উত্তরবঙ্গে এখন আমের পূর্ণ মৌসুম। যদিও উত্তরবঙ্গ বেড়াতে যেতে সিজন অফ-সিজনের ব্যাপার নেই। তবে আমের মৌসুমে ভ্রমণ করলে দিগন্ত বিস্তৃত আমবাগান এবং আমের বিশাল বাজার ছাড়াও বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি প্রত্মতাত্ত্বিক অঞ্চল ঘুরে আসা যায়। সেবার আমরা গিয়েছিলাম আমের মৌসুমে। বিশ্ব ঐতিহ্য পাহাড়পুর, বাংলাদেশের প্রাচীনতম প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন মহাস্থানগড়, সীতাকোট বিহার, অপরূপ কারুকার্যখচিত কান্তজির মন্দির, সুলতানী আমলের নিদর্শন বাঘা মসজিদ, কুসুম্বা মসজিদ, ছোট সোনামসজিদ, দাড়াসবাড়ি মাদ্রাসা, পুঠিয়া রাজবাড়ী, রাণী ভবানীর বাড়ি, রংপুরের তাজহাট জমিদার বাড়িসহ আরো অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে উত্তরবঙ্গজুড়ে। অবশ্য উত্তরবঙ্গ ভ্রমণে এলাম আর ঘুরে গেলাম ঠিক এভাবে হওয়া ঠিক নয়। এই অঞ্চলের ইতিহাস জানার জন্য দ্বারস্থ হতে হয় নানা বইপত্রের। ভ্রমণের সাথে একজন পর্যটকও যাত্রা করেন বাংলার লুপ্ত ইতিহাসের নানা প্রান্তরে। বিষয়টি শুধু প-িতের কাজ নয়। প্রকৃত উৎসাহী একজন ভ্রমণকারীও যুক্ত করতে পারেন মূল্যবান উপাদান। যদিও গভীর মনোনিবেশের অভাবটা এখন সর্বত্র। উত্তরবঙ্গ ভ্রমণে উল্লেখিত নিদর্শনগুলো দেখতে মৌসুমের কোনো বিষয় না থাকলেও গ্রীষ্মকালে আম ও লিচুর মৌসুমে রাজশাহী অঞ্চল ভ্রমণ করলে আমবাগান ঘুরে দেখা চমৎকার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই। বিশেষত চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও দিনাজপুর ভ্রমণে একসঙ্গে ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় ও পাশাপাশি মৌসুমী ফলাহারের স্বাদ দারুণ মাত্রা যুক্ত করতে পারে। ‘আম পাকে বৈশাখে, কুল পাকে ফাগুনে’ পাকা আমের একেবারে শুরুর দিকের স্বাদ পেতে হলে বৈশাখ-জৈষ্ঠে যেতে হবে চাঁপাইনবাবগঞ্জে। ২০০৬ সালের আমের মৌসুমের কোনো এক বিকেলে আমরা ৪ বন্ধু আমের দেশে রওয়ানা হয়ে গেলাম। গন্তব্য প্রথমে রাজশাহী বন্ধু টিটুর বাসায়। বিমানে চাকরির সুবাদে তার এখন রাজশাহীতে পোস্টিং। সেখানে একরাত থেকে পরদিন আমের দেশ চাঁপাই যাব। অবশ্য আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনায় চাঁপাই’র আমবাগান তো আছেই, আরো আছে গৌড় রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন ছোট সোনামসজিদ এবং দাড়াসবাড়ি মাদ্রাসা। আশেপাশের বাদবাকী নিদর্শনগুলো তো থাকছেই। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়াও আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনায় রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর, নাটোরের পুঠিয়া রাজবাড়ী, রাণী ভবানীর বাড়ি বা উত্তরা গণভবন ইত্যাদি স্থানগুলোও রয়েছে। সব মিলিয়ে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সন্ধানে বেশ একটি ‘শিক্ষামূলক’ ভ্রমণ বলা যেতে পারে। দেখা যাক, এবার আমরা কতটা ভ্রমণের আনন্দ আর কতটা ‘শিক্ষা’ নিতে পারি। যথাসময়ে বন্ধু জাহিদ, সুজন ও বাকীউল এসে উপস্থিত বাস কাউন্টারে। বাসটি কিছুটা বিলম্বে রওয়ানা হলো রাজশাহীর উদ্দেশ্যে। একে একে পার হলাম সাভার, নবীগঞ্জ, চন্দ্রা, কালিয়াকৈর, মির্জাপুর, টাঙ্গাইল এবং স্বপ্নের যমুনা