শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:২২ অপরাহ্ন

চৌরঙ্গী

শংকর
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৩

(শংকর এক জন জনপ্রিয় লেখক । তাঁর আসল নাম মণিশংকর মুখোপাধ্যায় বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়তাঁর ‘সীমাবদ্ধ’ এবং ‘জনঅরণ্য’ কাহিনী অবলম্বনে ছবি বানিয়েছেন। তাঁর ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাসটিও সিনেমা হয়েছে। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয়করেছেন উত্তম কুমার। সেই প্রসঙ্গে শংকর বললেন, ‘সত্যজিৎই আমাকে সকলের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, ছড়িয়ে দিয়েছে।’
১৯৩৩ সালের ৭ ডিসেম্বর যশোরের বনগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আইনজীবী বাবা হরিপদ মুখোপাধ্যায়দ্বিতীয়বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই চলে যান কলকাতার ওপারে হাওড়ায়। সেখানেই শংকরের বেড়ে ওঠা, পড?াশোনা ও সাহিত্য সাধনার শুরু। জীবনের শুরুতে কখনও ফেরিওয়ালা, টাইপরাইটার ক্লিনার, কখনও প্রাইভেট টিউশনি, কখনও শিক্ষকতা অথবা জুট ব্রোকারের কনিষ্ঠ কেরানিগিরি করেছেন। এক ইংরেজের অনুপ্রেরণায়শুরু করেন লেখালেখি। ‘বোধোদয়’ উপন্যাস প্রকাশের পর শংকরকে উৎসাহবাণী পাঠান শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বলেছিলেন ‘ব্রাইট বোল্ড বেপরোয়া’। ভাবনা বা প্রকাশভঙ্গিতে তাঁর এই উপন্যাস নিজের অন্য লেখালেখি থেকে অন্য রকম হওয়ায় তিনি তা পড়তে দিয়েছিলেন মুম্বইনিবাসী শরদিন্দুকে। শরদিন্দু সেই লেখা পড়ে বলেছিলেন, ‘তোমার এই লেখায়জননী জন্মভূমিকেই আমি সারাক্ষণ উপলব্ধি করলাম।’ পাঠকমহলের ‘নিন্দা ও প্রশংসার ডালি নিয়ে আমি নিজেও এক সময়‘বোধোদয়’কে ভালবাসতে শুরু করেছি’, বলেন মণিশংকর মুখোপাধ্যায়। সম্প্রতি আশি পেরিয়েছেন শংকর। এখনও সমান তালে লিখে চলেছেন। ইদানীং তাঁর আগ্রহের বিষয়বস্তু স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী। স্বামীজির জীবনের অনেক না জানা তথ্য প্রকাশিত হয়েছে শংকরের লেখায় আমি বিবেকানন্দ বলছি, অচেনা অজানা বিবেকানন্দ, অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ। শংকরের লেখা বই আজও বেস্ট সেলার।)
ইন্টারনেটের সৌজন্যে খবরপত্রের পাঠকদের জন্য পত্রস্থ করা হলো।- বি.স
(পূর্ব প্রকাশের পর)
জুনো ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারলেন না।হোয়াত্? ফাদার সতু, তোমার ফাদার সেই সময় হাজির ছিলেন?
না, সায়েব, না। তোমাকে এতদিন ধরে বেঙ্গলি শেখাবার চেষ্টা করছি, কিন্তু সব বৃথা। ফাদার সতু মানে হল বাবা সতু, অর্থাৎ কি না আদর করছে। বোসদা বললেন।
জুনো এবার সত্যিই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ইংরিজিতে বললেন, সত্যি, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। ছেলে কেমন করে বাবা হয়?
কেন হবে না? সত্যদা প্রশ্ন করলেন। তোমাদের মায়ের কাছে ছেলে যদি ডার্লিং হতে পারে তবে আর এক পা এগিয়ে বাবা হতে কী আপত্তি আছে?
