ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। দুপুর ১২টায় আমরা নেপালে ত্রিভুবন বন্দরে পৌঁছি। আমরা সংখ্যায় ১৫ জন। দেখি, লোকজনে বন্দর ভর্তি। তিন দিকে তিনটি লাইন। যাত্রীদের লাইন বিমানবন্দরের চত্বর ছেড়ে সামনের রাস্তায় নেমে গেছে। গাইডের পরামর্শে আমরাও মাঝখানের লাইনে দাঁড়িয়ে ব্যাগসহ চাকাওয়ালা লাগেজ টানতে টানতে এক পা-দু’পা করে এগোচ্ছিলাম। আধা ঘণ্টা পর আমরা বিমানবন্দরের মূল গেট বরাবর পৌঁছাতে পারি। গেটে টানানো নেমপ্লেট অপরিচিত ঠেকায় জিজ্ঞেস করে জানতে পারি- এটি দিল্লিগামী বিমানের লাইন নয়। দিল্লিগামী বিমানের গেটে Jet Air Lines-নামীয় নেমপ্লেট টানানো আছে। শুরু হলো খোঁজাখুঁজি। পাওয়াও গেল। আমরা যেদিক থেকে এসেছি সে দিকের প্রথম লাইনটিই জেট এয়ার লাইন্সের। আমাদের এত দিনকার গাইড ও ড্রাইভার আমাদের মাঝখানের লাইনে দাঁড় করিয়ে বকশিশ নিয়ে চলে গেছে। জেট এয়ার ওয়েজের লাইনও চলে গেছে বিমানবন্দরের চত্বর ছেড়ে রাস্তার। রাস্তার দিকে লাইনের মাথায় তিনটি লেজ গজিয়েছে। কোনটি অরিজিনাল লেজ বোঝা যাচ্ছে না। এতক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে, তাই বুদ্ধি পাকিয়ে আমরা সমান তিন ভাগ হয়ে তিন লাইনের পেছনে দাঁড়াই। যে লাইন সামনে চলতে শুরু করবে বাকি দুই লাইন গিয়ে সে লাইনে আমাদের লোকের মাঝখানে ঢুকে পড়ব। শৈশবকাল থেকেই এসব কৌশল আমাদের রপ্ত করা। এখনো বই মেলায় ঢুকতে গিয়ে লম্বা লাইন দেখলে প্রথম এক পাক ঘুরে আসি। পরিচিত কাউকে পেলে চট করে পরিচিতের সামনে দাঁড়িয়ে যাই। পেছনের কেউ আপত্তি তুললে, পরিচিত জন বলে ওঠে- ‘আমার সাথের লোক ওয়াশরুমে গিয়েছিল।’ বন্ধুর খাতিরে ছোট্ট একটি মিছে কথাসহ একটু অভিনয় ঠিকঠাক মতো করতে না পারলে কিসের বন্ধু! বন্ধুর মাধ্যমে এ ধরনের সুবিধা নেয়ার কৌশলকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘ফ্রেন্ডশিপ টেকনোলজি’।
তিনটি লাইনের মাঝখানের লাইনটি এক পা-দু’পা করে এগোচ্ছিল। আর অপর দুটো ছিল ডেড লাইন। এখন ডেড লাইন থেকে ফ্রেন্ডশিপ টেকনোলজির মাধ্যমে লিভ লাইনে ঢুকে পড়ার পালা। ‘লিভ’ লাইনে আমাদের চার ট্যুরিস্টের পেছনে একজোড়া বুড়ো দম্পতি। দম্পতির বয়স অশীতিপরের ওপরে। ইয়া বড় বপু, লম্বা ও চওড়া হলে কি হবে বয়সভারে ন্যুব্জ। ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ। আমরা ফ্রেন্ডশিপ টেকনোলজি কার্যকর করতে গেলে এ বুড়ো দম্পতি চোখ তুলেও তাকাবে না। সবদিক নিরাপদ। প্রথমে জাহাঙ্গীর ভাই ফ্রেন্ডশিপ টেকনোলজি শুরু করেন। আমাদের চারজন দুই ভাগ হয়ে মাঝখান ফাঁক করতেই লাগেজসহ সস্ত্রীক চট করে লাইনে ঢুকে পড়ে জাহাঙ্গীর ভাই।
