ইমরান খানকে যখন ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) তাদের ‘হল অফ ফেমে’ জায়গা দেয় তখন তাদের ওয়েবসাইটে ইমরান খান সম্পর্কে বলা হয়, ‘একজন যোদ্ধা যে শেষ বল পর্যন্ত লড়ে গিয়েছে।’ আর ওই লড়াই এতেটাই দীর্ঘ যে রাজনৈতিক জীবনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগেই তিনি ক্রিকেটে ‘অমরত্ব’ পেয়ে যান। ১৯৯২ সালে পাকিস্তানের বিশ্বকাপ জয় এখনো কারো কারো কাছে রূপকথার মতো। যে রূপকথার পেছনে ছিল একজন নেতা, একজন অদম্য ক্যাপ্টেন, একটা ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্র ইমরান খান।
যিনি বিশ্বকাপের আগে ক্রিকেট ছেড়েই দিয়েছিলেন, সেই তিনিই দেশের প্রেসিডেন্টের ডাকে অবসর ভেঙে আবারো ফিরেন ২২ গজে। এরপর ধীরে ধীরে একটা ভাঙাচোরা দলকে বিশ্বকাপ মে নিয়ে গিয়ে অবিশ্বাস্যভাবে চ্যাম্পিয়ন করেন। পরাজয় দিয়েই বিশ্বকাপ শুরু। প্রথম পাঁচ ম্যাচে মাত্র এক জয়, এক ম্যাচে তো ৭৪ রানে অলআউট। দলে ইনজুরি, অর্ন্তদ্বন্দ্ব- এসব কিছু ছাপিয়েও যে বিশ্বকাপ জেতা যায় সেটা এই ৩০ বছর পর এসেও যেন অনেকের কাছে রূপকথার গল্পই মনে হয়।
ইমরান খানের প্রথম অধ্যায়: ১৯৫২ সালে লাহোরে জন্ম নেয়া ইমরান খানের ১৯৭১ সালে জাতীয় দলে অভিষেক। আর অভিষেকের পর থেকেই পাকিস্তান ক্রিকেট দলের মোটামুটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে পড়েন দীর্ঘদেহী এই অলরাউন্ডার। যদিও শুরুর দিকে ফাস্ট বোলার হিসেবেই খ্যাতি পান। তবে ব্যাটও যে ভালোই চালাতে জানেন সেটা বুঝাতেও সময় লাগেনি। ১৯৭৫ সালে শুরু হয় ক্রিকেট বিশ্বকাপের যাত্রা। ওই বছরই বিশ্বকাপে অভিষেক হয় ইমরান খানের। ১৯৮২ সালে পাকিস্তানের আরেক তারকা ক্রিকেটার জাভেদ মিয়াদাদের কাছ থেকে অধিনায়কের দায়িত্ব বুঝে নেন।
অধিনায়ক হওয়ার আগে দুটি ও অধিনায়ক হওয়ার পর আরো দুবার পাকিস্তানের হয়ে বিশ্বকাপে অংশ নেন ইমরান খান। কিন্তু কোনোবারই সেমিফাইনাল পার হতে পারেননি। এই আফসোস থেকেই ১৯৮৭ বিশ্বকাপের পর ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন তিনি। কিন্তু পরের বছরই ডাক পড়ে তার। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়া উল হকের ডাকে অবসর ভেঙে আবারো দলের অধিনায়কের দায়িত্ব তুলে নেন। শুরু হয় তার ও পাকিস্তান ক্রিকেটের দ্বিতীয় ইনিংস।
ইমরান খানের দ্বিতীয় অধ্যায়: ১৯৯২ ক্রিকেট বিশ্বকাপ বাহারি কারণে ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম স্মরণীয় বিশ্বকাপ। টিভিতে সম্প্রচার, রঙিন পোশাকে খেলা, দিবা-রাত্রির ম্যাচ, সাদা বল ও ক্রিকেটের নানা নতুন আইন-কানুন চালু হয় ওই বিশ্বকাপে। তবে এসব কিছুর বাইরেও অস্ট্রেলিয়ার ওই বিশ্বকাপকে আপনি বলতে পারেন ইমরান খান ও পাকিস্তানের বিশ্বকাপ। ক্রিকেট দল হিসেবে পাকিস্তানের ক্রিকেট বিশ্বে অন্যতম শক্তিশালী দল হয়ে ওঠা কিংবা আনপ্রেডিক্টেবল তকমা গেঁথেছিল ওই বিশ্বকাপে ইমরান খানের হাত ধরেই। ৭০-৮০ দশকে ক্রিকেট দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী চার বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের একজন তিনি। কপিল দেব, ইয়ান বোথাম আর রিচার্ড হ্যাডলির সাথে সমানতালে উচ্চারিত হতো তার নামটাও। ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের ছোট্ট তালিকাতেও তার অবস্থান ওপরের সারিতেই।
