কুরবানির ঈদ মুসলিম সমাজের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এ উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ কুরবানি বা পশু জবেহ। ইসলামি বিধান মতে, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে সামর্থবান প্রত্যেক মুসলিমকে পশু জবেহর মাধ্যমে কুরবানি করতে হয়। তবে পশু জবেহ কুরবানির মূল লক্ষ্য নয়। এটি বাহ্যিক বিষয়, এর অভ্যন্তরীণ আরও গভীর তাৎপর্যময়। কুরবানির মাধ্যমে মহান আল্লাহর নির্দেশ পালনে সর্বোচ্চ ত্যাগের পরাকাষ্টা দেখানো হয়। এ জন্য মানবমনের হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, অহংবোধ ইত্যাদি পাশবিক শক্তির বিনাশ করতে হয়। অন্য দিকে ধৈর্য-ত্যাগ, সততা-নিষ্ঠা ইত্যাদি মানবিক গুণাবলীর বিকাশ করতে হয়। এভাবে যথাযথ কুরবানির মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি-সান্নিধ্য লাভ করা যায়। এতে মানবজীবন সার্থক ও সুন্দর হয়।
কুরবানির ঐতিহ্য অনেক পুরনো। প্রথম মানব হযরত আদম (আ.)-এর পুত্র হাবিল ও কাবিল থেকেই কুরবানি শুরু হয়। তাদের উভয়ের কুরবানির মধ্যে মহান আল্লাহর নিকট হাবিলের কুরবানি কবুল হয়। অন্যান্য নবি-রাসুলদের যুগেও কুরবানির ইতিহাস পাওয়া যায়। তবে সব নবি-রাসূলের কুরবানির পদ্ধতি এক নয়। আধুনিক ইসলাম তথা উম্মাতে মুহাম্মাদির কুরবানিতে মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর পদ্ধতির অনুসরণ করা হয়। আল-কুরআনের সূরা সফ্ফাতে হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর পশু কুরবানির এক লোমহর্ষক কাহিনী জানা যায়। এতে উল্লেখ করা হয়, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে স্বপ্নের মাধ্যমে হযরত ইবরাহিম আলাইহিস্ সালামকে তাঁর প্রিয় বস্তু কুরবানির নির্দেশ দেয়া হয়। স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে হযরত ইবরাহিম (আ.) একটি মেষ কুরবানি করেন। পরের রাতে তিনি আবারও একই স্বপ্ন দেখেন। পরদিন তিনি তাঁর পালের সবচেয়ে বড় ও মোটা-তাজা মেষ কুরবানি করেন। এতেও কোন ফল হলো না। স্বপ্নে তিনি আবারও প্রিয়বস্তু কুরাবানির জন্য আদিষ্ট হলেন। এতে তিনি তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইলকে কুরবানির ই্িঙ্গত পেলেন। তাই তিনি ঘুম থেকে জেগে সুযোগ বুঝে পুত্র ইসমাইলকে ডেকে স্বপ্নের কথা জানালেন। এতে ইসমাইল অত্যন্ত সাহসের সাথে দৃঢ়ভাবে পিতার প্রস্তাবে সায় দিলেন। বললেন, ‘এ তো সৌভাগ্য আমার! আল্লাহর জন্য কুরবানি হওয়ার সুযোগ কয় জনের হয়! সুতরাং আপনি আল্লাহর আদেশ পালন করুন নির্দ্ধিধায়।’ কিভাবে নিজ হাতে পুত্রকে কুরবানি করবেন এ নিয়ে হযরত ইবরাহিম আ. চিন্তাগ্রস্ত। পিতার এ অবস্থা দেখে পুত্র ইসমাইলও ব্যথিত। তাই পিতার মনে দয়ার উদ্রেক হওয়ার আশংকায় ইসমাইল পিতা ইবরাহিম আ. এর চোখ বেঁেধ দেন আর নিজেকে সঁপিয়ে দেন পিতার ধাড়ালো ছুরির তলায়। এমতাস্থায় আকাশ থেকে বাণী ভেসে এলো, ‘থামো! ইব্রাহিম থামো! ত্যাগের পরীক্ষায় তুমি উত্তীর্ণ।’ তখন হযরত ইবরাহিম (আ.) চোখ খুলে পাশেই একটি দুম্বা দেখতে পেলেন। পরে আল্লাহর নির্দেশে তিনি সে দুম্বাই কুরবানি করেন। সেই থেকে পশু কুরবানি শুরু হয়। আর মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর উম্মাত বা অনুসারীদের জন্যও হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর পদ্ধতিতে পশু কুরবানি অপরিহার্য করা হয়।
