ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকজাত পণ্যের রফতানি কমলেও আশা জাগাচ্ছে নন-ট্র্যাডিশনাল মার্কেট বা অপ্রচলিত বাজার। প্রচলিত বাজারে যেখানে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ, সেখানে অপ্রচলিত বাজারে তৈরি পোশাকের রফতানি বেড়েছে ৩১ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
অপ্রচলিত বাজারে রফতানির যে উল্লম্ফন তা মূলত হয়েছে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া, মেক্সিকো, মালয়েশিয়া ও তুরস্কের হাত ধরে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়—ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে পোশাকশিল্পের প্রধান বাজার ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিকল্প বাজারে ঝুঁকেছেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়াও এসব বাজারে রফতানিতে ৪ শতাংশ সরকারি প্রণোদনা প্রভাবকের কাজ করেছে বলে মনে করেন তৈরি পোশাক খাতের সংশ্লিষ্টরা। ইপিবি’র ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের তথ্যমতে, প্রধান অপ্রচলিত বাজারের মধ্যে নতুন করে জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতে রফতানি এক বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে।
উল্লেখ্য, অপ্রচলিত বা নতুন বাজারে তৈরি পোশাক রফতানি গত তিন বছর ধরেই বাড়ছে। তারই ধারাবাহিকতায় এই প্রথমবারের মতো নতুন বাজার হিসেবে পরিচিত তিনটি গন্তব্যে পণ্যটির রফতানি ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে মোট পোশাক রফতানিতে অপ্রচলিত বাজারের অংশ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৭ দশমিক ৮২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, ‘প্রচলিত বাজারগুলোতে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ শুরু হওয়ার পর আমরা নতুন বাজারে যাতায়াত বাড়িয়ে দিয়েছি। নতুন সেসব দেশের প্রদর্শনীতেও অংশ নিতে শুরু করেছেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা।’ তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করতে আমরা অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দেশে সম্মেলন করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সব মিলিয়ে নতুন বাজারে পোশাক রফতানি বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ’র মুখপাত্র ও পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘আমাদের চেষ্টা ও সবার সহযোগিতায় অপ্রচলিত বাজার, বিশেষ করে জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের বাজারে রফতানি বেড়েছে।’
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানের মতো অপ্রচলিত বাজারে ৮৩৭ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৯০ হাজার কোটি (রফতানিতে প্রতি ডলার ১০৭.৫০ টাকা) টাকার তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে। আগের বছর এই দেশগুলোতে তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছিল ৬৩৭ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে অপ্রচলিত বাজারে রফতানি বেড়েছে ২০০ কোটি ডলার বা সাড়ে ২১ হাজার কোটি টাকা। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘১০ বছর আগেও নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশে রফতানি হতো। তখন মোট তৈরি পোশাক রফতানির ৫ থেকে ৬ শতাংশের গন্তব্য ছিল অপ্রচলিত বাজার। বর্তমানে সেটি এক-প মাংশে পৌঁছেছে।’ তিনি মনে করেন, অপ্রচলিত বাজারে রফতানি বৃদ্ধি—এটি আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা ও বৈচিত্র্যের নির্দেশ করে।
ইপিবির তথ্য বলছে, বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে নতুন বাজারের মধ্যে সর্বোচ্চ পোশাক রফতানি হয়েছে জাপানে, ১৬০ কোটি ডলারের। এই রফতানি আগের বছরের তুলনায় ৪৫ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি। জাপানে ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে যথাক্রমে ৯৪ ও ১১০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছিল। নতুন বাজারের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অস্ট্রেলিয়ায় রফতানি হয়েছে ১১৬ কোটি ডলারের পোশাক। এই বাজারে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে রফতানি হয়েছিল ৮১ কোটি ডলারের পোশাক। অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছরে অস্ট্রেলিয়ায় রফতানি বেড়েছে সাড়ে ৪২ শতাংশ। অপরদিকে ভারতে তৃতীয় সর্বোচ্চ ১০১ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৪১ শতাংশ। দুই বছরের ব্যবধানে এই বাজারে রফতানি বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে এই বাজারে রফতানি ছিল ৪২ কোটি ডলার। পরের বছর অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে ৭২ কোটি ডলারে দাঁড়ায়।
বিদায়ী অর্থবছরে নতুন বাজারের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ায় চতুর্থ সর্বোচ্চ ৫৪ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে। এই রফতানি আয় তার আগের বছরের তুলনায় ২২ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি। প ম সর্বোচ্চ রফতানি হয়েছে রাশিয়ায়। যদিও এই বাজারে রফতানি কমেছে। ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর পরই মূলত রাশিয়ায় রফতানি কমতে শুরু করে। বিদায়ী অর্থবছরে রাশিয়ায় ৪৩ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে। এই রফতানি তার আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৭ শতাংশ কম। ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে রাশিয়ায় যথাক্রমে ৫৯ ও ৫৮ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছিল।
এছাড়া বিদায়ী অর্থবছরে মেক্সিকোতে ৩৫ কোটি, চীনে ২৯ কোটি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২৯ কোটি, মালয়েশিয়ায় ২৯ কোটি, তুরস্কে ২৯ কোটি, ব্রাজিলে ১৬ কোটি, চিলিতে ১৬ কোটি, সৌদি আরবে ১৩ কোটি, দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৩ কোটি ও নিউজিল্যান্ডে ১৩ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে।
বাংলাদেশের পণ্য রফতানির ৭৬ শতাংশই হয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিসহ ১২টি দেশে। এই দেশগুলোর প্রতিটিতে রফতানির পরিমাণ ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। এরমধ্যে নতুন করে যুক্ত হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার নাম।
বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে মোট ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। এরমধ্যে শীর্ষ ১২টি দেশে রফতানি হয়েছে ৪ হাজার ২০৪ কোটি ডলারের পণ্য। তার আগের বছরে এই বাজারগুলোতে রফতানি হয়েছিল ৪ হাজার ১১ কোটি ডলারের পণ্য। এসব দেশে এক বছরে রফতানি বেড়েছে ১৯৩ কোটি ডলারের। বাংলাদেশের পণ্য রফতানির শীর্ষ ১২টি দেশ হচ্ছে—যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, ভারত, জাপান, পোল্যান্ড, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া। এই দেশগুলোর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও পোল্যান্ডে রফতানি কমেছে। বাকি ৯টি বাজারে পণ্য রফতানি ৭ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়েছে। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, বিগত অর্থবছরে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে (ইইউ) দেশের পোশাক রফতানির পরিমাণ ছিল ২১ দশমিক ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে যা ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২৩ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের পোশাক রফতানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৩ দশমিক ৩৭, ২ দশমিক ৯৪, ২ দশমিক ২৭, ১ দশমিক ২৮ ও ১ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক শূন্য ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে যা ৫ দশমিক ৫১ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলারে। একই সময়ে যুক্তরাজ্য ও কানাডায় রফতানি বেড়েছে যথাক্রমে ১১ দশমিক ৭৮ শতাংশ ও ১৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ।