বাংলাদেশে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম গত কয়েক বছর ধরে তলানিতে নেমে এসেছে। চামড়ার খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে চাহিদার তুলনায় বিপুল পরিমাণ চামড়ার সরবরাহ এর মূল কারণ। আর চাহিদা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে তারা রপ্তানী পড়ে যাওয়ার কথা বলছেন। সরকার অবশ্য বলছে যে, গতবারের তুলনায় এবার লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম ৬ শতাংশ বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে। চামড়ার দাম ধরে রাখতে ঈদের পরবর্তী সাত দিন ঢাকার বাইরে থেকে চামড়া না আনার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এবার সরকার ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৫০-৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪৫-৪৮ টাকা নির্ধারণ করেছে। গত বছর এই দাম ছিল ঢাকায় ৪৭-৫২ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪০-৪৪ টাকা। গত বছর ছাগলের চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৮-২০ টাকা যা এ বছরও অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। যারা কোরবানি দিচ্ছেন এবং মৌসুমি চামড়ার ব্যবসার সাথে যুক্ত, তারা বলছেন, বছর দশেক আগেও প্রতিটি গরুর চামড়ার দাম গড়ে ১৫০০ টাকা থাকলেও গত দুই-তিন বছর ধরে এটি গড়ে ৫০০ টাকায় নেমে এসেছে। নয়াপল্টন এলাকার বাসিন্দা সাইফুর রহমান খান বলেন, ২০১২-১৩ সালের দিকে ৪-৫ মণ ওজনের গরু কোরবানি দিলে সেটির চামড়া বিক্রি করতে পারতেন ১২০০-১৫০০ টাকা। আর গরু যদি আরো বড় অর্থাৎ ৬-৭ মন হতো তাহলে সেই চামড়া বিক্রি হতো ২০০০-২৫০০ টাকা।
“আর এখন সেই চামড়া হয়ে গেছে ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা। আর খুব বেশি হলে ৭০০ টাকা। এটা কমা শুরু হয়েছে ২০১৬-১৭ সাল থেকে।” গ্রিনরোড এলাকার বাসিন্দা আবুল মনসুর আহমেদ বলেন, ১০ বছর আগে একটা গরুর চামড়া তিন হাজার থেকে শুরু করে চার হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যেতো।
তিনি বলেন, “প্রত্যেক ঈদে এটা ইম্পর্টান্ট একটা বিষয় ছিল। প্রচুর লোক চামড়া কেনার জন্য আসতো। আমরা দামাদামি করতাম। চামড়া বিক্রি করে সেই টাকাটা গরিবদের দিয়ে দিতাম।” কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে চামড়ার দাম পরিবর্তিত হয়ে গেছে এবং বর্তমানে কার্যত কোন মূল্যই নাই, বলেন তিনি।
“চামড়া এখন ফ্রি দিয়ে দেয়ার মতো। এটা কেনার জন্য খুব একটা আগ্রহ কারো দেখি না। মাদ্রাসার লোকদেরও আমরা ডেকে চামড়াটা দিয়ে দিচ্ছি। আর তারাও এটা নেয়ার সময় বলছে যে, চামড়া নিয়ে এখন আর তাদের কোন আয় হয় না।” টানা প্রায় চার বছর ধরে কোরবানির সময় চামড়া কিনে মৌসুমী ব্যবসায়ী হিসেবে সেগুলো আবার ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করেছেন সালাউদ্দিন আহমেদ। তবে গত তিন বছর তিনি আর এই ব্যবসা করছেন না। এর কারণ হিসেবে সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ২০১৭ সালের পর থেকে চামড়ার দাম এতো কমে গেছে যে কোনো লাভ হয়না।
কোরবানির পশুর দাম প্রতিবছর বাড়লেও চামড়ার দাম বাড়ে না: তিনি বলেন, ২০১৭ সালের আগে ট্যানারির কর্মকর্তারা তাদের কাছে গিয়ে চামড়ার একটা গড় দাম ধরে তাদেরকে কিছু টাকা অগ্রিম দিতেন। এই টাকার সাথে আরো টাকা দিয়ে চামড়া কিনে সেগুলো আগের নির্ধারিত দামে ট্যানারিতে বিক্রি করতেন। কিন্তু বর্তমানে এই অবস্থা নেই বলে জানান তিনি। মি. আহমেদ বলেন, ২০১৭ সালেও তিনি প্রতিটি গরুর চামড়া গড়ে ১২০০-১৪০০ টাকায় কিনে ১৭০০ টাকায় ট্যানারিতে বিক্রি করেছেন।