জুনো এবার ঘোঁত ঘোত করে হেসে ফেললেন। তোমার সঙ্গে তর্কে কেউ পারবে না। ওনলি কোনোদিন তোমার ভাই, আই মিন ইওর জেনানা, যদি পারে।
পারবে পারবে, আর একজন পারবে। দিস বয়। বোসদা আমাকে দেখিয়ে জুনোকে বললেন। খুব ভালো ছেলে। এত ভালো ছেলে যে, ওকে তোমার একটা স্পেশাল আইসক্রিম দেওয়া উচিত; যাতে ভবিষ্যতে ও তোমার বিরুদ্ধে কখনও মুখ খুলতে না পারে।
জুনো এতই খুশি হলেন যে, ওয়েটারকে হুকুম না দিয়ে নিজেই ফ্রিজিডিয়ার থেকে দুটো আইসক্রিম বার করে এনে দিলেন।
আইসক্রিমের পর কফি এল। বোসদা কফির কাপে চুমুক দিয়ে নিজের মনেই বললেন, বারমেড! তৃষ্ণার্ত অতিথির সুরাপাত্র সুন্দরী মধুর হাসিতে ভরিয়ে দিচ্ছেন। চমৎকার। একদিন এখানেও ছিল। আজ থাকলে ক্লাইভ স্ট্রিটের সায়েবরা, শুধু সায়েবরা কেন, বাঙালি, মাড়ওয়ারি, গুজরাটি, চিনে, জাপানি, রাশিয়ান, যুবক, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ, কে না খুশি হত? শাজাহান হোটেলের বার-এর আরও শ্রীবৃদ্ধি হত। আরও অনেক টুল দিতে হত। আরও অনেক বোতল সোডা রোজ নিতে হত, আরও অনেক বেশি রসিদ কাটতে হত, আরও অনেক বেশি টাকা ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে পাঠাতে হত। গভরমেন্ট ট্যাক্স বাড়িয়েছে; গোদের উপর বিষফোড়ার মতো আমরা আরও মদের দাম বাড়াতে পারতাম। কী সুন্দর হত!
বারমেড! বড় ইংরেজি কথা। বোসদা নিজের মনেই আবার বললেন। তারপর আমাকে বললেন, একটা আইসক্রিম খাইয়েছি, ব্রেন নিশ্চয়ই ঠান্ডা হয়ে আছে। কথাটার বাংলা প্রতিশব্দ একটা বলো দিকিনি।
আমার মাথায় কিছু আসছিল না। বললাম, রুবাইয়াতে পড়েছি সাকী।
দুর, ও তো আর বাংলা হল নাÍবোসদা বললেন। ওরা যা ছিল, তার একটি মাত্র বাংলা হয়। অর্থাৎ কি না বারবনিতা।
বারবনিতার নেশায় আমরা যখন কুঁদ হয়ে আছি, ঠিক সেই সময় জুনো বললেন, একজন জোয়ান মদ্দ তোমাদের দুজনকেই একসঙ্গে খুঁজছেন। বিরক্ত হয়ে চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বোসদা বললেন, দেখো তো আমাদের তপোবনের এই নিষাদটি কে।
তপোবনের এ নিষাদটি স্বয়ং সাদারল্যান্ড ছাড়া আর কেউ নন। আমাকে দেখেই বললেন, আমি বাইরে লাঞ্চ করতে যাচ্ছি। যাবার আগে তোমাকে মনে করিয়ে দিয়ে গেলাম।
আমি বললাম, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। মনে করিয়ে দেবার কোনো প্রয়োজন নেই। মিস্টার হবসের সঙ্গে দেখা আমাদের হবেই।
