মিয়ানমারে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সামরিক অভ্যুত্থানের পর দেশটির সেনা সদস্যরা কো টুটের বন্ধু এবং তার গর্ভবতী স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেছিল। তাতে তিনি এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে তিনি তার প্রযুক্তি দক্ষতা ব্যবহার করে সেনা বাহিনীকে অপসারণের জন্য যেসব উদ্যোগ আছে দেশটিতে, তাতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি যে অ্যাপ-ভিত্তিক মোবাইল গেইমটি তৈরি করেছেন তা মিয়ানমারের বিভিন্ন বাস্তব ঘটনার উপর ভিত্তি করে ডিজাইন করা হয়েছে এবং ইতোমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গেইমটি স্বাভাবিকভাবেই শাসক জান্তা গোষ্ঠীকে খেপিয়ে তুলেছে। গেইমের মাধ্যমে মিয়ানমারে সামরিক সরকার বিরোধী আন্দোলনের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা হচ্ছে। গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনে যোগ দেয়ার জন্য আটক হওয়া ওই দম্পতির বিষয়ে কো টুট বলেন, তারা তাদের জীবনে কখনও কোন অপরাধ করেনি।” তিনি জানেন না তাদের সাথে কী হয়েছে।
বিবিসি সম্প্রতি জানতে পেরেছে যে, ওই গর্ভবতী নারীকে একদিনের মধ্যে মুক্তি দেওয়া হয়, তবে তার স্বামীকে প্রায় দেড় বছর আটকে রাখা হয়। ওই দম্পতির গ্রেপ্তারের পর, কো টুট শুনতে পান যে, গণতন্ত্রপন্থী এক কর্মীকে খুঁজে না পেয়ে তার স্ত্রী এবং শিশুকন্যাকে আটক করে। ভেবে দেখুন, একটি ছোট শিশু, কারাগারের নোংরা, মানসিক চাপ এবং হতাশার পরিবেশে বেড়ে উঠছে এবং আপনি জানেন না কী হচ্ছে। এসব দেখে রাগে-ক্ষোভে আমার রক্ত টগবগ করে ফুটছিল।” এরপর কো টুট, যিনি একজন প্রযুক্তিবিদ, সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি তার দেশের নিষ্ঠুর এবং বিপজ্জনক সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলনে যুক্ত হবেন। এরপরই তিনি গেইম তৈরির কাজে নেমে পড়েন। গেইমটিতে, খেলোয়াড়রা এমন সব দৃশ্যে সৈন্যদের সাথে লড়াই করে যা বাস্তব জীবনের মতো মনে হয়। কো টুট এনক্রিপ্ট করা অ্যাপে টেক্সট বার্তার মাধ্যমে বিবিসির সাথে কথা বলেছেন এবং তিনি তার অবস্থান প্রকাশ করেননি। বিবিসি তার নিরাপত্তার জন্য ছদ্মনাম ব্যবহার করেছে। অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে প্রায় পূর্ণাঙ্গ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। রাজনৈতিক বন্দিদের মনিটরিং সংগঠন অ্যাসিস্ট্যান্স এসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্সের তথ্য অনুযায়ী, সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে এ পর্যন্ত মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর হাতে চার হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়েছেন। তবে জাতিসংঘ বলছে, নিহতের সংখ্যা এর চাইতেও অনেক বেশি হবে। পাল্টা হামলায় সৈন্যদের কতজন হতাহত হয়েছে সে সংখ্যা জানা কঠিন – কারণ সেনা বাহিনী ক্ষয়ক্ষতির কথা স্বীকার করেছে, কিন্তু এ সংক্রান্ত কোন পরিসংখ্যান তারা দেয়নি। মিয়ানমারের নির্বাসিত ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট বলছে, প্রতিরোধে ২০ হাজার সৈন্য নিহত হয়েছে, কিন্তু বিবিসি এই সংখ্যার সত্যতা যাচাই করেনি। কো টুটের লক্ষ্য ছিল পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) নামে পরিচিত সেনা শাসক বিরোধী বাহিনীর জন্য অস্ত্র এবং মানবিক সহায়তার জন্য তহবিল সংগ্রহ করা। পাশাপাশি দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। আমার মনে হয়েছে, আমরা খুব কম আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং মনোযোগ পাচ্ছি। ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ নিয়ে যেভাবে আর যত খবর প্রকাশ হচ্ছে, সে তুলনায় মিয়ানমারের সংকটকে ঘিরে কিছুই হয় না বলে মনে করেন তিনি। দুই হাজার বাইশ সালের শুরুতে গেইমটি মূলত দ্য পিডিএফ গেইম নামে চালু হয়।
