রাত ১০টা ১৫ মিনিট। কসমিক এয়ার প্রাইভেট লিমিটেডের বিমানযোগে কাঠমান্ডু রওনা হয়েছি। আমরা ১৫ জন। আটজন মহিলা, পুরুষ তিনজন কিশোর এবং চারজন শিশু পর্যটক। এ সোয়া ডজন ট্যুরিস্টসহ আন্তর্জাতিক বিমানের সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছতে অর্ধডজন ধকল পোহাতে হয়েছে।
আমাদের ক’জনের পাসপোর্টে ইন্ডিয়ান ভিসা লাগলেও নেপালের ভিসা লাগেনি। ইন্ডিয়ান ভিসা প্রাপ্তির পরপরই বিমানের টিকিট কেটে ফেলা হয়। যাত্রার দু’দিন আগে নেপাল অ্যাম্বাসেডর অফিস বন্ধ থাকায় ভিসা নেয়া সম্ভব হয়নি। ফটোসহ একজোড়া দরখাস্ত সাথে রাখা হয়েছে। কাঠমান্ডু বিমানবন্দর নেমে ভিসার জন্য দরখাস্ত করতে হবে। ব্যাপারটা আমার কাছে ঘোলাটে মনে হচ্ছিল। আমার অভিজ্ঞতার আলোকে যদ্দুর জানি, আগে ভিসা, তারপর বিদেশ গমন। ভিসা ছাড়া বিদেশে গমন- ভাবতেও খটকা লাগে। সে কারণে বিমানে উঠেও স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। আমরা রাত ৮টায় বিমানবন্দর পৌঁছে টিকিট প্রদর্শন করে মালামালসহ বন্দরের ভেতর প্রবেশ করি। প্রবেশ পথের বাম দিকে স্ক্যান মেশিনের রানারের একপ্রান্তে লাগেজ রাখতেই ফুরফুর করে ভেতরে চলে যায়, বের হয়ে আসে আবার ভেসে ওঠে ভেতরের মালামালের ছবি। সন্দেহজনক কিছু হলেই রানার থামিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। পরীক্ষাসংক্রান্ত ছাড়পত্রসহ লাগেজের নিরাপত্তা বেল্ট পরিয়ে দেয়। হ্যান্ড লাগেজে অগ্রিম ঝুলিয়ে নিতে হয় নিরাপত্তা কার্ড। পরীক্ষার পর মালামালসহ কসমিক এয়ার ওয়েজের লাইনে দাঁড়াই। টিকিট চেকিং কাউন্টারে লাগেজের ওজন পরীক্ষা করে নাম্বার লাগিয়ে লাগেজ ক্যারিয়ারের বেল্টে রাখতেই লাগেজ বিমানের উদ্দেশে রওনা হয়ে যায়। আমাকে দেয়া হয় একটা বোর্ডিং কার্ড। বোর্ডিং কার্ডে ফ্লাইট নম্বর, সময় ও সিট নম্বর বিস্তারিত উল্লেখ থাকে। বোর্ডিং কার্ড নেয়ার পরেও আমাদের হাতে ঘণ্টাখানেক সময় ছিল।
বিমান অফিসে ইমিগ্রেশনের বাইরে ওয়েটিং রুমে তেমন লোকজন ছিল না। আমাদের মতো সংসার বিরাগী ছাড়া এ সময় কেউ পর্যটনে বের হয় না। শূন্য খেলার মাঠের মতো খাঁ-খাঁ করছিল বিমান অফিসের লবি। এ দিকে যখন আমাদের লাগেজ পরীক্ষা ও টিকিট চেকিং হচ্ছিল খুদে পর্যটকরা ওদিকে তখন খালি মাঠে কানামাছি খেলায় মত্ত হয়ে পড়ে। ডাকাডাকি করেও ওদের থামানো যাচ্ছিল না। ওসব করতে গিয়ে আমাদের এক শিশু পর্যটক পা পিছলে ধরাশায়ী হয়ে ভ্যাঁ করে ওঠে। দৌড়ে গিয়ে ওঠায় ওর মা। থেমে যায় খুদে পর্যটকদের খেলাধুলা। ততক্ষণে আমরা ইমিগ্রেশন পার হওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে গেছি। টিকিট পাসপোর্ট ও বোর্ডিং কার্ড পরীক্ষার পর ইমিগ্রেশন পার হতে দেয়। কিছু দূর যাওয়ার পর আবার স্ক্যান মেশিন। পাশে নিরাপত্তা কর্মকর্তা। হাত ব্যাগ স্ক্যান মেশিনে ঢুকিয়ে