আমার এ কাহিনি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হতে দেখলে, যিনি সবচেয়ে খুশি হতেন, আজ তিনি ইহলোকে নেই। চৌরঙ্গীর অন্তরের কথা পাঠকের কাছে নিবেদন করবার পরিকল্পনা তিনিই আমাকে দিয়েছিলেন। উৎসাহ দিয়েছিলেন, উদ্দীপনা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, খোঁজ করো, অনেক কিছু পাবে। কিন্তু তাঁর জীবিতকালের মধ্যে সে কাজ আমার পক্ষে করে ওঠা সম্ভব হয়নি। কলকাতার বুকের উপর তার সুদীর্ঘ দিনের অস্তিত্বের কোনো প্রমাণও আজ নেই। তাঁর নামাঙ্কিত একটা দোকান চৌরঙ্গীর ইতিহাসের একটা প্রয়োজনীয় অংশ হয়ে কিছুদিন টিকে ছিল। সে দোকানটাও সকলের অলক্ষ্যে কলকাতার বুক থেকে কখন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।
পুরনো অনেকেই হয়তো আজও হবসকে মনে রেখেছেন, আমাদের যুগের কয়েকজনও তাকে হয়তো মনে রাখব, তারপর একদিন তার স্মৃতি চিরদিনের মতো ব্যস্ত কলকাতার ব্যস্ততর নাগরিকদের মন থেকে মুছে যাবে।
শাজাহান হোটেল থেকে বেরিয়ে আমরা এসপ্ল্যানেডে এসে পড়েছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে সাদারল্যান্ড বলেছিলেন, তোমাদের এই পথ দিয়ে হাঁটতে আমার কেমন অস্বস্তি লাগছে। প্রতি পদক্ষেপে যেন ইতিহাসের কোনো আশ্চর্য অধ্যায়কে মাড়িয়ে চলেছি। সেসব দিনের ইতিহাসের কোনো সাক্ষীই আজ নেই। পুরনো কলকাতার অনেক নিদর্শন ছিল এই রাস্তার উপর! সেসব তো কবে তোমরা ভেঙে উড়িয়ে দিয়েছ।
হাঁটতে হাঁটতে সাদারল্যান্ডের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললাম, এখনও একটা সাক্ষী রয়েছে। ঘনগাছের বোরখার মধ্য দিয়ে সুন্দরী রাজভবন, অনেকদিন থেকে অনেক কিছুই দেখছে।
সাদারল্যান্ড বললেন, এমন একদিন আসবে, যখন টেপ রেকর্ডারের মতো চধংঃ ৎবপড়ৎফবৎ কিনতে পাওয়া যাবে। সেই যন্ত্র দিয়ে যে-কোনো পুরনো বাড়ির সামনে বসে আমরা তার আত্মজীবনী শুনতে পাব।
সত্যি, তা যদি সম্ভব হয় কোনদিন।
একেবারে নিরাশ হয়ো না-সাদারল্যান্ড বললেন। ওই যন্ত্র দেখে যাবার মতো দীর্ঘদিন আমরা নিশ্চয়ই বেঁচে থাকব। অতীতকে উদ্ধার করাটা খুব শক্ত কাজ হবে না। কারণ, আমরা যা করছি, যা বলছি, এমন কি যা ভাবছি তার কিছুই তো নষ্ট হচ্ছে না। শুধু এক জায়গা থেকে বেরিয়ে মহাশূন্যের অন্য এক কোণে জমা হচ্ছে।
আমি বললাম, সেই জন্যেই বুঝি আমাদের কবি বলে গিয়েছেন, জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা।
সাদারল্যান্ড হাসতে হাসতে বললেন, মূক অতীতকে যেদিন আমরা কথা বলাতে পারব, সেদিন সমস্ত পৃথিবী নতুন রূপ গ্রহণ করবে। বিপদে পড়বেন শুধু ঐতিহাসিকরা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হয়তো চাকরিও যাবে। অধ্যাপকগবেষকদের বদলে একজন অপারেটর রেখে দিলেই কাজ চলে যাবে!
সাদারল্যান্ড ছোট ছেলের মতো নিজের মনেই হেসে ফেললেন।
তাঁর কথাবার্তা শুনে কে বলবে, ওঁর বিষয় ডাক্তারি! ইতিহাসের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই?
ফুটপাথের উপর একটা খাঁচা এবং গোটাকয়েক টিয়াপাখি নিয়ে একটা ছোকরা বসে ছিল। সাদারল্যান্ড একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কি?
আমি হেসে বললাম, ফিউচার রেকর্ডার। ভবিষ্যতের যত কিছু দলিল সব এর কাছে আছে। সব কিছুই এখানে জানতে পারা যাবে।
সাদারল্যান্ড বাঁ হাতের সঙ্গে ডান হাতটা ঘষতে ঘষতে বললেন, ভবিষ্যৎকে আমি বড্ড ভয় করি। একটু তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে আমরা এগিয়ে যাই।
মিস্টার হবস আমাদের জন্যই বোধহয় অপেক্ষা করছিলেন। বৃদ্ধ ভদ্রলোক তার দুটি হাত বাড়িয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন।
বারমেড? বৃদ্ধ হবস আমাদের প্রশ্নে যেন কোন সুদূর অতীতে ফিরে গেলেন। সেসব দিন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে, নেভার টু রিটার্ন।
একজন শুধু যে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতেন। তার নাম মিসেস ব্রকওয়ে। ইউনিয়ন চ্যাপেলের পাদ্রি ফাদার ব্রকওয়ের সহধর্মিণী, তিনি নিজের মনেই বললেন।
ডাক্তার সাদারল্যান্ড মাথা নাড়লেন। আমি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মেম্বার ভারতবন্ধু ফ্রেনার ব্রকওয়ের সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টা করেছিলাম। ওঁর মায়ের কথা জানবার খুব আগ্রহ ছিল। কিন্তু কোনো খবর পাওয়া সম্ভব হল না। শুধু শুনলাম, ইউনিয়ন চ্যাপেলের পাদ্রির সন্তান ফ্?েনার ব্রকওয়ে কলকাতাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ভারতবর্ষের প্রতি তার গভীর মমতার কারণ তখন আমার বোধগম্য হল।
হবস বললেন, মিসেস ব্রকওয়ে কলকাতার বারমেডদের জন্যে চিন্তা করতেন। ওদের জন্য চোখের জল পর্যন্ত ফেলেছেন শুনেছি। তার নজরে
পড়লে, আজও আমরা এতক্ষণ শাজাহান, কিংবা যে কোনো হোটেলের বার-এ বসে নারীপরিবেশিত বীয়ারের মগ বা হুইস্কির পেগ উপভোগ করতে পারতাম।
ডাক্তার সাদারল্যান্ড গভীরভাবে অথচ লজ্জিত কণ্ঠে বললেন, আমি অবশ্য ড্রিঙ্ক করি না।
তুমি ড্রিঙ্ক করো না! হবস অবাক হয়ে গেলেন।খুব সাবধান, মিস্টার গ্যান্ডির শিষ্যরা জানতে পারলে তোমাকে আর দেশে ফিরতে দেবে না। সবরমতী বা অন্য কোনো নদীর ধারে একটা ছোট্ট চালাঘরে তোমাকে। ডিসপেন্সারি করে দেবে, এবং সেইখানেই তোমাকে চিরদিনের জন্যে থেকে যেতে হবে।
ডাক্তার সাদারল্যান্ড মৃদু হাসলেন। চমক্কার হয় তাহলে। ডাক্তারি কতটুকুই বা জানি আমি। কিন্তু যতটুকু জানি তাতে এইটুকু বুঝেছি, ইন্ডিয়ার এখন অনেক ডাক্তার চাই। অসংখ্য কাজ জানা লোকের দরকার।
হবস আবার বারমেডদের কথায় ফিরে এলেন। দোজ গুড় ওল্ড ডেজ।
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার জেনারেল-নলেজ একটু পরীক্ষা করা যাক। বল দেখি, সুয়েজ খাল দিয়ে কোন সালে জাহাজ চলতে আরম্ভ করল?
ফার্ডিনান্ড ডি লেসেপস নামে এক ফরাসি ভদ্রলোক সুয়েজখাল কেটেছিলেন, এইটুকু শুধু ইস্কুলে ভূগোল বইতে পড়েছিলাম। কিন্তু কবে তিনি কী করেছিলেন, কোন সালে লোহিতসাগর ও ভূমধ্যসাগরের জল মিলে মিশে ইউরোপ ও এশিয়াকে দৃঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেছিল, তা আমার জানা ছিল না। সুয়েজখালের সঙ্গে আমাদের গল্পের কী যে সম্পর্ক আছে বুঝতে পারছিলাম না।