এটি বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যায়, কিন্তু গেইম চলাকালে গেইমাররা যে বিজ্ঞাপনগুলো দেখে তা থেকে অর্থ রোজগার হয়। কে টুটের ধারণা এ পর্যন্ত মোট পাঁচ লাখ আট হাজার ডলার সংগ্রহ হয়েছে তার ধারণা, এখন প্রতি মাসে গেইমটি থেকে ৭০ থেকে ৮০ হাজার ডলার পর্যন্ত উপার্জন হয় এবং তিনি দাবি করেছেন যে, এ সংখ্যা প্রতি মাসেই বাড়ছে। গেইমাররা সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস বা পিডিএফ সেনার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং বিভিন্ন মিশনে লড়াই করে, যা মিয়ানমারে বাস্তব ঘটনার সাথে মিল রেখে তৈরি করা হয়েছে। কো টুট বলেছেন, তিনি মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর সাথে লড়াই করছে এমন মানুষ – ডাক্তার, মুসলমান এবং এলজিবিটি সম্প্রদায়ের সদস্যসহ বাস্তব মানুষদের গেইমের চরিত্র হিসেবে তুলে এনেছেন। তিনি মনে করেন, এই মানুষদের নথিভুক্ত করা জরুরি, কারণ ‘তারা সত্যিকারের যুদ্ধে লড়াই করছে। গুগল এবং অ্যাপল অ্যাপ স্টোরে গেইমটি পাওয়া যাচ্ছে। তবে কো টুট জানিয়েছেন, কোম্পানির নীতির কারণে গেইমটি কিছুটা সমস্যায় পড়েছিল। পরে গুগল প্লেতে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ওয়ার অফ হিরোস – দ্য পিডিএফ গেম”। গুগল বলেছে যে কোনও সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে বা সেটিকে ঘিরে অসংবেদনশীল কিছু তারা সমর্থন করে না। তবে সেটি যদি ব্যবহারকারীদের ‘সতর্ক করা কিংবা সচেতনতা বাড়ানো’র জন্য হয় তাহলে তাকে অনুমোদন দেয় প্রতিষ্ঠানটি। অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরেও গেইমের নাম বদলে ওয়ার অফ হিরোস রাখা হয়। তার আগে অবশ্য এ প্ল্যাটফর্ম থেকে গেইমটি সরিয়ে ফেলতে হয়েছিল, যাকে বড় ধরণের আঘাত বলে বর্ণনা করেন কো টুট। অ্যাপল বলেছে যে, অ্যাপটি তাদের নির্দেশনা লঙ্ঘন করেছে যেমন কোন গেইমের শত্রুপক্ষ কোন বাস্তব সরকার, কর্পোরেশন বা কোনও বাস্তব চরিত্রকে টার্গেট করতে পারবে না। সেই সাথে সহিংস সংঘাত সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানটির নীতিমালারও পরিপন্থী বলে তারা গেইমটিকে আখ্যা দিয়েছে। এরপর কো টুট গেইমের মূল আর্টওয়ার্ক এবং কিছু সামরিক মিশন সরিয়ে নেয়াসহ বেশ কিছু সংশোধন করেন, এবং তারপর অ্যাপল স্টোর সেটিকে পুনরায় অনুমোদন দেয়। এটা অবশ্যই ভাল খবর, এবং আমরা এখন আরও বেশি আয় করবো বলে আশা করি, তিনি বলেন। গেমের তহবিল সামরিক বিরোধী প্রতিরোধের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
