিঝড় মোখা। তখন সুন্দরবনের নদী-খালে পানি বেড়ে যাওয়ায় বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন। আবার ১ জুন থেকে ৯২ দিন সুন্দরবন বন্ধ। এর মধ্যে সবকিছুর দাম বাড়তি। বন্ধের সময় সরকারের পক্ষ থেকে যে সাহায্য-সহযোগিতা করা হয়, তা যথেষ্ট নয়। সামনের দিনগুলো খুবই কষ্টের মধ্যে যাবে।
বনজীবীরা বলছেন, গত বছরগুলোয় ৯২ দিনের এই নিষেধাজ্ঞার সময় প্রভাবশালী মাছ ব্যবসায়ী মহাজন চক্রের দখলে ছিল সুন্দরবনের অভয়ারণ্য। সাধারণ জেলে ও বাওয়ালিদের অনুপস্থিতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে অসাধু বনরক্ষীদের ‘ম্যানেজ করে’ তারা হরিণ শিকার ও নদী-খালে বিষ দিয়ে মাছ আহরণ করে। বনজীবীদের দাবি, এবার বন্ধের মৌসুমে এসব অপতৎপরতা বন্ধে বন বিভাগকে কঠোর হতে হবে।
সুন্দরবনের কালাবগি ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল হাকিম বলেন, তিন মাস সুন্দরবনে প্রবেশ বন্ধের মূল উদ্দেশ্য হলো, মাছের প্রজনন বৃদ্ধি করা। যার ফলে সুন্দরবনের সব পর্যটনকেন্দ্রে দর্শনার্থীদের যাতায়াতও বন্ধ থাকবে। কারণ, এ সময় নদী-খালে পর্যটকবাহী নৌযান চলাচল করলে মাছের প্রজনন কার্যক্রম বিঘিœত হবে। সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শ্যামা প্রসাদ রায় বলেন, সুন্দরবনের সব নদী ও খালে মাছ ধরা বন্ধের পাশাপাশি পর্যটক প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বন্ধ করা হয়েছে সুন্দরবনে প্রবেশের সব ধরনের পাস-পারমিট। এ সময় বন্য প্রাণী শিকার ও বিষ দিয়ে মাছ আহরণ বন্ধে কঠোর অবস্থানে থাকবে বন বিভাগ। শ্যামা প্রসাদ রায় বলেন, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সুন্দরবনের যে এলাকা থেকে অপরাধীরা মাছ, কাঁকড়া ধরার পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে আটক হবে, সেই এলাকার দায়িত্বরত বন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কর্তব্যে অবহেলার কারণে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’