বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:১১ অপরাহ্ন

প্রবীণদের সামাজিক সুরক্ষা: কতিপয় সুপারিশ

ড. মো. রবিউল ইসলাম
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৩

মানবজীবন পরিক্রমার সর্বশেষ, অবশ্যম্ভাবী ও স্বাভাবিক পর্যায় হচ্ছে বার্ধক্য। কারো যদি অকালমৃত্যু না হয়, তবে প্রত্যেককেই এই জীবনের স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। বার্ধক্যের আঘাত সর্বজনীন। আর এই অবস্থায় উপনীত হলে ব্যক্তি নতুন পরিচয়ে পরিচিত হয় বৃদ্ধবৃদ্ধা, বয়স্ক, বুড়াবুড়ি, প্রবীণ বা সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে। এই সময়ে পৌঁছে মানুষ যেসব অবস্থা ও সমস্যার সম্মুখীন হয়, তা তার কাছে অভিনব, অপ্রতিরোধ্য, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনেক ক্ষেত্রে তার নিজের পক্ষে এগুলোর সমাধান তথা মোকাবিলা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। দৈহিক, মানসিক, আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিকসহ সব ধরনের সমস্যাই প্রবীণদের গ্রাস করতে চায়। বিশ্বে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। ২০৫০ সালের মধ্যে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বিশ্বে দ্বিগুণ হবে, যা প্রায় ২ দশমিক ১ বিলিয়নে পৌঁছাবে বলে অনুমান করা হয়। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ প্রবীণ উন্নয়নশীল দেশে বসবাস করে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০৫০ সালে বিশ্বের ১০ জনের মধ্যে প্রায় আট জন প্রবীণ উন্নয়নশীল অঞ্চলে বসবাস করবে এবং তাদের মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি বয়স্ক নারী থাকবেন। একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে এই হার অনেকটাই সত্য। বাংলাদেশে প্রবীণদের হার যেমন বেড়ে চলেছে, তেমনি বেড়ে চলেছে তাদের বঞ্চনার পরিমাণও। বিগত কয়েকটি আদমশুমারি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০০১ ও ২০১১ সালে ৬০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ০৫ ও ১০ মিলিয়ন, যা ২০২২ আদমশুমারিতে এসে দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৩ মিলিয়ন এবং মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ ও ২০৫০ সাল নাগাদ এ দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়াবে যথাক্রমে ১৭ দশমিক ৬২ ও ৪৩ দশমিক ০২ মিলিয়ন, যা মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশ ও ২০ শতাংশ হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৫০ সালে এ দেশে বয়স্ক মানুষের বিস্ফোরণ ঘটবে এবং গড়ে পাঁচ জনে এক জন প্রবীণ হবেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোনো দেশের মোট জনসংখ্যার ১০ থেকে ১২ শতাংশ প্রবীণ হলে ঐ দেশকে বার্ধক্য জনসংখ্যার দেশ ধরা হয়। সে হিসাবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ বিশ্বে বার্ধক্য জনসংখ্যার দেশ হিসেবে বিবেচিত হবে। শুধু সংখ্যায় তারা দ্রুত বাড়ছেন তা-ই নয়; তাদের অধিকারগত প্রয়োজন মেটানোর মতো পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সমতা ক্রমেই গভীর সংকট এবং তীব্র চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে পড়ছে। আধুনিককালে বিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নয়ন মানুষের আয়ুষ্কাল বাড়িয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। বর্তমানে বাংলাদেশে গড় আয়ুষ্কাল প্রায় ৭৪ বছর। বাংলাদেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠী বৃদ্ধির একটি উদ্বেগজনক হার হলো ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব জনসংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। আদমশুমারি ২০২২-এ দেখা যায়, ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব জনসংখ্যা ৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন, যা মোট জনগোষ্ঠীর ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। প্রবীণ জনসংখ্যাকে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম। ২০০২ সালে ১৫৯টি দেশের উপস্থিতিতে মাদ্রিদে প্রবীণ জনসংখ্যাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য ৪৫টি ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়, যার পঞ্চমটি বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি। অতি সম্প্রতি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শিশু বৃদ্ধির হারের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। ফলে মোট প্রবীণ জনসংখ্যা শিশু জনসংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে। আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী যৌথ পরিবারব্যবস্থায় প্রবীণেরা অতীতে নিরাপদ ও সম্মানজনক জীবন যাপন করতেন। মূলত তারাই পরিবার পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করতেন। কিন্তু বিশ্বায়নের এই যুগে যৌথ পরিবারব্যবস্থা ভেঙে তৈরি হচ্ছে একক পরিবার। দারিদ্র্য, ভূমিহীনতা, সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধের পরিবর্তন, যুবশ্রেণির গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তর, শিল্পায়ন ও নগরায়ণ, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জীবনধারণ সামগ্রীর উচ্চমূল্য, বস্তুতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা ইত্যাদি কারণে আজকে যৌথ পরিবারব্যবস্থা ভেঙে একক পরিবারে রূপ নিচ্ছে।