ক্ষুব্ধ সামরিক জান্তা: গেইমটি মিয়ানমারের শাসক জান্তাকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। এপ্রিল মাসে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে একটি নোটিশ জারি করে জনসাধারণকে সতর্ক করা হয়েছিল, কেউ যদি পিডিএফ গেইম খেলে তাহলে তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হবে। নোটিশে বলা হয়, নির্বাসিত ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের মতো বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন, এই গেইমটি তৈরি করেছে, যাতে পিডিএফের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা যায়। তারা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবিশ্বাসের বীজ বপন করেছে এবং এভাবে তাদের সেনাবাহিনী বিরোধী বিপ্লবী চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। তবে সেনাবাহিনীর হুমকি কো টুটের ওপর কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। তারা যা বলছে তাতে আমার কিছু যায় আসে না, তিনি বলেন। তারা ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার গেইমটি বন্ধ করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হয়নি। ডিজিটাল হামলা আটকানোর কোন উপায় তাদের নেই, সামরিক বাহিনীকে পরাজিত করতে তার অনলাইন প্রচেষ্টার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এ কথা বলেন কো টুট। কো টুটের দাবি, গেইমটি এরিমধ্যে প্রায় এক মিলিয়ন বার ডাউনলোড হয়েছে। যদিও গুগল প্লে বলছে যে এটি পাঁচ লাখ বারের বেশি ডাউনলোড হয়েছে, আর অ্যাপল তাদের ডাউনলোডের সংখ্যা সম্পর্কে কোন তথ্য দেয়নি।
তিনি মনে করেন, সংগ্রহ করা তহবিলের পরিমান তার অনুমানের চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে, কারণ, ছোট একটি দল নিয়ে কাজ করার কারণে কিছু ক্ষেত্রে অর্থ পেতে তার দীর্ঘ সময় লেগেছে। এই তহবিল স্থানীয় পিডিএফ মানে জান্তা বিরোধী সংগঠন পিপলস ডিফেন্স ফোর্সে পাঠানো হয়, এবং সেটি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর জন্য খাদ্য ও অস্ত্রের পাশাপাশি মানবিক সহায়তার জন্য ব্যবহার করা হয়। সেই সাথে সংঘাতের কারণে বাস্তুচ্যুত শিশু এবং সামরিক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে আহতদের সহায়তা দেয়া হয়। আমরা সশস্ত্র গ্রুপগুলোতে অর্থ পাঠাই, কিন্তু তারা কীভাবে এ অর্থ খরচ করবে সে বিষয়ে আমরা কিছু বলি না।
দুই বছর আগে ২০২১ সালে সেনা অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হওয়া সংগঠন পিপলস ডিফেন্স ফোর্স পিডিএফের সাথে দেশটির সীমান্তবর্তী এলাকায় কয়েক দশক ধরে সক্রিয় বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র দলগুলোর সংযোগ আছে। তাদের শক্তি সম্পর্কে যেমন ধারণা করা হয়েছিল তার চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী বাহিনী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে পিডিএফ এবং ইতোমধ্যেই তাদের কাছে দেশটির বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। কো টুট বলছেন, সীমিত অর্থ এবং অস্ত্রের নেটওয়ার্ক, আর তৃণমূল থেকে সংগ্রহ করা তহবিল দিয়ে অস্ত্র এবং অন্যান্য রসদ কেনা কঠিন, যেখানে দিনকেদিন যুদ্ধের তীব্রতা বাড়ছে। কো টুট জানিয়েছেন, তিনি বেশ কয়েকবার সবকিছু ছেড়ে দেয়ার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু মিয়ানমারের পরিস্থিতি প্রতিদিন খারাপ হচ্ছে” এবং তিনি জান্তা বিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন করা চালিয়ে যেতে চান। গেইমটি অনেক সম্ভাবনাময়” বলে জানিয়ে কো টুট আশা প্রকাশ করেন যে, এক সময় তিনি হয়ত এটা থেকে মাসে এক মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত রোজগার করতে পারবেন। আমি আশা করি এই অর্থ মিয়ানমারের মানুষের কাজে লাগবে, যাদের এটি খুব প্রয়োজন।বিবিসি বাংলা