মিস্টার হবস বললেন, আমাদের গল্পের সঙ্গে সুয়েজখালের নিবিড় সংযোগ আছে। সুয়েজখাল যখন ছিল না, তখন উত্তমাশা অন্তরীপ প্রদক্ষিণ করে বেপরোয়া অ্যাডভেঞ্চার-লোভী ছোকরারা কলকাতায় আসত, হোটলের অভাবে চাদপালঘাটের কাছে বজরায় রাত্রি যাপন করত। কিন্তু তাদের চিত্ত বিনোদনের জন্য কোনো নীলনয়না সমুদ্রের ওপার থেকে ছুটে আসত না। নিতান্ত প্রয়োজন হলে এ দেশের দিশি জিনিস দিয়েই তৃষ্ণা নিবারণ করতে হত।
তারপর ১৭৬২ সালে উইলিয়াম পার্কার কলকাতার ভদ্দরলোকদের চিত্তবিনোদনের জন্য পানশালা খুলতে চাইলেন। তখন কেবল মদের কথাই উঠেছিল, কিন্তু বার-বনিতার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়নি। বোর্ডও লাইসেন্স দিয়েছিলেন এই শর্তে যে, বাগানবাড়িটা সকালবেলায় খুলে রাখা চলবে না, সকালে খোলা থাকলে, ছোকরা সায়েবসুবোরা কাজে ফাঁকি দেবে।
তারপর একে একে কত মদের দোকানই তো ভোলা হল। কিন্তু সব জায়গাতেই বারম্যান, দেশি ভাষায় খিদমতগার।
সুপ্রিম কোর্টে নন্দকুমারের বিচারের সময় ব্যারিস্টার এবং তাদের শাগরেদদের খাওয়ানো-দাওয়ানোর কন্ট্রাক্ট নিয়েছিলেন যিনি, সেই লে গ্যালের ট্র্যাভানেও বারমেড ছিল না। সেই সস্তাগ-ার দিনেও লে গ্যালে প্রতিটি লাঞ্চ এবং প্রতিটি ডিনারের জন্যে দুটাকা চার আনা দাম নিতেন। সুপ্রিম কোর্টে খাবার পাঠাবার অর্ডার দিয়েছিলেন মোহনপ্রসাদ। প্রতিদিন যোলোটি লোকের লাঞ্চ অর যোলোটি লোকের ডিনার।
নন্দকুমারের ফাঁসির খবর আমরা রাখি, কিন্তু লে গ্যালের খবর আমরা রাখি না। ইম্পের রায় বেরুলো, নন্দকুমার সিম্পসন কোম্পানির ফাঁসিতে চড়ে ইতিহাসে অমর হয়ে রইলেন, কিন্তু মোহনপ্রসাদ-এর দেখা নেই। শেষ পর্যন্ত লাঞ্চ ও ডিনারের টাকা আদায়ের জন্য লে গ্যালে কোর্টে গিয়েছিলেন। মামলা করে ছশো উনত্রিশ টাকা আদায় করতে হয়েছিল তাঁকে।Íমিস্টার হবস আমাদের এবার কফি-পাত্র এগিয়ে দিলেন।
আমরা আপত্তি করতে যাচ্ছিলাম, তিনি শুনলেন না। হেসে বললেন, আমি ভারতবিদ্বেষী নই। কিন্তু যাঁদের ধারণা ইন্ডিয়া কফিহাউস ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও কফি তৈরি হয় না, তারা এখানে এসে একবার দেখতে পারেন!
আমাদের বিমুগ্ধ মুখের দিকে না তাকিয়েই, মিস্টার হবস বললেন, বক্ষে সুধা এবং হস্তে সুরাপাত্র নিয়ে ইংলন্ডের অষ্টাদশীরা সুয়েজখাল কাটার পর থেকেই কলকাতায় আসতে লাগলেন। ১৮৬৯ সালে সুয়েজখাল কাটার পর থেকেই চার্নক নগরের রেস্তোরাঁ এবং হোটেলগুলো যেন জমজমাট হয়ে উঠলো।
আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হবস ধীরে ধীরে সেই অতীতে ফিরে গেলেন, যেখানে বার-বনিতারা বার-এ দাঁড়িয়ে মদ পরিবেশন করত। এখানকার মেয়ে নয়। খাস বিলেতের মেয়ে। কাগজে বিজ্ঞাপন বেরুতোলন্ডন থেকে অমুক জাহাজ যোগে আমাদের নতুন বারমেড এসে পৌঁছেছেন।
কেউ আসতেন ছমাসের কন্ট্রাক্টে-কেউ বা দুবছরের। শাজাহান, হোটেল ডি ইউরোপ এবং এলেনবির বিলিতি প্রতিনিধিরা লিখে পাঠাতেনÍএকটি সুন্দরী মেয়ে সন্ধান করেছি, প্রয়োজন কিনা জানাও। দ্রুত উত্তর যেতÍ তোমার রুচির উপর আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস আছে। আশা করি তোমাকে বিশ্বাস করে কলকাতার খদ্দেরদের কাছে আমরা ছোট হয়ে যাব না! . ওদিক থেকে উত্তর আসত-শুধু তোমাদের কলকাতা নয়, দুনিয়ার বাঘা বাঘা পোর্টে এতদিন ধরে বারমেড পাঠাচ্ছি, কখনও