হিজরতের নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে মদিনায় মুহাজিরদের ঢল নামে। একপর্যায়ে মদিনার স্থায়ী বাসিন্দাদের চেয়ে মুহাজিরদের সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। নবাগতদের আবাসন নিশ্চিত করতে রাসুলে কারিম (সা.) প্রথম দিন থেকেই পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা তৈরি করে নিয়েছেন। এখানে সংক্ষেপে সে বিষয়ে আলোচনা করা হলোÍ
মদিনা নগরীর প্রাথমিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন: প্রাথমিকভাবে মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য ভবন তৈরির জায়গা নির্বাচন এবং এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আগেই জায়গার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। শুরুতেই মসজিদে নববী ও রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর স্ত্রীদের বাসস্থান নির্মাণের মাধ্যমে এর প্রাথমিক পর্ব শেষ হয়। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সব কার্যাদির মূল কেন্দ্র মসজিদ-ই-নববীই ছিল। আর দ্বিতীয় পর্বের শুরু হয় নবাগত মুহাজিরদের আবাসনের জন্য সংক্ষিপ্ত পরিসরে ঘর নির্মাণের মাধ্যমে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে প্রায় বছরখানেক বা এর চেয়ে বেশি সময় কেটে যায়। (তারিখে ইবনে কাসির : ৩/২২০-২২২)
নাগরিকদের স্থায়ী আবাসনের উদ্যোগ: মুহাজির নাগরিকদের স্থায়ী আবাসনের জন্য সাধারণত দুটি ব্যবস্থা করা হতো : এক. কোনো ধনী আনসারিকে দায়িত্ব দেওয়া হতো যে তিনি যেন একজন মুহাজির ভাইয়ের স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করেন। তবে এ ব্যবস্থাটি দীর্ঘস্থায়ী ছিল না; বরং প্রাথমিকভাবে মদিনারাষ্ট্রযন্ত্র নিয়মতান্ত্রিক চালু হওয়ার আগ পর্যন্তই ছিল।
দুই. দ্বিতীয় ব্যবস্থাপনা ছিল, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অনাবাদ জায়গাগুলো আবাদ করার মাধ্যমে অথবা কতেক আনসারি সাহাবিদের দানের মাধ্যমে প্রাপ্ত জমিতে মুহাজিরদের জন্য বড় বড় ঘর তৈরি করা হতো। এই ঘরগুলো বড় বড় কামরাবিশিষ্ট ছিল।
একেক ঘর একেক গোত্রকে দেওয়া হতো। তবে রান্নাবান্নার জায়গা গোত্রভিত্তিক একত্রে ছিল। (তারিখে ইবনে কাসির : ৩/২২৪-২২৯, ওয়াফাউল ওয়াফা : ১/৫২৭)
মদিনা শহরের সম্প্রসারণ: নববীযুগের শেষের দিকেই মদিনা নগরী পশ্চিমে বুতহা পর্যন্ত, পূর্বে বাকি ও উত্তর-পূর্বে বনু সায়েদা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যায়। তখনই রাসুলুল্লাহ (সা.) সেখানে নতুন বাসস্থান স্থাপনে নিরুৎসাহিত করেন। যদিও ধীরে ধীরে আরো কিছু সীমানা বিস্তৃত হয়, তবে মৌলিকভাবে তা নিয়ন্ত্রণে সফল হন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যখন মদিনার বসতি সিলা পাহাড় পর্যন্ত পৌঁছবে, তখন তোমরা শামের (সিরিয়া, জর্দান ও ফিলিস্তিন) দিকে হিজরত করবে।’ (ওয়াফাউল ওয়াফা : ১/৯৮)
নগরায়ণে বিভিন্ন উদ্যোগ: বর্তমানে আধুনিক নগরায়ণে সাধারণত নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয় : ১. শহরের রাস্তা ও সড়ক, মার্কেট নির্মাণ এবং আবাসন ব্যবস্থা। ২. বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা ও বণ্টন। ৩. ব্যবহৃত পানির নিষ্কাশন ও ময়লা-আবর্জনার ডাস্টবিনের ব্যবস্থা ও তার পরিচ্ছন্নতা।
৪. শিক্ষা, চিকিৎসা, অন্য সেবামূলক সংস্থাসমূহ গঠন ও খেলাধুলার ব্যবস্থা। ৫. শহরের পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে সঙ্গে সৌন্দর্যবর্ধন ও বিনোদনকেন্দ্র স্থাপন। ৬. আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি। এসব বিষয়ের ব্যাপারেই রাসুলুল্লাহ (সা.) সেই সময় দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। বিশেষভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রত্যেকটি পয়েন্টে স্তরমাফিক বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন।
শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা: রাসুলুল্লাহ (সা.) শিক্ষার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। বিভিন্ন গোত্রভিত্তিক পাঠশালা তৈরি করে সেখানে একাধিক শিক্ষক নিয়োগ দিতেন। যাঁরা তাদের কোরআন-সুন্নাহ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতেন, দ্বিনি দাওয়াত সম্প্রসারণ করতেন। (দেখুন : সহিহ বুখারি, হাদিস : ১০০২, ১৩৯৫, ৪৩৪১, ৪৩৪৯) মসজিদে নববীর কাছে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তা ছিল একটি উন্মুক্ত পাঠশালা। সেখানে বিশেষ করে অসহায় ও পরদেশি মুসলিমদের জন্য শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ধনী সাহাবিদের অর্থায়নে খাদ্য, চিকিৎসা প্রভৃতিরও ব্যবস্থা হতো। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৪২, ৬০২, ৬৪৫২) এ ছাড়া ইমাম বুখারি (রহ.) তাঁর সহিহ বুখারিতে মসজিদে অসুস্থদের সেবার জন্য স্বতন্ত্র তাঁবু নির্মাণের বিষয়ক একটি অনুচ্ছেদও উল্লেখ করেন। যেখানে অসহায় রোগীদের চিকিৎসা ও সেবা করা হতো। (দেখুন : বুখারি, হাদিস : ৪৬৩)
বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা: মদিনার মানুষের ব্যাপকভাবে খাবার পানির জন্য জনৈক ইহুদি থেকে ‘রুমা’ নামক কূপটি খরিদ করে তা প্রশস্ত করে খনন করা প্রয়োজন হয়েছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ কাজের জন্য সাহাবায়ে কেরামকে উৎসাহ দিয়ে বলেন, যে ব্যক্তি ‘রুমা’ নামক কূপটি খনন করবে, তার জন্য জান্নাতের সুসংবাদ আছে। হজরত উসমান (রা.) তা শুনে ‘রুমা’ নামক কূপটি খরিদ করে তা প্রশস্ত করে খনন করে জনসাধারণের জন্য ওয়াক্ফ করে দেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৭৭৮) হজরত সাদ ইবনে উবাদাহ (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমার মা ইন্তেকাল করেছেন, তাঁর ঈসালে সাওয়াবের জন্য কোন সদকা উত্তম? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘পানির ব্যবস্থা করা।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১৬৮১, নাসাঈ, হাদিস : ৩৬৬৪) এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় সাহাবিরা কূপ খনন করেন, সিরাতের কিতাবসমূহে যার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।
শহরের রাস্তা ও সড়ক ব্যবস্থাপনা: শহরের মধ্যে অনেকে অন্যায়ভাবে রাস্তা দখল করে ‘তোমাদের মধ্যে যদি রাস্তা নিয়ে বিবাদ হয়, তাহলে তোমরা তার চওড়া (কমপক্ষে) ৭ হাত বা ৭ গজ রাখবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৬১৩) সড়কের নিরাপত্তাবিষয়ক নির্দেশ হলো, ‘ঈমানের ৭৭টি শাখা রয়েছে, এর মধ্যে সর্বোচ্চ হলো ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা এবং সর্বনিম্ন হলো রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিসসমূহ সরানো।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫৮)
মসজিদ ও কবরস্থান নির্মাণ: এলাকাভেদে প্রয়োজনীয় মসজিদ ও কবরস্থান নির্মাণ করেন। মদিনায় এসে শুরুতেই রাসুলুল্লাহ (সা.) মসজিদে নববী নির্মাণ করলেন। এর পাশেই ‘বাকি’ নামক স্থানে মুসলিমদের কবরস্থান গড়ে ওঠে। এ ছাড়া আশপাশের এলাকাগুলোতেও মসজিদ ও কবরস্থান গড়ে ওঠে।
নাগরিক প্রয়োজনে মার্কেট নির্মাণ ও তার তত্ত্বাবধান: মদিনার নাগরিকদের নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সহজলভ্যতার জন্য পূর্ব থেকেই চলে আসা বাজারের সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) নতুন করে বাজার খুলে দিয়েছেন। এই বাজারের ব্যবসা সম্প্রসারণে রাসুলুল্লাহ (সা.) অসামান্য প্রচেষ্টা করেন। পূর্ণ আরব উপদ্বীপ করায়ত্ত হওয়ার পর থেকে আমদানি-রপ্তানির কাজেও নতুন মাত্রা যোগ হয়। এমনকি এ ঘোষণা করে দিলেন যে মদিনার বাজারে ব্যবসায়ীদের জন্য শুল্ক ট্যাক্স নেই। (ফুতুহুল বুলদান, পৃষ্ঠা ২৪)
বাজার পরিচালনার জন্য প্রাথমিকভাবে ১২ জনের কমিটি বানিয়ে দিলেন, যার প্রধান ছিলেন ওমর (রা.)। (সিরাতে ইবনে হিশাম ২/৪৯১, আত্তারাতিবুল ইদারিয়্যা ১/২৮৪)
পথ-ঘাট অবৈধ ভোগদখলে নিষেধাজ্ঞা: আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা রাস্তার ওপর বসা ছেড়ে দাও।’ লোকজন বলল, এ ছাড়া আমাদের কোনো পথ নেই। কেননা এটাই আমাদের উঠাবসার জায়গা এবং এখানেই আমরা কথাবার্তা বলে থাকি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যদি তোমাদের সেখানে বসতেই হয়, তবে রাস্তার হক আদায় করবে। তারা বলল, রাস্তার হক কী? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, দৃষ্টি অবনমিত রাখা, কাউকে কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকা, সালামের জবাব দেওয়া, সৎকাজের আদেশ দেওয়া এবং অন্যায় কাজে নিষেধ করা।’ (সহিহ বুখারি হাদিস : ২৪৬৫)
নগরীর সৌন্দর্যবর্ধন: পরিবেশ সুন্দর করাও ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের অন্তর্ভুক্ত। মদিনায় ছিল অনেক সুন্দর দৃষ্টিনন্দন খেজুর বাগান। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেও গাছ লাগানোর প্রতি উৎসাহ দিতেন এবং অযথা গাছ কাটা ও পাতা ছেঁড়াকে নিষেধ করতেন। তিনি মাঝেমধ্যে খেজুর বাগানে গিয়ে বিশ্রাম নিতেন। মসজিদে নববীর সামনেই আবু তালহা (রা.)-এর ‘বাইরুহা’ নামক একটি বাগান ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) মাঝেমধ্যে সেখানে গিয়ে বিশ্রাম নিতেন, সেখানকার কূপ থেকে ঠা-া পানি পান করতেন। (বুখারি হাদিস : ১৪৬১) বৈধ বিনোদন ও শরীরচর্চার ব্যবস্থা: রাসুলুল্লাহ (সা.) ক্লান্তি দূরকরণ, বিনোদন ও ঘোরাফেরার জন্য মদিনা শহরের অদূরে ‘আকিক উপত্যকা’কে নির্ধারণ করেন। সেখানে বৃক্ষ রোপণ করেন এবং পশু চরানোরও ব্যবস্থা করেন। তিনি নিজেও মাঝেমধ্যে আকিক উপত্যকায় গিয়ে আরাম করতেন। (ওয়াফাউল ওয়াফা ৩/১৮৫) মদিনার ছেলেরা বিভিন্ন মাঠ-প্রান্তরে বৈধ খেলাধুলা যথা: শরীরচর্চা, দৌড় প্রতিযোগিতা, তরবারি চালনা, তীরন্দাজি ও ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতা করত। (দেখুন : আবু দাউদ হাদিস : ৪৭৭৩, ৫২০২) একদা মসজিদে নববীর পাশে খোলামাঠে তরবারি চালনা প্রতিযোগিতার খেলা করছিল। ওমর (রা.) তা দেখে বাধা দিতে চাইলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে নিষেধ করেছেন এবং ছেলেদের খেলতে উৎসাহ দিলেন। (বুখারি হাদিস : ৯৮৮) এ হলো রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনচরিতের একটি অধ্যায় নগরপরিকল্পনার সামান্য বিবরণ।