তবে অধিনায়ক হিসেবে তিনিই সর্বকালের সেরা কি-না তা নিয়ে বিতর্ক চলমান থাকলেও ১৯৯২ বিশ্বকাপে তার নেতৃত্বগুণ পরবর্তীতে অনেকের কাছেই হয়ে ওঠে অনুকরণীয়। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব আর সহজাত নেতৃত্বগুণ দিয়ে ইমরান খান হয়ে উঠেন মাঠে ও মাঠের বাইরে একজন সত্যিকারের লিডার। নিজের শেষ বিশ্বকাপ স্মরণীয় করে রাখতে তিন সপ্তাহ আগেই অস্ট্রেলিয়া পৌঁছে যায় পাকিস্তান দল।
তার আগে পেছনে রেখে আসেন বিশ্বকাপ দল নিয়ে এক বিতর্ক। পাকিস্তানের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান জাভেদ মিয়াদাদের বিশ্বকাপে স্কোয়াডে জায়গা হয় না। কারণ হিসেবে উঠে আসে ইমরান খান নাকি মিয়াদাদের ব্যাটিং অর্ডার পরিবর্তন করতে চান। অন্যদিকে ইমরান খানের নিজেরও পুরনো কাঁধের ইনজুরি মাথা চাড়া দেয়। ছয় প্রস্তুতি ম্যাচে মাত্র এক জয় ও দলের যাচ্ছেতাই পারফরম্যান্সে ডাক পড়ে ‘বড়ে মিয়া’ খ্যাত জাভেদ মিয়াদাদের।
ইমরান খান ইনজুরিতে, দলের সেরা পেসার তখন ওয়াকার ইউনিসও ফিট নন। মিয়াদাদের অধিনায়কত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ১০ উইকেটে হেরে বিশ্বকাপ শুরু হয় পাকিস্তানের। পরের ম্যাচে অধিনায়ক ইমরান ফেরেন, তবে জিম্বাবুয়ের সাথে সহজ জয়ে ব্যাট-বল কোনোটাই করতে হয় না তার। ম্যাচ শেষে ইমরান মজা করেই বলেন, ‘আমার জন্য একটা যথাযথ ক্রিকেটময় দিন গেল, কোনো বোলিং নয়, ব্যাটিং নয়, ক্যাচও নয়।’
তবে পরের ম্যাচেই ভয়াবহ লজ্জ্বার মুখে পড়ে যায় পাকিস্তান। ইংল্যান্ডের সামনে গুটিয়ে যায় ৭৪ রানে। ওই লজ্জা থেকে তাদের বাঁচায় বৃষ্টি। নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে এক পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছাড়েন তারা। পরের ম্যাচে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের কাছে হারে পয়েন্ট টেবিলের তলানির দিকে চলে যায় পাকিস্তান। এরপর নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে বিশ্বকাপে ফেরত আসা দক্ষিণ আফ্রিকার কাছেও হেরে গেলে, টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় ঘণ্টা বেজে যায় ইমরান খানের দলের।
ওই রকম নাজুক অবস্থায় ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পরের ম্যাচ যেন পাকিস্তানের জন্য হয়ে পড়ে ফিরতি ফ্লাইট ধরার অলিখিত অগ্রিম টিকেট! অধিনায়ক ইমরান খানের ম্যাজিক শুরু ওখান থেকেই।
১৫ মিনিটের মিটিং: অস্ট্রেলিয়ার পার্থ স্টেডিয়ামে, ১১ মার্চ, ১৯৯২। ম্যাচ শুরুর আগে দলের সবাইকে ড্রেসিংরুমে এক হওয়ার নির্দেশ দেন ইমরান খান। এরপর আবির্ভাব ঘটে তার। পরনে সাদা গেঞ্জি, বুকে এক বাঘের ছবি যে থাবা বসাতে প্রস্তুত। ড্রেসিং রুমে ১৫ মিনিটের মতো ক্রিকেটারদের সাথে কথা বলেন ৩৯ বছর বয়সী ইমরান খান। তার সতীর্থদের অনেকেই পরে বলেন যে ওই ১৫ মিনিটেই পুরো দলটা বদলে যায়।
ক্রিকেটবিষয়ক ওয়েবসাইট ক্রিকইনফোকে ইমরান খানের দলের পেসার আকিব জাভেদ বলেন, ‘ওই ১৫ মিনিট… আমাদের জীবন বদলে দেয়।’ ওই দিন প্রত্যেকটা ক্রিকেটারের সাথে আলাদা করে কথা বলেন অধিনায়ক ইমরান। দলের ভেতরে বিশ্বাস ছড়িয়ে দেন যে পাকিস্তান এখান থেকেও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
যদিও শুরুতে অনেক তরুণ ক্রিকেটারের কাছে ইমরান খানের বক্তব্য ঠিক বোধগম্য হয়নি। কিন্তু ইমরান যখন ড্রেসিং রুম থেকে বেরিয়ে যান টসের উদ্দেশে, ততক্ষণে দলের প্রত্যেকটা সদস্য জেনে গেছে আজ তারা জিতবেই।