সেতু। যখন আমরা বাংলাদেশের (সে সময়ের) দীর্ঘতম সড়ক ও রেলসেতু অতিক্রম করছিলাম তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। সেতুর সবকটা বাতি জ্বলে উঠেছে। সেতুর উপর দিয়ে দ্রুতই পার হয়ে গেলাম যমুনা নদী। আমরা রাত দশটার মধ্যেই পৌঁছে যাই রাজশাহী শহরে। টিটু বাস কাউন্টারে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল। চা পর্ব সেরে আমরা টিটুর বাসার দিকে যাত্রা করি। সারারাত বাঙালির আড্ডা না হলে যে ভাত পরিপাক হয় না, তার প্রমাণ না দিলে তো চলে না। রাতের আহারের পূর্বেই আমরা ক্ষুধা উদ্রেককারী আড্ডায় মশগুল হয়ে পড়ি। আড্ডা দিতে দিতে রাতের আহার সারি। আহার শেষে খাবার পরিপাকের জন্য আবার মধ্যরাত অবধি আড্ডা চলে। আড্ডায় সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে দেহতত্ত্ব পৃথিবীর এমন কোনো বিষয় বাদ থাকে না। আমাদের আড্ডার অন্যতম মধ্যমণি হয়ে থাকেন টিটুর অফিসের সিনিয়র সহকর্মী অভিজিৎ বড়ুয়া। আমাদের প্রিয় অভিজিৎদা।
বাংলাদেশের আম, রেশম, স্থল বন্দর, ঐতিহাসিক ছোটো সোনা মসজিদ এবং ঐতিহ্যবাহী গম্ভীরার দেশ চাঁপাইনবাবগঞ্জ। বরেন্দ্রভূমি, পদ্মা, মহানন্দা, পূনর্ভবা, নন্দশুজা নদীর অববাহিকার পলিমাটি সমৃদ্ধ চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রায় সারাবছর সবুজ শ্যামল। এক সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জ মুর্শিদাবাদের নবাবদের মৃগয়াক্ষেত্র ছিল। মালদহ এবং রাজশাহী জেলার অন্তর্ভূক্ত নবাবগঞ্জ মহকুমাকে ১৯৮৪ সালে জেলা ঘোষণা করা হয়। মুর্শিদাবাদের নবাবরা এখানে এসে তাঁবু স্থাপন করে শিকার ও অবকাশ যাপন করতেন। তার জন্য স্থানটির নাম নবাবগঞ্জ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তাছাড়া নবাবগঞ্জের অদূরে মহেশপুর নামক স্থানে একজন আলোচিত বাঁইজি থাকতেন। তার নৃত্যে নবাবরা খুশি হয়ে তাকে ‘চম্পারাণী’ ডাকতেন। যে কারণে চম্পারাণী নামের অপভ্রংশ চম্পাবাই থেকে ক্রমে ‘চাঁপাই’ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। নবাবদের তাঁবু ফেলার স্থানকে ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ’ বলা হয়। সেদিন আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র ছোট সোনামসজিদ। শিবগঞ্জ উপজেলায় এর অবস্থান। প্রায় ৪শ বছর পূর্বে মোঘল সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে ওয়ালী মোহাম্মদ এটি নির্মাণ করেন। এর নির্মাণকাল ১৪৯৩ হতে ১৫১৯ সাল পর্যন্ত। মসজিদটিতে মোঘল স্থাপত্যের নিদর্শন রয়েছে। মসজিদের দৈর্ঘ্য ৮২ ফুট, প্রস্থ ৫২ ফুট এবং উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। এতে ১৫টি ছোটো-বড়ো গম্বুজ রয়েছে। প্রত্যেকটি গম্বুজ কারুকার্যখচিত। মসজিদের উত্তর কোণে রয়েছে একটি বৃহৎ দীঘি। এর পাশেই রয়েছে দু’টি অতিকায় আকৃতির পাথর। এদের একটিকে জিন্দা ও অপরটিকে খুদা পাথর বলা হয়। মসজিদের আঙিনায় রয়েছে নির্মাণকারী ওয়ালী মোহাম্মদ এবং তার নিকটাত্মীয়ের কবর। মসজিদ কম্পাউন্ডের ভেতরেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সৈনিক বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। সোনামসজিদের অদূরে অবিস্থত তোহাখানা। এটি মূলত একটি কবরস্থান। সুলতানী