হজের ইবাদত কী চমৎকার! এর মুহূর্তগুলো কী মহামূল্যবান! সময়গুলো কতই না পরিশুদ্ধ! এর লক্ষ্যগুলো কতই না উপকারী! হাজীরা এতে ক্ষণস্থায়ী পার্থিব সামগ্রী, উপকরণ ও ভোগ-বিলাস থেকে মুক্ত থেকেছেন। নিজেদের ইচ্ছা ও কর্মকে আল্লাহতে নিবিষ্ট রেখেছেন। তাঁর ঘরমুখী হয়েছেন নিষ্ঠাপূর্ণ তালবিয়া ও তাওয়াফের মাধ্যমে। নিজ রবের রহমত ও রেজামন্দি হাসিলের প্রত্যাশায়। বিসর্জন করেছেন আরাফা প্রান্তরে তাওবাহ ও ভালোবাসায়। তাদের জিহ্বাগুলো নড়ে উঠেছে আল্লাহর জিকির ও ভক্তিতে যখন তারা মুজদালিফা ও মিনায় পাথর নিক্ষেপ করেছেন। তাদের হৃদয় উন্মুখ ও উদ্বেল হয়েছে আপন প্রভুুর রহমত, মাগফিরাত ও বিশাল ক্ষমার আশায়। ওই স্থান ও ভূমিতে উপনীতদের ওপর রহমত বর্ষিত হয়, যারা ইবরাহিম আ:-এর ডাকে সাড়া দিয়েছেন।
যারা এসেছেন দূর-দূরান্ত থেকে একাকী ও সদলে। কল্যাণের স্থান অবধি পৌঁছা এবং পবিত্র মহিমান্বিত নির্দিষ্ট দিনগুলোয় আল্লাহর জিকিরের নিমিত্তে। সুতরাং হে আল্লাহর ঘরের অভিযাত্রীরা, আপনারা কি মনে করেন, মহান দয়াময় খালি হাতে ফেরত দেবেন? তাদের চেষ্টাকে বিফল বানাবেন? হজ-তাওয়াফ-সায়ির পর আপন প্রভু সম্পর্কে আপনাদের কী ধারণা? হে আমাদের মহাপবিত্র রব, আপনি কতই না দয়াবান। কতই না প্রশস্ত আপনার কৃপা। আপনার প্রতি আমরা শুধু সুধারণাই রাখি। আপনার কাছে শুধু পুণ্য, অনুকম্পা ও অনুগ্রহই প্রত্যাশা করি। তাই হে আল্লাহর ঘরের আগন্তুকরা, সুসংবাদ গ্রহণ করুন। শুভ প্রত্যাশা করুন। আপনারা এসেছেন বিশাল ক্ষমা ও মাগফিরাত, বিপুল দয়া ও দাক্ষিণ্য এবং প্রশস্ত রহমত, অনুগ্রহ ও অনুকম্পাসম্পন্ন প্রভুর সমীপে। আপনারা আল্লাহর প্রতিনিধি, অতিথি ও দর্শনার্থী। আপনাদের উপযুক্ত সমাদর তিনি করবেন। তিনি সম্মানিত রব, যিনি সুকর্মের প্রতিদান দেন ১০ গুণ থেকে বহু গুণ। সেই মহিয়ান সত্তা মাবরুর হজের বিনিময়ে জান্নাত দেয়া ছাড়া সন্তুষ্ট হবেন না।
হে আল্লাহর ঘরের হাজীরা, আপনাদের জন্য সৌভাগ্য। আপনাদের জন্য আল্লাহর ক্ষমা, মাগফিরাত ও সন্তুষ্টি। আপনাদের জন্য স্বদেশে নিরাপদ ও সফল প্রশংসনীয় প্রত্যাবর্তন। আপনাদের প্রচেষ্টা প্রশংসনীয় এবং প্রতিদান পরিপূর্ণ। আপনারা জীবনের সফেদ স্বচ্ছ নতুন পৃষ্ঠা শুরু করছেন এবং নবজীবনকে স্বাগত জানাচ্ছেন। আপনারা প্রত্যক্ষ করেছেন সম্মানিত ঘরের প্রান্তর, জমজম, হাতিম, মাকামে ইবরাহিম, সাফা-মারওয়া পবিত্র স্থানগুলো ও নবীজীর আলোকিত মদিনা ও রিয়াদুল জান্নাত।
অতএব, এ বৃহৎ দানের জন্য আনন্দিত হোন, আল্লাহ যা দিয়ে আপনাদের বিশিষ্ট করেছেন। এখানে পৌঁছা ও উপনীত হওয়ার মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। ওই সত্তার কসম, যিনি ছাড়া অন্য কোনো প্রভু নেই।