পরিস্থিতি পাল্টেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন ট্যানারির মালিকরা আর আসেন না। আর আসলেও ২০০ টাকা থেকে দাম ধরা শুরু করে। আর সর্বোচ্চ দাম ৫০০ টাকার বেশি হয় না। “কেনাই তো যায় না। আমরা গিয়ে কিভাবে বলবো একটা গরুর চামড়া ২০০ বা ১০০ টাকা? এই এক-দুইশ টাকার জন্য চামড়া কেউ বিক্রি করে না। ওরা মাদ্রাসার যে লোকজন আসে তাদেরকে দিয়ে দেয়।”
চামড়ার বাজারের এই হাল কেন? কোরবানির চামড়া বাসাবাড়ি থেকে কিনে নেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তারা সেই চামড়া বিক্রি করেন পাইকারদের কাছে। আর পাইকাররা লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করে তা বিক্রি করেন ট্যানারিতে। ট্যানারি কেমন দামে চামড়া কিনবে তা প্রতিবছর নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তার মানে এখানে কয়েক হাত ঘুরে যে দাম হবে সেটি নির্ধারণ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থাৎ যারা কোরবানি দেন তাদেরকে চামড়া বিক্রি করতে হয় সরকার নির্ধারিত দামের তুলনায় অনেক কমে। চামড়ার দাম পড়ে যাওয়ার পেছনে রপ্তানী কমে যাওয়া বড় কারণ বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহিন আহমেদ বলেন, ২০১৬ সালের পর থেকে বাংলাদেশ থেকে চামড়া রপ্তানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ার কারণে দেশীয় ট্যানারির মালিকদের কাছে চামড়ার চাহিদা কমে গেছে। তিনি বলেন, “’১৬ সালের পূর্বে যেসব বায়ার ছিল যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বায়ার বা ফার-ইস্টের সাউথ কোরিয়া, জাপান – যারা কমপ্লায়ান্ট বায়ার তারা এদেশ থেকে কেনা বন্ধ করে দিলো। ” “এখন আমাদের নন-কমপ্লায়ান্ট বায়ারদের কাছে অর্ধেকরও কম দামে চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে। আমি যদি দাম না পাই তাহলে কাঁচা চামড়া আমি কিভাবে দাম দিয়ে কিনবো?” তার মতে, এই অবস্থার প্রভাব পড়েছে স্থানীয় চামড়ার বাজারে। কমেছে দাম। বর্তমানে বাংলাদেশের চামড়া রপ্তানির একটা বড় বাজার চীন। তবে চীন বেশ কম দামে এদেশ থেকে চামড়া কিনছে বলেও জানান তিনি। একই রকমের মত দিয়েছেন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতানও। তিনিও বলেছেন, রপ্তানি কমে যাওয়া প্রভাব পড়েছে স্থানীয় বাজারে। মি. সুলতান বলেন, ২০১৫ সালের দিকেও বাইরের দেশে চামড়ার বেশ চাহিদা ছিল। কিন্তু এরপর থেকে কমে গেছে। বর্তমানে কিছু চামড়া চীন, হংকং ও জাপানে রপ্তানী করা হয়। সেসব দেশেও চামড়ার চাহিদা অভ্যন্তরীণভাবে কমে গেছে বলেও মন্তব্য করেন মি. সুলতান। চামড়াজাত পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ হলেও সেখানে রপ্তানির জন্য ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশনের সনদ এবং লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের পরিবেশ স্বীকৃতি সনদের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ট্যানারি শিল্পের সামগ্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়াটি পরিবেশগত সমস্যা থেকে মুক্ত হতে না পারায় এর কোনটিই নেই বাংলাদেশের। এ কারণে ওই সব দেশে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ঢুকতে পারছে না। রপ্তানি কমার পেছনে সরকারকে দোষারোপ করে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহিন আহমেদ বলেন, ২০১৬ সালে সরকার অপরিকল্পিতভাবে ট্যানারিগুলো সাভারে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। সেখানে পরিবেশবান্ধব পরিবেশে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার ব্যবস্থা থাকবে বলে আশ্বাস দিলেও সেটা শেষমেশ হয়নি। এছাড়া খুব বেশি ট্যানারি সেখানে গিয়ে স্থায়ী হতে পারেনি।