বুড়ো দম্পতি আমাদের বাংলা ভাষা বুঝতে না পারলেও আমরা কী করতে যাচ্ছি আন্দাজ করতে পেরেছিল। তারাও এ সময়টুকুর অপেক্ষায় ছিলেন। লাইনের মাঝখানে জাহাঙ্গীর প্রবেশের সাথে সাথে দম্পতি বিজাতীয় ভাষায় গালিগালাজসহ বন্দুকের গুলির মতো ছুটে এসে ডান হাতে এক পাক মারতেই জাহাঙ্গীর ভাই লাইনচ্যুত হয়ে তিন হাত দূরে ছিটকে পড়েন। পাক্কা ছয় ফুট উঁচু- গালিভারের মতো শরীর থুত্থুরে বুড়ো কাজটা করল কী! ছুটে আসে আমাদের ছোটখাটো সাইজের সুদর্শন দলনেতা। সে বাংলা হিন্দি মিলিয়ে পাঁচমিশালি ভাষায় গালাগালসহ সজোরে ধাক্কা মারে বুড়োকে। নাড়াতে পেরেছে বলে মনে হয় না। বুড়ো পেছন ফিরে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে দলনেতার দিকে তাকিয়ে বলে,‘You clever boy don’t touch me.’.
বুড়োর কত্ত বড় সাহস! আমাদের দলনেতাকে ক্লেভার বয় বলে গালি দিচ্ছে- আজকে একটা কিছু হয়ে যাবে। বুড়োর একদিন কি আমাদের একদিন, বলেই মারামারিতে লিপ্ত হওয়ার জন্য আমরা আস্তিন গুটাতে শুরু করি। এর মধ্যে আমাদের তিন তরুণ ঘিরে ফেলেছে বুড়োকে। এতক্ষণে জাহাঙ্গীর ভাইও সোজা হয়ে গেছে, ঘুষি পাকিয়ে তেড়ে আসছে সেও। বুড়িটাও যোগ দিয়েছে বুড়োর সাথে। বুড়োর গায়ে সমানে কিল-ঘুষি পড়তে শুরু হয়েছে। আমাদের কিল-ঘুষি বুড়ো কতটুকু টের পেয়েছে জানি না কিন্তু টের পেয়ে গেছে বামন সাইজের নেপালি পুলিশ। চার-পাঁচজন পুলিশ ছুটে এসে আমাদের হাত থেকে বুড়োকে উদ্ধার করে। পুলিশ সব শুনে আমাদের সবাইকে এক লাইনে এনে আমাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় বুড়ো দম্পতিকে। বুঝতে পারলাম, নেপালিরা বাঙালিদের সমীহ করে। আমরা স্বস্তি পেলেও আমাদের পেছনে অনেকের মাঝে চাপা উত্তেজনা শুরু হয়েছিল। তারপরও আমাদের রাগ পড়ছিল না। কারণ মারতে গিয়ে আমরা ক্লান্ত হলেও আমাদের সম্মিলিত ঠেলা-ধাক্কা-কিল-ঘুষিতে বুড়োর কিছু হয়েছে বলে মনে হলো না। যে লোকটাকে নিয়ে এত গবেষণা সে লোকটা বুড়ো নয়; বরং আমাদের চেয়েও জোয়ান, হাতের পেশী দিয়ে শক্তি যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট খেলোয়াড় ম্যাকগ্রার চেয়েও উঁচু ও পেশীবহুল। ভাগ্যিস মারামারির মাঝখানে নেপালি পুলিশ এসে দু’ভাগ করে ফেলেছিল নয়তো আরো দু-একজনকে জাহাঙ্গীর ভাইয়ের ভাগ্যবরণ করতে হতো। এ ইউরোপিয়ান অসুরটার পেছনে পেছনেই গেট দিয়ে বিমানবন্দরের ভেতরে প্রবেশ করি। ভেতরে প্রবেশ করেই দেখতে পাই, লোকজন নানা স্থানে বসে নিবিষ্ট মনে কী যেন লেখালেখি করছে। লেখালেখিতে যত মনোযোগী দেখলাম, সচরাচর হলে পরীক্ষার্থীদেরও তত মনোযোগী হতে দেখা যায় না। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, জেট এয়ারলাইন্সের যাত্রীরা এম্বারকেশন কার্ড পূরণ করছে। ইংরেজি ও হিন্দিতে লেখা এম্বারকেশন কার্ড যার মধ্যে ক্যাপিটাল অক্ষরে যাত্রীর নাম (পাসপোর্টের নামানুসারে); জন্ম তারিখ, যাত্রার তারিখ, পাসপোর্ট করার তারিখ, বৈধতার তারিখ, ফ্লাইট নাম্বার, ভ্রমণের উদ্দেশ্য, যে হোটেলে ছিল সে হোটেলের নাম, যে হোটেলে উঠবে সে হোটেলের নাম লিখতে হবে। ইচ্ছামতো লিখলে হবে না, লিখতে হবে বর্ণক্রমিক অনুসারে- অর্থাৎ ZOINUL ABEDIN না লিখে ABEDIN MD. ZAINUL লিখতে হবে।
সাধারণ মানুষের কথা আলাদা, আমার মতো প্রথম শ্রেণীর নাগরিকই তা পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। শক্ত সামর্থ্য পুরুষদের লাইনে রেখে, মহিলা-শিশুদের নিরাপদ স্থানে বসার সুবন্দোবস্ত করে, আমরা ক’জন লেখালেখির কাজে বসে গেলাম। বহুবার বিমানে উঠেছি। কিন্তু এই রুটের মতো এরকম টপ টু বটম এম্বারকেশন কার্ড পূরণ করতে হয়নি কোথাও। ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা কি না ভারত প্রবেশের জন্য এ রুটটি ব্যবহার করে থাকে। তাই ভীষণ কড়াকড়ি। দু’পার্টে বিভক্ত এম্বারকেশন কার্ডের একাংশ বিমানবন্দরে রেখে অপরাংশ নিয়ে দেশের ভেতরে প্রবেশ করতে হবে। আবার দেশ ত্যাগ করার সময় অপরাংশ প্রদর্শন করাতে হয়। সন্দেহ হলে ইন্ডিয়ান কর্তৃপক্ষ এম্বারকেশন কার্ডে উল্লিখিত তথ্যাবলি পরীক্ষা করে দেখতে পারে। আমার ধারণা, বিদেশ গমনাগমনের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করা যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিমানের টিকিট, পাসপোর্ট, বোডিং কার্ড, এম্বারকেশন কার্ড, পরীক্ষা-নিরীক্ষার নিমিত্ত বারবার বের করা, আবার মিল করে যথাস্থানে রেখে দেয়া, বড় লাগেজে স্ক্যানিংসহ নিরাপত্তা শিল্ড লাগানো, ওজন করে ল্যাবেল মেরে ল্যাবেলের বাকি অংশ সংরক্ষণ করা, হাতব্যাগ স্ক্যানিংসহ ঘাঁটাঘাঁটির পর নিরাপত্তা শিল্ড লাগিয়ে নেয়া, হরেক রকমের টিকিটের মধ্য থেকে প্রয়োজনীয় টিকিটটি বের করে বিমানকর্তাদের হাতে বুঝিয়ে দেয়া এবং সমস্ত বডি তল্লাশি করতে দেয়া।
বিনা ভিসায় নেপালে এসে ভিআইপি মর্যাদায় নতুন দুলামিয়ার মতো কাটিয়ে গেলাম। পার পেয়ে গেলাম মারামারি করেও। নেপালের ইমিগ্রেশন পার হতেই বুঝতে পারলাম, দুলামিয়ার মর্যাদা শেষ। বাংলাদেশী পরিচয় পেলেই সম্মানের বদলে সবাই অনুকম্পার দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে। অনুকম্পা কেন দেখাবে না! আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তিতেও কি না তাদের শেয়ার