ইসলামি বিধানে এবং মুসলিম সমাজে কুরবানি বা পশুজবেহ অন্যতম অপরিহার্য ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়। এ জন্য জিলহাজ মাসের নির্ধারিত সময়ে বা ঈদ উৎসবে কুরবানি করা হয়। একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে কুরবানির উদ্দেশ্য হলেও কারো কারো কুরবানিতে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। কে কত বড়-দামি পশু কুরবানি করে এ নিয়েও কিছু লোকের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। কারো কারো কুরবানির মধ্যে সম্পদ-অহমিকা প্রকাশ করার প্রবনতাও লক্ষ্য করা যায়! এছাড়া সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর লক্ষ্যেও অনেককে কুরবানি করতে দেখা যায়। এসব লোক দেখানো কিংবা প্রভাব বাড়ানোর কুরবানি পশুহত্যায় পর্যবশিত হয়। অধিকন্তু দরিদ্র-দুস্ত লোকদেরকে কুরবানির মাংস দান না করে শুধু নিজেরা ভোগ করার পরিণতিও একই হয়। অথচ পার্থিব স্বার্থ ত্যাগ করে শুধু মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই কুরবানি করতে হয়। কুরবানির পশুর আকার বড়-ছোট কিংবা রং-মূল্য বিবেচ্য বিষয় নয়। তবু বিত্তশালীদের বড় পশু কুরবানি করাই শ্রেয়। সর্বোপরি কুরবানির জন্য উপার্জন অবশ্যই বৈধ হতে হয়। এ ক্ষেত্রে কুরবানিদাতার সামগ্রিক উপার্জনই বিবেচনায় আনতে হয়। শুধু কুরবানির পশু ক্রয়ের অর্থ বৈধ হওয়াই যথার্থ নয়, বরং সামগ্রিক উপার্জনই বৈধ হতে হয়। অন্যায়-অবৈধ উপার্জনের অর্থে যত বড়-দামী পশুই জবেহ করা হোক তা আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। অনুরূপভাবে বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া কুরবানিও আল্লাহ তায়ালার নিকট গৃহীত হয় না। এ বিষয়ে মহান আল্লাহর ঘোষণা, ‘কুরবানির পশুর রক্ত-মাংস কিছুই আল্লাহর নিকট পৌঁছে না, বরং তার কাছে পৌঁছে শুধু তোমাদের ত্যাগ বা তাকওয়া’(সূরা হজ্জ:৩৭)। তাই মহান আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য কুরবানির জন্য বিশুদ্ধ নিয়তের প্রয়োজন হয় এবং ত্যাগের প্রবল সাধনা থাকতে হয়। অধিকন্তু কুরবানির পশুর মাংস গরিব-অসহায় লোকদের দান করা শ্রেয়। এতে একদিকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। অন্যদিকে সামাজিক বন্ধন সুসংহত হয়। আপাত দৃষ্টিতে কুরবানি বলতে ’পশুজবেহ’ বা ’রক্তপ্রবাহ’ মনে হলেও এর মাধ্যমে অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে এবং সত্য-ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগ্রাম-সাধনার শক্তি সঞ্চারিত হয়; কুরবানির ত্যাগের মধ্যে মুক্তি-স্বাধীনতা অর্জনের দীক্ষা পাওয়া যায়। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘ওরে সত্য মুক্তি স্বাধীনতা দেবে এই সে খুন-মোচন! ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!’ (কোরবানী)। প্রকৃতপক্ষে কুরবানির ত্যাগের মাধ্যমে মানবিক ও নৈতিক শক্তি-সাহস অর্জিত হয়, যা দিয়ে অন্যায়-অপশক্তিকে পরাজিত করা যায়। একইভাবে ধৈর্য-ত্যাগের শিক্ষাও গ্রহণ করা যায়। যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময়।
কুরবানি ত্যাগের সাধনা হলেও আমাদের সমাজে অনেকটা লৌকিকতায় পরিণত হয়েছে! এতে কুরবানির মূল লক্ষ্য অর্জনের চেয়ে প্রদর্শনই প্রাধান্য পেয়েছে। ফলে আত্মশুদ্ধিতার চেয়ে আত্মম্ভরিতা বেড়েছে। আর বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ও কুচক্রি মহল তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে কুরবানিকে ত্যাগের পরিবর্তে ভোগের উৎসবে পরিণত করছে ্এবং মুসলিম সমাজকে কুরবানির লক্ষ্যচ্যুত করার অপচেষ্টা করছে। মুসলিমদেরকে এ সব বিষয়ে সচেতন ও সতর্ক হয়ে কুরবানির মূল লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট থাকতে হবে।