এছাড়া বর্তমানে কৃত্রিম চামড়া এবং প্লাস্টিকের বহুল ব্যবহার শুরু হওয়ার কারণেও চামড়ার চাহিদা বিশ্বজুড়েই কমে গেছে বলে মনে করেন এই দুই সংগঠনের নেতারা। তারা বলছেন, চামড়ার পণ্যের তুলনায় কৃত্রিম চামড়া থেকে উৎপাদিত পণ্য ব্যবহার সহজ ও আরামদায়ক হওয়ার কারণে এর চাহিদা বেড়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে চামড়া উৎপাদন আগের তুলনায় বহুগুণে বেড়েছে বলেও তারা জানিয়েছেন। যার কারণে বাজারের স্বাভাবিক নিয়মেই চাহিদার তুলনায় যোগান বাড়ার কারণে দাম পড়ে গিয়েছে বলে দাবি তাদের।
বাংলাদেশে প্রতিবছর যত পশু জবাই হয়, তার অর্ধেকই হয় কোরবানির সময়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, সবশেষ ২০২২ সালেও ৯৯ লাখ ৫০ হাজারের বেশি পশু কোরবানি করা হয়েছিল।
যা বলছে সরকার: লবণ দিয়ে প্রাথমিকভাবে সংরক্ষিত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এবার লবনযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ঢাকায় ৫০-৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪৫-৪৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সাথে ছাগলের চামড়ার দাম প্রতিবর্গফুট ঢাকায় ১৮-২০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ১২-১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী বিবিসি বাংলাকে বলেন, চামড়ার দাম কমে যাওয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে গত বছরের তুলনায় এবার দাম কিছুটা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছরের তুলনায় গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুটে ৭ টাকা এবং ছাগলের চামড়া প্রতি বর্গফুটে ৩ টাকা বেড়েছে। এছাড়া চামড়ার দাম যাতে ঠিক থাকে সেজন্য ঈদের পর প্রথম সাত দিন পশুর চামড়া বাইরে থেকে ঢাকায় ঢুকবে না। এতে করে চামড়া যারা বিক্রি করেন তারা দামাদামির সুযোগ পাবেন বলে মনে করেন বাণিজ্যমন্ত্রী।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, চামড়ার ভালো দাম পাওয়া না গেলে প্রয়োজনে কাঁচা চামড়া রপ্তানির অনুমোদন দেয়া হবে যাতে তারা দাম পায়। টিপু মুনশী বলেন, গত বছরও কাঁচা চামড়া রপ্তানীর অনুমোদন দেয়ার পর দাম বেড়েছিল। কাঁচা চামড়া রপ্তানী করলে খুব একটা দাম পাওয়া যায় না উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, তারা চান চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে মানসম্পন্ন চামড়া ও পণ্য রপ্তানী করতে যাতে বেশি দাম পাওয়া যায়।
তবে, চামড়া রপ্তানীতে কমপ্লায়ান্স অর্থাৎ পরিবেশের মত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শর্ত নিশ্চিত করার বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয় উল্লেখ করে এবিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি মন্ত্রী।- (সূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা, ঢাকা)