কান চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হলো মৃণাল সেনের বিখ্যাত ছবি ‘খারিজ’। স্বভাবতই যা হয় প্রচুর প্রশংসা, প্রচুর আলোচনা, প্রচুর প্রশ্ন। গ্রামের গরিব বাবা অনেকটা ভাতের অভাবেই বারো বছরের ছেলেকে শহরের বাবুদের বাড়িতে কাজে দেন। কথা ছিল বাবুরা যতেœ রাখবে বাপ-মা ছেড়ে আসা ছেলেটিকে। কিন্তু একদিন রান্নাঘরের বদ্ধ গ্যাসে দম বন্ধ হয়ে ছেলেটি মারা যায়। খবর পেয়ে গ্রাম থেকে বাবা আসে, আত্মীয় স্বজন আসে। কিন্তু সবাই নীরব, নিথর, নির্বাক। না কোনো প্রতিবাদ, না কোনো ক্ষোভ, না কোনো আর্ত আহাজারি। এই বিমূঢ় নীরবতা স্তম্ভিত করে দেয় বিদেশি দর্শকদের। এটা পরিচালকের ওস্তাদি যে, একটি মুখের অভিব্যক্তিতে একটা জনপদের গোটা চালচিত্রকে তুলে ধরা। ইতালীয় পরিচালক ভিত্তোরিও ডি সিকার ‘বাইসাইকেল থিবস’-এর একটি দৃশ্যে দেখা যায়, বিশাল ভিড় টাকা ভাঙানোর দোকানের সামনে। এক মাঝ বয়সি ভদ্রলোক, লম্বাটে মুখ, একগাল দাড়ি নিয়ে বিধ্বস্ত লাগছিল তাকে। তিনি তার বাইনোকুলারটা দিয়ে টাকা ভাঙানির দোকানে টাকা নিতে চাইছিলেন। … বোঝা যায় যুদ্ধের পর ইতালিতে কী চরম অর্থনৈতিক চাপে বিধ্বস্ত হয়ে বাইনোকুলারটা বিক্রি করতে এসেছেন। আসলে ডি সিকাও একটা সময়কে তার ছবিতে ধরে রাখার জন্য একটি মুখ খুঁজছিলেন। মুখটা খুঁজে নিয়ে তিনি তার ছবিতে ধরে রাখলেন। একটা টাইপেজ তার ‘বাইসাইকেল থিবস’ ছবিটাকে জ্যান্ত করে তুলল। সামজিক প্রাসঙ্গিকতায় নিয়ে গেল। অর্থাৎ, একটি মুখ একটি টাইপেজ, একটি প্রতীক, একটি মুড, একটি সংস্কৃতি, একটি দর্শন। কায়দা করে ধরতে পারলে বিশেষ ছাঁদের একটি ব্যক্তিমুখই অর্থব্যাপ্তিতে অনেক বড় হয়ে উঠতে পারেÍএ রসায়নটুকু শিল্পের। খ্যাতিমানদের মুখাবয়বের রেখাবলি ক্যামেরাবন্দি করে বাংলাদেশে এক রুচিস্নিগ্ধ শিল্পের পত্তন করেছেন ক্যামেরার কবি নাসির আলী মামুন। গতকাল ১ জুলাই ছিল তাঁর সত্তরতম জন্মদিন। বাংলাদেশে পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির পথপ্রদর্শক তিনি। আমাদের অনেক লিজেন্ডেরই নমুনা নাই আমাদের হাতে। লালন শাহ, হাজি শরীয়তুল্লাহর একমাত্র ছবি ব্রিটেনের ইন্ডিয়া হাউজ অফিসের সংগ্রহশালা থেকে পাওয়া। কৃষক বিদ্রোহের মহানায়ক নূরলদীনের ইতিহাস, তাও সেখান থেকে। আমাদের সাবেক কালের অনেক খাস খতিয়ানের জন্যই হাত পাততে হয় সাম্রজ্যবাদী ঔপনিবেশিকদের মহাফেজখানার দরবারে। তবে বিস্মৃতির ভূতুড়ে গুহামুখে সভ্যতার আসল নির্মাতাদের হারিয়ে যাওয়া ঠেকাতে ক্যামেরাক্রুসেডে নেমেছিলেন নাসির আলী মামুন, আরো চার যুগ আগে। শিল্পের ভ্রূণ কার রক্তে কীভাবে ঢোকে, আন্দাজ করা মুশকিল। অদ্ভুত খেয়ালভরা শৈশবে পত্রিকার পাতা থেকে ছবি কেটে রাখতেন খ্যাতিমানদের। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বভাবটি নাছোড়বান্দার মতো পেয়ে বসে নাসিরকে। ধারে ক্যামেরা জোটাতেন, ভাড়াও করতেন হামেশা। খ্যাতিমানদের পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়ান অনুগত বেড়ালের মতো। পাড়া, মহল্লা, গ্রাম, শহর ডিঙিয়েও মামুনের হাঁটা ফুরাত না। শহরের পর শহর, দেশের পর দেশ, শেষতক মহাদেশ। বিষুবরেখার দুপাশের অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ চষে ফেলেছেন মামুন খ্যাতিমানদের মুখচ্ছবির প্রলোভনে।
শিল্প একধরনের ধ্যান। টানা প্রায় অর্ধশতক বছরেও মামুনের ধ্যান ভাঙেনি। না কোনো পূর্বসূরি, না কোনো নমুনা, না কোনো পথÍকিছুই ছিল না মামুনের সামনে। কেবল কুহকের কুয়াশা। ঠোক্কর খেয়ে চলতে হয়েছে তাকে। তারপর ধীরে ধীরে ঘুচতে থাকে আঁধার। বাংলাদেশে অচর্চিত আলো-ছায়ার আলাদা এক ভাষায় বেড়ে উঠতে থাকে নাসির আলী মামুনের পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফি। তার ছবিতে মুখের চেয়ে মনীষা, চিত্রের চেয়ে চরিত্রই প্রধান দ্রষ্টব্য হয়ে ওঠে। একটু একটু করে তিনি তৈরি করেছেন নিজের ক্যামেরাভাষা। আমাদের সংস্কৃতির জলবায়ু ধরে আলো-ছায়ার এক আলাদা কাব্য রচনা করলেন মামুন। তার তোলা পোর্ট্রেট দেখে দেখে কীর্তিমানের একটা খসড়া পোর্টফলিও লিখে ফেলা সম্ভব। মুখ, মুখ আর মুখ। শত শত মুখ। মুখের মানচিত্র দিয়েই তৈরি মামুনের মহাদেশ। পোড় খাওয়া মুখ, পা-ুর মুখ, শানিত মুখ, বুদ্ধিদীপ্ত মুখ, ক্রুদ্ধ মুখ, প্রাণিত মুখ; অসহায় বিষণ্ন, স্তিমিত, উদ্ধত, দুর্বিনীত, অহংকৃত, অভিজাত, স্মিত, স্থিতধী, সৌম্য, শান্ত, সমাহিত, নীরব, নির্বাক। কোনো মুখে বুদ্ধের ধ্যান, কোনো মুখে জীবনানন্দের বিষাদ, কারো চোয়ালে নজরুলের বিদ্রোহ, কারো পেশিতে শাহাবুদ্দিনের শক্তি। কী নেই তার পোর্ট্রেটে! দার্শনিকের সার্বিকতা, বিজ্ঞানীর তন্ময়তা, কবির বিমূঢ়তা, আশাহতের নীরবতা থরে থরে সাজানো মামুনের মিউজিয়ামে। একটা সময় মনে হতো নাসির বুঝি শুধু খ্যাতিমানদের কাঙাল। কিন্তু তার ‘ঘর নেই’ সিরিজের ছবিগুলো আমাদের চমকে দেয়।
কেবল খ্যাতিমানদের মুখচ্ছবি নয়, তাদের হস্তলিপি, পা-ুলিপি, অটোগ্রাফ, ব্যবহূত সামগ্রী, অঙ্কিত ছবি, সাক্ষাৎকারসহ বহু বিচিত্র সামগ্রী মিলিয়ে গত চার যুগ ধরে মামুনের সংগ্রহ এখন একটা বিরাট আর্কাইভের মতো। সেসব নিয়েই ঢাকার অদূরে মামুন তৈরি করেছেন ফটোজিয়াম। মামুনের সংগ্রহ আমাদের জাতীয় সম্পদ। জাতীয় প্রয়োজনেই তার সংরক্ষণ ও প্রদর্শন প্রয়োজন। সময় অনেক চলে গেছে। এখনই উদ্যোগ না নিলে অনেক দুর্লভ সঞ্চয়ই চিরতরে হারিয়ে যাবে। একটি জাতির সব সম্পদ কেবল ব্যাংক-বিমা, শিল্পকারখানা আর খনিতে থাকে না, মহাফেজখানায়ও থাকে। আমরা গর্ব করে বলতে পারি, আমাদের একজন নাসির আলী মামুন আছে।
লেখক: সভাপতি, তারেক মাসুদ ফিল্ম সোসাইটি