আমলে সুলতানের নিকটাত্মীয় এবং সৈন্যদের কবর দেয়া হতো এখানে। তোহাখানার পাশে একটি বিশাল দীঘি রয়েছে। তোহাখানা এবং সোনামসজিদ একটি পিকনিট স্পট। সোনামসজিদের অভ্যন্তরে বাদশাহের বসার স্থানকে ‘বাদশা কা তখ্ত’ বলা হয়। এ ছাড়া এই মসজিদে নারীদের নামাজ পড়ার জন্য আলাদা একটি জেনানা গ্যালারী আছে। তোহাখানার দীঘির কোল ঘেষে আছে একটি হাওয়াখানা। যার প্রায় একতলা অংশ পানি এবং মাটির নিচে অবস্থিত মসজিদের খানিক দূরেই দেখতে পাই বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর। এই বন্দর সোনামসজিদ নামেই পরিচিত। স্থলবন্দরে দাঁড়ালেই পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার গৌড় রাজ্যের সীমানা প্রাচীর নজরে পড়বে। বন্ধু টিটু চাঁপাইনবাবগঞ্জের আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্যতম একটি উপজেলা ভোলাহাট। ভোলাহাটে বাংলাদেশের অন্যতম রেশম উৎপাদন কেন্দ্র। ভোলাহাটের গ্রামগুলোতে রেশম শিল্প সংশ্লিষ্ট কাজকর্ম দেখা যাবে। কানসাট হলো চাঁপাই নবাবগঞ্জের আমের রাজধানী। দেশের সুবিখ্যাত আম বাগানের উপস্থিতি এখানে সবচেয়ে বেশি। যেদিকে দৃষ্টি দেয়া যায় চারিদিকে শুধু আমবাগান আর আমবাগান। এখানে প্রায় শতাধিক প্রজাতির আম উৎপন্ন হয়। আমরা অবশ্য কানাসাট হয়েই শহরে ফিরবো। নাচোল থানার কথা আসলে আমাদের স্মরণ করতে হবে ইলা মিত্রের নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস। এখানকার আপামর জনগণের ‘রাণীমাতা’ ইলামিত্রের বাড়ি নাচোলে। তাই চাঁপাইনবাবগঞ্জ ভ্রমণের সময় নাচোলের ‘রাজবাড়ী’ দেখে যাওয়া ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু ভ্রমণপিপাসুদের জন্য অন্যতম আকর্ষণ। এ ছাড়া নাচোলের লালমাটির দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের পাশে সাঁওতাল পল্লীর আদিবাসীদের সহজ সরল জীবনাচারণ ও তাদের উন্নত সংস্কৃতি অবলোকন ভ্রমণ অভিজ্ঞতার ঝুলিকে আরো সমৃদ্ধ করবে। সময়াভাবে আমরা নাচোল বা সাঁওতাল পল্লীতে এবার যেতে পারিনি।
সারাদিন চাঁপাই-এর প্রায় সকল দর্শনীয় স্থান, আমবাগান, স্থল বন্দর দেখে বাসে চেপে বসি রাজশাহীর উদ্দেশ্যে। পরদিন আমাদের রাজশাহী শহর ভ্রমণ শেষে রাতে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার কথা। রাজশাহী পৌঁছে যথারীতি আড্ডায় মেতে থাকি। দ্বিতীয় দিন রাজশাহী শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো একে একে ঘুরে বেড়াই। এর মধ্যে রাজশাহী বরেন্দ্র জাদুঘর ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এই জাদুঘরে এককভাবে সবচেয়ে বেশি প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। এ ছাড়া পদ্মার পাড়ে সময় কাটানোটাও ছিল আমাদের বাড়তি আনন্দের। যদিও ভারতে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে রাজশাহীর পদ্মা শুকিয়ে গেছে অনেকটা। তবে সাম্প্রতিককালে রাজশাহী শহরে পরিকল্পিতভাবে ব্যাপক বৃক্ষরোপণ ও সবুজায়নের ফলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি অক্সিজেনসমৃদ্ধ নগরী হিসাবে রাজশাহী আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে। যাই হোক, সকালে আমরা রওয়ানা হয়ে যাই ঢাকার উদ্দেশ্যে। পেছনে ফেলে আসি এক অসাধারণ ভ্রমণ অভিজ্ঞতার স্মৃতি।