পরীক্ষার পর খুলে দেখাতে বলে। হাত ব্যাগের সবকয়টি চেইন খুলে ওদের সামনে মেলে ধরি। এরপরেও হাত ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে মালামাল নেড়ে-ঘেঁটে পরীক্ষা করে দেখে, নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে এমন কোনো দ্রব্য বা বস্তু আছে কি নেই। পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পর ব্যাগের গায়ে অগ্রিম লাগিয়ে রাখা কার্ডে পরীক্ষিত মর্মে একটা নিরাপত্তা সিল মেরে দেয়। এবার শরীর পরীক্ষার পালা। মেটাল ডিটেক্টর ফ্রেমের নিচ দিয়ে প্রবেশ করতেই কিক কিক শব্দে লাল বাতি জ্বলে ওঠে। চমকে উঠি। কলজে শুকিয়ে যায়। নিজের জানা মতে, শত ভাগ নিষ্কণ্টক হওয়া সত্ত্বেও লাল বাতি জ্বলে উঠলো কেন? কিক্ কিক্ শব্দে ডেঞ্জার সিগনালই দিলো কেন? কি জানি আবার বিমানে প্রবেশের আগেই শ্রীঘরে প্রবেশ করতে হয় কি না। মেশিনের বাঁ দিকে পুরুষ এবং ডান দিকে কালো পর্দা টাঙিয়ে মহিলা কর্মকর্তা দিয়ে মহিলার শরীর পরীক্ষার স্থান। ডিটেক্টর মেশিনের কিক কিক শব্দ হওয়ার পর নিরাপত্তা কর্মকর্তা আমার দিকে কেমন করে যেন তাকায়, শরীর পরীক্ষার জন্য ইশারায় বামদিকের নির্ধারিত স্থানে দাঁড়াতে বলে। কথা মতো দাঁড়াই। দুহাত ওপরে তুলতে বলে, ওপরে তুলি। নিরাপত্তা কর্মকর্তা তার হাতে থাকা হ্যান্ড ডিটেক্টরের সাহায্যে কাতুকুতুসহ শরীর পরীক্ষা শুরু করে। ডিটেক্টর নাভির কাছে পৌঁছতেই আবারো রেড সিগন্যালসহ কিক কিক শব্দ হয়। চমকে উঠতেই পরীক্ষা কর্মকর্তা মৃদু হেসে আমার বেল্টের বকলেসের দিকে ইঙ্গিত করে নিষ্কৃতি দেয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পালা শেষ করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে রানওয়ের পাশে গিয়ে দেখি, কসমিক এয়ারওয়েজের বাস দাঁড়িয়ে আছে। বাসে চড়ে ছোট্ট একটা বিমানের কাছে পৌঁছি। বিমানের গায়ে লেখা পড়ে বুঝলাম, এ বিমানই আমাদের কাঠমান্ডু নিয়ে যাবে। বিমানের আকার আয়তন দেখে মনের আকার আয়তনও ছোট হতে থাকল। সিঁড়ি বেয়ে বিমানের প্রবেশ মুখে দু’জন যুবক-যুবতী আমাদের ইশারায় স্লামালেকুম জানাতেই আমি ওয়ালেকুম সালাম বলে বিমানের ভেতরে প্রবেশ করি। হাতে থাকা বোর্ডিং কার্ড দেখে একজন বিমানবালা মিষ্টি হেসে ইশারায় বিমানের পেছনের দিকে যেতে বলে। হাত ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বিমানের মাঝামাঝি পৌঁছতেই অপর একজন বিমানবালা অনুরূপভাবে আরো পেছনে যেতে বলে। আরো পেছনে গিয়ে নির্ধারিত আসনে বসে সামনে তাকাতেই সম্পূর্ণ বিমানটি চোখের নেটওয়ার্কের মধ্যে চলে আসে। প্রতি সারির বাম দিকে দু’জন ও ডান দিকে তিনজন বসার স্থান। ঘন সবুজবসনা তিন নেপালি ললনা হাসি মুখে হেঁটে হেঁটে যাত্রীদের আসন গ্রহণে সহায়তা করছে। যাত্রীদের সামনে বিমান উড্ডয়ন অবতরণ বিষয়ক কোনো ইনডিকেটর ছিল না। লাগেজ ক্যারিয়ারে লাগেজ ঢুকিয়ে যাত্রীদের আসন গ্রহণ শেষ হতেই বিমানটি নড়েচড়ে ওঠে। ফর্সা মুখের সবুজ বসনা নেপালি বালারা বিমানের মাঝখানের সরু প্যাসেজে সিট বেল্ট ও অক্সিজেন মাস্ক হাতে দাঁড়িয়ে যায়। যে কেউ লাউড স্পিকারে এগুলোর ব্যবহার ঘোষণা করতে শুরু করে। ঘোষণার সাথে ললনারাও অঙ্গভঙ্গি করে যাত্রীদের ব্যবহার কৌশল দেখায়। দেখানো শেষ হতেই বিমান চলতে শুরু করে। কিছুক্ষণ ভদ্রভাবে চলার পর থমকে দাঁড়ায়, বিশ্রীভাবে গর্জন শুরু করে। কানে তালা লাগা প্রচ- গর্জনসহ দুরন্ত বালকের মতো দৌড় দেয়। দৌড়ের গতি বৃদ্ধি পেতেই জোর ঝাঁকুনিসহ নেপালের উদ্দেশে ভূমি ত্যাগ করে কসমিক এয়ার ওয়েজের ছোট্ট বিমানটি। ওপর থেকে ঢাকা শহরটাকে আলোক সজ্জিত মেলার মতো মনে হয়। বিমান যতই ওপরে উঠছে আলোক সজ্জিত মেলার আকার আয়তন ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিমান শহর এলাকা ছাড়তেই বাতির মেলা কমতে শুরু করে। ঢাকা টু মালয়েশিয়া প্রথম বিমান আরোহণ। প্রথম বিমান আরোহণের আগে ইচ্ছেমতো খাওয়া-দাওয়া করেছিলাম। মালয়েশিয়ার বিমানে প্রচুর খাবার দেয়া হয়। ফলে বিমানে প্রদত্ত সুপেয় পানীয়সহ লোভনীয় খাদ্যদ্রব্যাদি খেতে পারিনি। এরপর থেকে যতবার বিমানে আরোহণ করেছি, ততবার বিমানে উঠে পানাহার করার মতো প্রস্তুতি নিয়েই আরোহণ করেছি। আজকেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। রমজান মাস। বিমানে ওঠার আগে ইফতার করার পর্যাপ্ত সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও নেপালি খাবারের আশায় অপর্যাপ্ত ইফতার করেছিলাম। বিমান উড্ডয়ন প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরপরই খাবারের জন্য উস খুশ শুরু করেছি। কেন করব না? এখন রাত বাজে সাড়ে ১০টা। ক্ষিধায় পেট চোঁ-চোঁ করতে শুরু করেছে।
সুন্দরীরা যাত্রীদের মধ্যে খাবারের মেন্যু বিবরণ করতে শুরু করেছে। ওরা ঠিক কাজটাই করছে। ওরা অমুসলিম আর আমরা মুসলিম কান্ট্রির লোক। যাত্রীদের মতামত না নিয়ে যেকোনো খাবার দিলেই খেতে শুরু করা ঠিক হবে না। এসব ভেবেই তারা বিনামূল্যে খাবার বিতরণের আগে পছন্দ মতো খাবার বাছাইয়ের জন্যে মেন্যু বিতরণ শুরু করে। যাত্রীরা মেন্যু দেখে অর্ডার দিলেই সে মোতাবেক খাবার এসে হাজির হবে। দেশ ছোট হলে কী হবে, বুদ্ধির দিক দিয়ে ওরা অনেক বড়।
সুন্দরীদের একজন আমার কাছে আসতেই ছোঁ মেরে মেন্যুটা নিয়ে নিই। মেন্যুতে লেখা আছে- Potato Chips 60/- Biscuits 70/- Peanut 90/- Fruit juice 50/- Mineral water 20/-, Tea/Coffee 30/- Taka আরো লেখা আছে The Price are in Nepalese Currencies. দ্রব্যাদি খেলেই নেপালি কারেন্সিতে পাশে বর্ণিত টাকা গুনতে হবে। মেন্যু বিলি শেষ করে দুই সুন্দরী খাদ্য সম্ভার ভর্তি ট্রলি বিমানের মাঝখানের গলিপথ দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে যাত্রীদের কাছে এনে খাওয়ার জন্য যাচনা শুরু করে। প্রতি প্যাকেট বিস্কুট ৭০ টাকা, আর চিপসের প্যাকেট ৬০ টাকায় খরিদ করতে কেউ রাজি হয়নি। সুন্দরীদ্বয় রসদ ভর্তি ট্রলি বিমানের মাথা থেকে যেভাবে ঠেলতে ঠেলতে লেজের দিকে নিয়েছিল, আবার লেজের দিক থেকে সেভাবেই ঠেলতে ঠেলতে মাথার দিকে নিয়ে গেল। যেখানকার খাদ্য সেখানে রেখে মুখ ভার করে গলির মাথায় দাঁড়িয়ে রইল দু’সুন্দরী।
বাংলাদেশ সময় সোয়া ১১টায় যাত্রীদের চঞ্চলতা ও ঘোষিকার বর্ণনা থেকে বুঝলাম, অল্পক্ষণের মধ্যেই বিমান কাঠমান্ডু বন্দরে অবতরণ করতে যাচ্ছে। ঘোষণায় আবহাওয়াসহ স্থানীয় সময় জানিয়ে দেয়া হয়। আমাদের ঘড়ির কাঁটা মাত্র ১৫ মিনিট কমিয়ে দিলেই নেপালের স্থানীয় সময়ের সাথে মিলে যাবে। সোয়া ঘণ্টার মধ্যে কসমিক এয়ারওয়েজের বিমানটি রানওয়ে স্পর্শ করে। হাত ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে নামতেই দেখি, পাশে বিমানের বাস। বিমান অফিসের বহির্গমন গেটে নেমে কিছুদূর অগ্রসর হয়ে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার সামনে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হয়। বহির্গমন বিভাগের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার নিকট থেকে ৮/১০ ফুট দূরে রেড মার্ক। অবতরণ যাত্রীদের পাসপোর্ট ভিসা পরীক্ষার জন্য রেড মার্কের বাইরের লাইন থেকে একজন একজন করে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার কাছে কাগজপত্র দাখিল করতে হয়। আমরা ভিসাবিহীন ট্যুরিস্টরা ভিন্ন একজন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার কাছে ভিসার জন্য দু’কপি আবেদনসহ পাসপোর্ট জমা দেই। কর্মকর্তা দরখাস্ত ও পাসপোর্টের খুঁটিনাটি বিষয় পরীক্ষা করে পাসপোর্টের গায়ে সিলমোহর করে ভিসায় নম্বর বসিয়ে চিন্তামুক্ত করে দেয়। এ জাতীয় ভিসাকে পোর্ট এন্ট্রি ভিসা বলে। বিমানের লাগেজ ক্যারিয়ার থেকে লাগেজ সংগ্রহ করে বাইরে আসতেই গায়ে শীত লাগতে শুরু করে। আমাদের দেশের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে মাঝে মাঝে শৈত্যপ্রবাহ হয়। শৈত্যপ্রবাহের সময় যে রকম শীত ঠিক সে রকম শীত মনে হলো নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। এ সময় এক অপরিচিত যুবক আমাদের পরিচয় জানার পর নিজের পরিচয় দিয়ে সবাইকে সুন্দর একটা মাইক্রোবাসের নিকট নিয়ে যায়। ড্রাইভার পেছনের দিকে জানালার কাচ সরিয়ে লাগেজপত্র মাইক্রোতে ওঠাতে শুরু করে। যুবকটি ইংরেজিতে জানায়, সে-ই আমাদের গাইড, সাথে আরো জানতে চাইল ইংরেজি এবং হিন্দি এ দু’ভাষার মধ্যে আমরা যে ভাষা পছন্দ করি, সেভাষাতেই সে আমাদের গাইড করবে। (০২ নভেম্বর ২০০৫ খ্রিস্টাব্দ) লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিকmail: adv.zainulabedin@gmail.com