আছে। নেপালিদের কাছে সাধারণ বাঙালি যতটুকু ভিআইপি, সাধারণ ভারতীয়রাও আমাদের কাছে ততটুকু ভিআইপি। ওদের কেউ বাংলাদেশে গেলে আমরা সেবাযতœ করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ি। আমাদের বেলায় তারা ঠিক উল্টো আচরণটিই করে থাকে। এতসব আজেবাজে ভাবনা শেষ হতে না হতে জেট বিমানের গাড়ি এসে হাজির হয়। ফ্লোরে নামিয়ে রাখা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটতে শুরু করি। কার আগে কে যাবে, এ নিয়ে শুরু হয় দৌড়াদৌড়ি। আমরা বাসের কাছাকাছি পৌঁছার আগেই বাস ছেড়ে যায়। দু’-এক মিনিটের মধ্যে অপর একটি বাস আসে। বিমানের কাছাকাছি গিয়ে দেখি, ইয়া লম্বা লাইন। বিমানের সিঁড়ি গোড়ায় লাইনের মাথা আর লেজ চলে গেছে ৪০ গজ দূরে। আমরা লেজের দিকে দাঁড়াতে শুরু করি। সিঁড়ি গোড়ায় জনাচারেক সিকিউরিটি আর সিঁড়ির ওপরে বিমানের দরজার কাছে দু’জন সিকিউরিটি। লাইনের মাথা থেকে একজন একজন করে প্যাসেঞ্জার সিঁড়ি গোড়ার সিকিউরিটির কাছে যায়। সিকিউরিটি সদস্যরা প্রথমে প্যাসেঞ্জারের শরীর তল্লাশি করে। তারপর ব্যাগের চেইন খুলে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দেয়। ব্লেন্ডারের চর্কির মতো আঙুল ঘোরাতে শুরু করে। হাতে সন্ধিগ্ধ কিছু ঠেকলেই বের করে আনে। ক্রিম, শ্যাম্পু, পেস্টের টিউব কিছুই বাদ দেয় না। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর শতভাগ সন্দেহমুক্ত হয়ে ব্যাগের গায়ে Checked মর্মে টোকেন লাগিয়ে ওপরে ওঠার ইশারা দেয়। সিঁড়ির ওপরের মাথায় যেতেই আবারো সিকিউরিটি। তিনি দেখেন, সিল টোকেন ঠিকমতো আছে কি-না। সব ঠিকঠাক মতো মিলে গেলে অমিতাভ বচ্চনের মতো একটি মুচকি হাসি মেরে বিমানের ভেতরে প্রবেশের পথ দেখিয়ে দেন।
মাঝারি আকারের বিমানের মাঝামাঝি বামদিকে আমার সিট। এখন বোডিং কার্ড দেখে নিজেই সিট খুঁজে বের করতে পারি। আমার বাম দিকের সিটে জানালার পাশে একজন ইউরোপীয়ান ও ডান দিকের সিটে মধ্য বয়সী এক চাইনিজ ভদ্রলোক। জানালার পাশে বসতে না পেরে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বিমানে বসে বাইরের নিসর্গ বিশেষ করে হিমালয় রেঞ্জ দেখার ইচ্ছে বুঝতে পারেন ইউরোপিয়ান ভদ্রলোক। আমার উৎসুক ভাব দেখে ভদ্রলোক ইচ্ছে করেই হেলান দিয়ে বসেন। ফলে আমি আমার সিটে দাঁড়িয়েই বাম দিকের জানালা দিয়ে দেখতে পাই। পূর্ব-পশ্চিমে যতদূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। সবগুলো পাহাড়ই ঢেকে রয়েছে সাদা তুষারে। ভূমির দিকে তাকালে দেখা যায় সাদা সুতার মতো অসংখ্য ঝরনা, নদী ও খাল। পর্বতমালায় ১২ মাসই তুষার জমে থাকে। দক্ষিণের সাগর থেকে বাষ্প হয়ে উড়ে আসে সাদা-কালো মেঘ। এসব মেঘ পাহাড়-পর্বতের কাছাকাছি আসতেই জমে বরফে রূপান্তর হয়। কালো মেঘ অল্পক্ষণের মধ্যেই ধবধবে সাদা হয়ে ওঠে। সূর্য ওঠা-ডুবার সময় সাদা তুষারকন্যারা রঙ বদলায়। সূর্য ‘দক্ষিণ গোলার্ধ’ থেকে ‘উত্তর গোলার্ধে’ পৌঁছালে জমাটবাঁধা তুষার গলতে শুরু করে। বরফ গলা পানি নেমে আসে নদী-নালা-খাল-ঝরনা দিয়ে। পাক-ভারতে শুরু হয় বর্ষাকাল। ঋতু পরিবর্তনের এ রকম লীলাখেলা চলে আসছে লাখো বছর ধরে। বিকেলের রোদ বাম দিকের নদী ও ঝরনার পানিতে পড়ে আলো ঠিকরে চিকচিক করছে। ওপর থেকে পানিগুলো দেখতে যত শান্ত মনে হচ্ছে এগুলো কিন্তু তত শান্ত নয়। কঠিন পাথরের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয় ওদের। কোনো কোনো নদীর স্রোতের গতি শত কিলোমিটারেরও বেশি। বাম দিকে নদী আর ডান দিকে হিমালয় পর্বতমালা। এই একই প্রকারের দৃশ্য যেন ফুরোয় না। বিমানবালা গরম পানিতে ভিজানো টিস্যুপেপার বিতরণ শুরু করেছে। সদ্য ফ্লাস্ক থেকে বের করা গরম গরম টিস্যুপেপার কি উদ্দেশ্যে বিতরণ করছে তা বোঝার জন্য এদিক ওদিক তাকাই। দেখি আমার পাশের ভদ্রলোক টিস্যুপেপার খুলে আস্তে আস্তে মুখম-ল মুছছে। রিফ্রেশিং টিস্যুপেপার। বিমানবন্দরে এসে তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বিমানে পৌঁছা পর্যন্ত শরীর ও মনের ওপর যে ধকল গেছে তা মুছতে হলে কয়েকটি Refreshing Tissue Paper দরকার।
আমিও আমার টিস্যুপেপার দিয়ে আস্তে আস্তে মুখম-ল ঘষতে শুরু করি। আরাম লাগতে শুরু করে আর ভাবতে শুরু করি। বুদ্ধি আছে ইন্ডিয়ানদের মাথায়। যাত্রী প্রতি ১০ পয়সা মূল্যের একটি টিস্যুপেপার বিতরণ করে লাখ টাকার মন জয় করে নিলো। জবভৎবংযরহম ঞরংংঁব চধঢ়বৎ দিয়ে হাত-মুখ মোছা শেষ করতে না করতে খাঞ্চা ভরা চকোলেট নিয়ে কাছে আসে বিমানবালা। এগুলোর মধ্যে কোনটি ঝাল, কোনটি মিষ্টি, আবার কোনটি ঝাল-টক-মিষ্টি, মুখে না দিয়ে বোঝার জো নেই। সব রকমের স্বাদ চেখে দেখার জন্য পাঁচ-ছয়টি চকোলেট রাখি। ইউরোপিয়ান ভদ্রলোক অনেকগুলো চকোলেট থেকে বাছাই করে তিনটি চকোলেট রাখেন। আর চায়না ভদ্রলোক হাতের মুঠোয় যে পরিমাণ চকলেট নিতে পেরেছেন, সে পরিমাণ নিয়েছেন। বিমানবালা সামনের দিকে চলে যেতেই পায়ের কাছে রাখা হাতব্যাগ টেনে চেইন ফাঁক করে সব চকোলেট পাঠিয়ে দেন ব্যাগের ভেতর। পেছনে দিক থেকে ট্রলিতে করে চা-কফি-বিয়ারসহ ফলের রস নিয়ে আসে একজন। নেপাল আসার সময় কসমিক এয়ারওয়েজের অভিজ্ঞতা থেকে, বিমানবালাকে জিজ্ঞেস করি গধু ও get these drinks by paying money or without pay?
– You can take it without paying money.