আর এই পরিবর্তনশীলতার নীরব শিকার হচ্ছে প্রবীণ জনগোষ্ঠী। এ দেশের শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ লোক গ্রামে বসবাস করে। এ হিসাবে মোট প্রবীণের প্রায় ৭৫ শতাংশ গ্রামে বাস করে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আর্থসামাজিক সমস্যা নিরূপণ করলে দেশের ৫৫ শতাংশের অধিক প্রবীণ দারিদ্র্যসীমার নিচে গ্রামে বাস করে। এই ব্যাপক দারিদ্র্যের মধ্যে অধিকাংশ প্রবীণ স্বাস্থ্য সমস্যাসহ বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার শিকার হচ্ছেন। গ্রামাঞ্চলে অনেক পরিবারেই সন্তানেরা পিতামাতাকে বিষয়সম্পত্তির মতো নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়ে থাকে। ফলে চিকিৎসাসহ মৌলিক সেবা থেকে প্রবীণেরা বঞ্চিত হন। প্রবীণেরা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে উপেক্ষিত, অবহেলা, বঞ্চনা, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদির শিকার হয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থায় সমাজের বাড়তি বোঝা হিসেবে বিবেচিত হয়ে চরম হতাশা ও হীনম্মন্যতায় ভোগেন। সচ্ছল পরিবারে প্রবীণদের অবস্থা তত খারাপ নয়, তবু তাদের অনেকেই পারিবারিক ভাঙন, মানসিক পীড়ন, নিঃসঙ্গতা এবং অযতœ-অবহেলার শিকার। শহরে বসবাসরত প্রবীণ স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা কিছুটা ভোগ করলেও গ্রামে তা একেবারেই অনুপস্থিত বলা যায়। শহরাঞ্চলে প্রবীণ দম্পতি বা একাকী প্রবীণের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তাদের দেখভাল বা পেশাগত সেবাদান আমাদের সমাজব্যবস্থায় এখনো গড়ে ওঠেনি। প্রবীণদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ও পেলিয়াটিভ সেবা দরকার। কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা তেমন সচেতন নই। সরকার বয়স্ক ব্যক্তিদের সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তায় বয়স্ক ভাতা প্রদানসহ জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা, ২০১৩ এবং পিতামাতা ভরণপোষণ আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করেছে। প্রবীণদের সামাজিক সুরক্ষায় নি¤েœাক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে :১) প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন আইন প্রণয়ন করা এবং তা বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা; ২) প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সামাজিক বিমার আওতায় নিয়ে আসা; ৩) প্রজন্মের মধ্যে পারিবারিক বন্ধন, সংহতি ও ঐক্য সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষা ও সচেতনতামূলক প্রচারণা কার্যক্রম পরিচালনা করা; ৪) দারিদ্র্যপীড়িত প্রবীণ পরিবারসমূহে সহজ শর্তে অথবা বিনা সুদে কৃষিঋণ প্রদান, আয়বৃদ্ধিমূলক কর্মকা-ে ঋণ প্রদান ও রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে এগিয়ে আসতে হবে; ৫) প্রবীণ পিতামাতার ভরণপোষণে সন্তান ও নাতিনাতনিদের আইনগত বাধ্যবাধকতা নির্ধারণে পিতামাতা ভরণপোষণ আইন, ২০১৩ বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা; ৬) বিদ্যমান বয়স্ক ভাতার পরিমাণ ও সংখ্যা বাড়িয়ে এ দেশের দুস্থ, অসহায় ও দরিদ্র প্রবীণদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করা; ৭) কর্মক্ষম প্রবীণের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে দেশে চলমান ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে তাদের প্রাধান্য দেওয়া; ৮) গণমাধ্যমসমূহে প্রবীণদের জীবনের বিভিন্ন দিক, পরিচর্যা, সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা। শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক পর্যায় থেকে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বার্ধক্যের বিষয়টি পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা, যাতে নবীন ও তরুণ শিক্ষার্থীরা প্রবীণদের সম্পর্কে সচেতন, শ্রদ্ধাশীল ও দায়িত্বশীল হওয়ার গুণাবলি অর্জন করতে পারে। দেশে জেরিয়াট্রিক বিশেষজ্ঞ সৃষ্টির লক্ষ্যে স্বাস্থ্য শিক্ষাব্যবস্থায় জেরিয়াট্রিক মেডিসিন ও জেরিয়াট্রিক সেবার বিষয়টি চালু করা।
এখানে আশার আলো যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে বার্ধক্য বিষয়ে পঠনপাঠনের জন্য জেরোন্টোলজি অ্যান্ড জেরিয়াট্রিক ওয়েলফেয়ারÍ এবৎড়হঃড়ষড়মু ধহফ এবৎরধঃৎরপ ডবষভধৎব শিরোনামে দেড় বছরের মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু হয়েছে; ৯) সরকারি ও বেসরকারি প্রতিটি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রবীণদের স্বাস্থ্য ও সেবাদানের জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। দরিদ্র প্রবীণদের জন্য স্বল্পমূল্যে অথবা বিনা মূল্যে ডাক্তার দেখানো থেকে শুরু করে ওষুধ প্রদান, চিকিৎসা উপকরণ সরবরাহ এবং বিভিন্ন প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা এবং প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে জেরিয়াট্রিক ওয়ার্ড চালু করা; ১০) ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ইত্যাদিতে সাপ্তাহিক ধর্মীয় বিশেষ দিনে প্রবীণদের প্রতি সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য তুলে ধরা; ১১) প্রবীণ নাগরিকদের জন্য বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত সিনিয়র সিটিজেন কার্ড প্রবর্তন করা এবং সব ধরনের যানবাহনে প্রবীণদের জন্য আসন সংরক্ষণ, বিশেষ ছাড়ে অথবা স্বল্পমূল্যে টিকিট প্রদান করা; এবং ১২) প্রবীণ নারীর দেনমোহর ও উত্তরাধিকার সম্পত্তি প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্র কর্তৃক কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা। লেখক: বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ ও অধ্যাপক, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং মহাসচিব, বাংলাদেশ জেরোন্টোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএ)




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com