ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ৯১তম আত্মাহুতি দিবস আজ ২৪ সেপ্টেম্বর। আজ থেকে ঠিক ৯১ বছর আগে ১৯৩২ সালের আজকের দিনে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে আক্রমণের নেতৃত্ব দেন প্রীতিলতা। আক্রমণ শেষে আহত অবস্থায় ফেরার পথে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার এড়াতে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মাহুতি দেন তিনি। শোকে, বিষাদে আজ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রথম নারী শহীদ প্রীতিলতাকে স্মরণ করবে মানুষ। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের আত্মাহুতি দিবস উপলক্ষে পটিয়া গৌরব সংসদের উদ্যোগে আজ বিকেল চারটায় পটিয়া ক্লাবে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। স্বাধীনতার ভিত্তিভূমি রচনা করতে গিয়ে পুরো পৃথিবীতে যে বিপ্লবীরা হাসিমুখে মৃত্যুকে বরণ করেছেন, সেই অমৃত সন্তানদের একজন চট্টগ্রামের পটিয়ার প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। মেধাবী ছাত্রী প্রীতিলতার স্কুলজীবন থেকে গভীর আগ্রহ ছিল দেশ-বিদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সম্পর্কে বীরত্বব্যঞ্জক গল্প শোনা, দেশাত্মবোধক ঘটনাপঞ্জি নিজের সংগ্রহে রাখা। ডা. খাস্তগীর ইংলিশ হাইস্কুলে পড়ার সময় তিনি বিপ্লবী ক্ষুদিরামের ফাঁসির কথা জানতে পারেন। চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের নায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের সংগ্রামী জীবনের অনেক ঘটনা তাঁর কিশোরী মনে রেখাপাত করেছিল। প্রীতিলতার জন্ম ১৯১১ সালের ৫ মে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট ইউনিয়নের দক্ষিণ সমুরা গ্রামে। তাঁর বাবার নাম জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার। তিনি চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল অফিসের কর্মকর্তা ছিলেন। মায়ের নাম প্রতিভা ওয়াদ্দেদার। ছয় ভাইবোনের মধ্যে প্রীতিলতা ছিলেন দ্বিতীয়। প্রীতিলতার ডাকনাম রাণী। ছদ্মনাম ফুলতার। ব্রিটিশদের হাত থেকে দেশকে স্বাধীন করার জন্য নিজেকে গড়ে তোলার পাশাপাশি অসংখ্য বিপ্লবীকে প্রশিক্ষিত, অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করে গেছেন এ বীরকন্যা। ডা. খাস্তগীর বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে লেটার মার্কসহ ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন প্রীতিলতা। এরপর ইডেন মহিলা কলেজে ভর্তি হন। সেখানে পড়ার সময় থেকেই বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন এ বীরকন্যা। ১৯২৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মিলিত মেধা তালিকায় পঞ্চম স্থান এবং মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে আইএ পাস করেন তিনি। এরপর কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে ১৯৩২ সালে তিনি দর্শনে স্নাতক পাস করেন। এ কলেজে পড়ার সময় বিপ্লবী দলে মেয়ে সদস্য ও ছাত্রীদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। আর ১৯৩২ সালে চট্টগ্রামে ফিরে গিয়ে নন্দনকানন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন। প্রীতিলতা যখন বিপ্লবী দলের সদস্য হতে চান, সে সময় মাস্টারদা সূর্য সেন পলাতক ছিলেন। তবে প্রীতিলতার প্রবল আগ্রহে ও বহু চেষ্টার পর ১৯৩২ সালের মে মাসে মাস্টারদার সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পরিকল্পনা হলে প্রীতিলতার নেতৃত্বে থাকা দলটিকে বোমা তৈরির খোল আনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। নির্দেশ পেয়ে ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে সামরিক পোশাকে প্রীতিলতা মৃত্যুভয়হীন কয়েকজন তরুণকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। আক্রমণ শেষে ফেরার সময় গুলিবিদ্ধ হন তিনি। পরে ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ার আশঙ্কায় পকেটে থাকা পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মাহুতি দেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়ার বীরকন্যা প্রীতিলতা। ৮০ বছর পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের দুই প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেত্রী বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও বীণা দাসকে মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, বিপ্লবীদের প্রতি সম্মান জানাতেই এই মরণোত্তর ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে। ২০১২ সালের ২২ মার্চ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে এই ডিগ্রি দেয়া হয়। রাজ্য সরকারের পক্ষে এই ডিগ্রির সনদ গ্রহণ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য এবং তিনি তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেন।
এই সনদ বিশ্ববিদ্যালয়েই সংরক্ষণ করা হয়। প্রীতিলতার মতো এমন বিপ্লবী দেশপ্রেমিক ফিরে আসুক যুগে যুগে শতবার। জাতির ক্রান্তিকালে প্রীতিলতার মতো বীরকন্যাদের বড়ই প্রয়োজন। বীরকন্যা প্রীতিলতার দুঃসাহসী মনোভাব, সংগ্রামী জীবন ও দেশপ্রেমিক চেতনা বর্তমান প্রজন্মের জন্য প্রেরণার প্রতীক হয়ে থাকুক ৯১ তম আত্মাহুতি দিবসে এ বীর কন্যার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।