চাইনিজ ভদ্রলোক বিয়ারের ক্যানসহ এক এক করে সব রকমের জুস রাখেন। একইভাবে ব্যাগের ভেতর রেখে ব্যাগে চেইন বন্ধ করে ফেলেন। পরিশেষে লাঞ্চ প্যাকেট নেন। আমার কাছে এসে, ‘Are you vegetarian or not?’ প্রশ্ন করার সাথে সাথে,‘Yes I am a vegetarian’ আমার ঝটপট উত্তর শুনে বিমানবালা সবজিযুক্ত বক্স আমার সামনে রেখে চলে যায়। পাশের চায়না ভদ্রলোক চিকেনযুক্ত বক্স রেখেছেন। একই সময় খেতে বসে বুঝতে পারি, ঠবমবঃধনষব নিয়ে আমি ঠকেছি। যাত্রাবাড়ী আড়তে এসব সবজির জন্য পা রাখা যায় না। পরে জানতে পেরেছি ‘ভেজিটারিয়ান’ অর্থ নিরামিশভোজী। আমি কোনো দিনও নিরামিশভোজী ছিলাম না, এখনো নই। সুন্দরী বিমানবালার প্রশ্নের পৃষ্ঠে ঠাস ঠাস উত্তর দিতে গিয়ে নিরামিশভোজী হয়ে গেছি। আসলে আমার এই এক দোষ। কেউ কোনো প্রশ্ন করলে ঝটপট উত্তর দিয়ে ফেলি। বিশেষ করে সুন্দর রমণীদের প্রশ্ন শোনার পর মাথা ঠিক থাকে না। কণ্ঠ ব্রেনের সাথে বুঝাপড়া না করেই চটপট উত্তর দিয়ে ফেলে। উত্তর শেষ করার পর বুঝতে পারি, আমি যে উত্তর দিয়েছি তার চেয়েও সুন্দর উত্তর আমার ব্রেনে জমা ছিল। আসলে সুন্দরীরা কিছু জানতে চাওয়ার সাথে সাথে উত্তর দেয়া পৌরুষত্বের লক্ষণ। উত্তর শুদ্ধ হলো কি, ভুল হলো- তাতে কিছু যায় আসে না। পৌরুষত্ব ঠিক রাখা চাই। এ কারণে বিগত দিনে ঝামেলাও কম পোহাতে হয়নি। এক সময় মনে করতাম, বাংলাদেশ থেকে উত্তর-পূর্বে নেপাল। আর দিল্লি হলো সোজা পশ্চিমে। উজবেকিস্তান এয়ারওয়েজে একবার দিল্লি হয়ে উজবেকিস্তান গিয়েছিলাম। রাতের বিমানে নেপাল আসার কারণে দিকটিও ঠিক করতে পারিনি। ঢাকা থেকে দিল্লি সময় লেগেছিল দু’ঘণ্টা। আর ঢাকা থেকে আড়াআড়ি কাঠমা-ু পৌঁছতে সময় লেগেছে সোয়া ঘণ্টা। কাঠমা-ু টু দিল্লি ঘণ্টা তিনেক বিমানে থাকতে হবে। ঘণ্টা দেড়েক পার হতে না হতেই যাত্রীদের চঞ্চলতা থেকে বুঝতে পারি বিমান ল্যান্ড করতে বেশি বাকি নেই। আমার হিসাব প- করে বিমানের স্পিকারে অবতরণ-বিষয়ক ঘোষণা শুরু হয়ে গেছে। হিসাবে ভুল না হলেও ধারণায় গলদ ছিল। বাংলাদেশ থেকে নেপালের অবস্থান উত্তর-পূর্বে নয়; বরং উত্তর-পশ্চিমে।
‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়’ প্রবাদবাক্যটি কতটুকু সত্য জানি না, তবে এইটুকু জানি, ‘কূপম-ূক’ মুক্তবুদ্ধিসহ জ্ঞান বিকাশের বড় অন্তরায়। চরিত্র, ব্যবহার, আচার-আচরণ, নৈকিকতা ও আদর্শ সম্পূর্ণ অর্জিত বিষয়, যা দেশভ্রমণে সহজে অর্জন হয়। ইসলাম দেশভ্রমণকে সমর্থন করে। ভ্রমণের আরবি অর্থ সফর। ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভের অন্যতম হজ অর্থও সফর, ওমরাহ অর্থও সফর। কূপম-ুকতা দূর করার অন্যতম নিয়ামত ভ্রমণ। বিমানবন্দরসহ বিমানে কয়েক ঘণ্টায় যা দেখলাম ও শিখলাম, স্কুল-কলেজে তা শিখতে পারিনি কয়েক বছরেও। (ভ্রমণ সময়কাল নভেম্বর-২০০৫) লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail: adv.zainulabedin@gmail.com