সমালোচনা শুনিনি। আমার হাতের নির্বাচিত মেয়েরা কত হোটেলের ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছেÍমদের বিক্রি ডবল করে দিয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, আমার একমাত্র দুশ্চিন্তা কলকাতার হোটেলগুলো মেয়েদের রাখতে পারে না। কন্ট্রাক্ট শেষ হতে না হতে চাকরি ছেড়ে অন্য কোথাও জেঁকে বসে। তাতে আমার ক্ষতি হয়। ওদের মাইনের কিছু অংশ আমাকে পাঠাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায়, কিন্তু চাকরি : পাল্টালে সেটা আর পাই না।
আপনি দেখেছেন কোনো বারমেডকে? প্রশ্ন করবার লোভ সংবরণ করতে পারিনি।
হবস হেসে ফেলেছেন। আমি কি আর আজকের লোক? আর এই কলকাতাতে কি আমি আজকে এসেছি? আর কিছুদিন আগে এলে হয়তো দুএকটা ক্রীতদাসও দেখতে পেতাম।
ক্রীতদাস! আমি চমকে উঠেছি।
আজকালকার ছেলেরা তোমরা কোনো খবরই রাখো না। গত শতাব্দীর প্রায় অর্ধেক পর্যন্ত কলকাতার মানুষ কেনা-বেচা হত। মুরগিহাটা থেকে ছেলে-মেয়ে কিনে এনে সায়েব মেম, বাবু বিবিরা বাড়িতে রাখতেন। বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলে কাগজে বিজ্ঞাপন দিতেন; পুরস্কার ঘোষণা করতেন।
সাদারল্যান্ড গম্ভীরভাবে বললেন, আই ওনলি হোপ, হোটেলে যাঁরা মদ, ঢেলে দিতেন তারাও ক্রীতদাসী ছিলেন না।
বৃদ্ধের মুখ এবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, না, আইনের চোখে, তারা ক্রীতদাসী নিশ্চয়ই ছিলেন না; কিন্তু তাদের দুঃখের যে দৃশ্য আমি দেখেছি, যা শুনেছি, তাতে ডিকরিতে একটা নতুন শব্দ তৈরি করে ঢুকিয়ে দিতে পারো।
এই শাজাহান হোটেলেরই একটি পুরনো বিজ্ঞাপন তোমাকে দেখাতে পারি। মিস্টার হবস চেয়ার থেকে উঠে পড়ে আলমারি থেকে একটা খাতা বার করে নিয়ে এলেন। সেই খাতার পাতায় পাতায় পুরনো দিনের ইংরেজি কাগজের কাটিং আঁটা রয়েছে। উল্টোতে উল্টোতে এক জায়গায় থেমে গেলেন। হয়তো তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমার কাছে প্রমাণ রয়েছে।
বিজ্ঞাপন পড়ে দেখলাম। শাজাহান হোটেলের ম্যানেজার সগর্বে ঘোষণা করছেন-আগামী ২২শে সেপ্টেম্বর এস এস হাওয়াই জাহাজ যোগে কুমারী মেরিয়ন বুথ ও কুমারী জেন গ্রে খিদিরপুরে এসে হাজির হচ্ছেন। শাজাহান হোটেলের অতিথিদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তারা কোনোরকম ত্যাগ স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হবেন না! বিজ্ঞাপনের তলায় মোটা মোটা হরফে পাঠকদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে শাজাহানের কষ্টার্জিত সুনাম অক্ষুন্ন রাখবার জন্যই এই সুন্দরী দুটিকেও দিনের বেলায় এবং রাত্রের ডিউটি-শেষে তালাবদ্ধ অবস্থায় রাখা হবে!
মিস্টার হবসের কাজে বাধা সৃষ্টি করছি আমরা। হারিয়ে যাওয়া দিনের গল্প শোনাবার উপযুক্ত সময় নয় এখন। মনে মনে লজ্জাবোধ করছিলাম। কিন্তু সাদারল্যান্ডের সেদিকে খেয়াল নেই। হবসও ও বিষয়ে মোটেই চিন্তা করছেন না। খাতাটা মুড়তে মুড়তে তিনি বললেন, ভাগ্যে এই কাটিংটা রেখেছিলাম। এই সামান্য সূচনা থেকে যে একদিন এমন একটা ব্যাপার হবে তা কল্পনাও করিনি।
(সংকলিত)
——চলবে




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com