এ আপনাদের জন্য পৃথিবী ও পৃথিবীর সবকিছু থেকে উত্তম। পৃথিবীর সব সৌভাগ্য, স্বাদ ও চাকচিক্য থেকে শ্রেয়। আপনারা তাই খুশি ও আনন্দের অশ্রু ফেলুন। রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে হজ করল আর অশ্লীল-অনুচিত কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকল, সে যেন তার মা তাকে জন্ম দেয়ার দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে এলো।’ অন্য হাদিসে বলেছেন, ‘জান্নাতই কবুল হজের অবিকল্প পুরস্কার।’ নিষ্ঠাবান বান্দার ক্ষেত্রে মাবরুর হজ মূলত বিস্তৃত ব্যবস্থা, সৌভাগ্য-ঘরের চাবি ও নয়া প্রভাত উদয়ের নাম। যার পর জীবন হয় পবিত্র, আল্লাহর নূরে নূরান্বিত, তাঁর আনুগত্যে সমৃদ্ধ এবং দাসত্ব ও সন্তুষ্টির পোশাকে আবৃত। মাবরুর হজ অন্তরে এক অনুভবযোগ্য প্রভাব সৃষ্টি করে। ইবাদতে-আচরণে পূর্ণতম ও শ্রেষ্ঠতর পরিবর্তনের সূচনা ঘটায়। নিষ্ঠাবান বান্দা তাই হজ থেকে অধিকতর এখলাস ও সততা নিয়ে, শিরক, শিরকি উপকরণ ও শিরকপন্থীদের থেকে অধিকতর দূরত্ব নিয়ে এবং আল্লাহর জন্য অধিকতর বিনয়, নিবেদন, ভক্তি-ভালোবাসা ও জিকির নিয়ে বের হয়। এখানেই আমরা হজের আয়াতগুলোয় বিনয়ী-বিনতদের প্রসঙ্গ আনার তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারি। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তোমাদের ইলাহ এক, সুতরাং তাঁরই কাছে আত্মসমর্পণ করো এবং সুসংবাদ দাও বিনীতদের। যাদের অন্তর আল্লাহর ভয়ে কম্পিত হয় আল্লাহর নাম স্মরণ করা হলে, যারা তাদের বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ করে, সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদের যা দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে।’ (সূরা হজ : ৩৪-৩৫)
মাবরুর হজের প্রভাব পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছেন নিজ সময়কালের সেরা তাবেয়ি হাসান বসরি রহ:। এর তাৎপর্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘মাবরুর হজ হলো, হজের পর তুমি ফিরে আসবে দুনিয়াবিরাগী ও আখিরাতমুখী হয়ে।’ কারণ দুনিয়ার প্রতি বিরাগ ও আখিরাতের প্রতি অনুরাগ হলো গোপন তাকওয়াবানদের আলামত এবং খাঁটি ঈমানদারদের নিদর্শন। এটি দ্বীনের প্রতি অবিচলতা, সৎকাজে ধারাবাহিকতা ও পাপাচার থেকে আত্মনিবৃত্তির অন্যতম বড় নিয়ামক। আর সৎকাজে ধারাবাহিকতাই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ এবং আমল কবুলের উজ্জ্বলতম আলামত। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘আর যে তাওবাহ করে, ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে অতঃপর সৎপথে অটল থাকে, আমি তার প্রতি অবশ্যই ক্ষমাশীল।’ (সূরা হুদ-৮২)। লেখক : পিএইচডি গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।