আকিব জাভেদ বলেন, ‘ওই ১৫ মিনিটের পর, যখন খেলা শুরু হয়, আমি যখন মাঠে প্রবেশ করি, আমার ওই দিনের অনুভূতি ছিল পুরোই আলাদা। আমি অনুভব করতে পারছিলাম যে কেউ আজ আমার সামনে দাঁড়াতে পারবে না। আমি তিনটা স্লিপ সাজিয়ে বল করি, কারণ আমি জানতাম আজ আমার প্রত্যেকটা ডেলিভারি, আমি যা চাই সেটাই করবে।’ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টস এবং প্রি-ম্যাচ প্রেজেন্টেশনে ইমরান খান হাজির হলেন জার্সি ছাড়াই, বাঘের ছবি সম্বলিত টি-শার্ট পড়ে।
কৌতুহলী ধারাভাষ্যকারের জিজ্ঞাসা পূরণ করতে ইমরান বলেন, ‘আমি আজ ছেলেদের কোণঠাসা বাঘের মতো খেলতে বলেছি।’
এরপরেই পাকিস্তান ক্যাপ্টেন ধারাভাষ্যকারকে বললেন, ‘আপনি জানেন যে কোণঠাসা বাঘ বিপজ্জনক।’ সত্যিকার অর্থেই পাকিস্তান ওই দিন ছিল কোণঠাসা বাঘ, যাদের সামনে অসহায় দেখায় বিশ্বকাপ আসরের ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকেও।
অবশেষে শিরোপায় হাত: আক্ষরিক অর্থেই ইমরানের ওই কথাগুলো দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল পাকিস্তান দলকে। শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়াকে ৪৮ রানে হারিয়ে যেই হুঙ্কার শুরু হয়েছিল, সেটা থেমেছিল পর্যায়ক্রমে শ্রীলঙ্কা, নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতে।
তবে নাটকীয়তা ছিল পাকিস্তানের সেমিফাইনালে ওঠা নিয়েও। গ্রুপপর্বের শেষ দিনে পাকিস্তান শুধু নিউজিল্যান্ডকে হারালেই হতো না, অন্য ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজকেও হারতে হতো অস্ট্রেলিয়ার কাছে। ভাগ্য দুটিই মিলিয়ে দেয় পাকিস্তানকে।
জনশ্রুতি আছে, ক্রাইস্টচার্চে ওই দিন নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে পাকিস্তানের সেমিফাইনাল নিশ্চিত হওয়ার পর বাইরে খেতে যায় পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা। ফেরার পথে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে একটা নোট লিখে সাইন করে দেন ওয়াসিম আকরাম। যাতে লেখা ছিল, ‘পাকিস্তান এবার বিশ্বকাপ জিতবে।’ এতটাই প্রখর তখন দলের আত্মবিশ্বাস।
অস্ট্রেলিয়া বিপক্ষে ম্যাচের পর ইমরানের নেতৃত্বে পাকিস্তান কেমন অসাধারণ ক্রিকেট খেলেছে তার চিত্রকল্প বোঝানোর জন্য নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৭ উইকেট ও ৪ উইকেট ব্যবধানের দুটি জয়ই যথেষ্ট।
বিষয়টা আরো শক্তিশালী হবে যখন আপনি জানবেন পুরো আসরে দাপট দেখানো ৯২ বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালিস্ট নিউজিল্যান্ড কেবলমাত্র পাকিস্তানের বিপক্ষেই হেরেছিল। প্রথম ম্যাচ ম্যাচে নিয়ত পরিবর্তনশীল পাকিস্তানের ব্যাটিং অর্ডার শেষ পাঁচ ম্যাচে ছিল প্রায় অপরিবর্তিত।
তরুণ প্রতিভা চেনার বেলায় ইমরান ছিলেন পাকা জহুরী নেটে এক নজর দেখেই তিনি প্রতিভা বুঝতে পারতেন এমন জনশ্রুতিও আছে, ইনজামাম-উল-হক, ওয়াকার ইউনুসের মতো ক্রিকেটারেরা তারই আবিষ্কার।
বিশ্বকাপে বাজে ফর্মে ইনজামাম একপর্যায়ে খেলতে না চাইলেও তাকে ভরসা দেন ক্যাপ্টেন ইমরান। কার্যকরী অলরাউন্ডার ও একমাত্র অধিনায়ক বিশ্বকাপ শিরোপা জেতা ইমরান খানকে মনে করা হয় পাকিস্তানের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার। আর পাকিস্তানে ক্রিকেটের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ও উত্থানের পেছনেও ইমরানের অবদান অনস্বীকার্য।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তী মাইকেল হোল্ডিং মনে করেন, ইমরান খানের বিশ্বকাপ জয় ছিল তার ডেসটিনি, যে তিনি প ম বিশ্বকাপে এসে শিরোপা হাতে তুলবেন।
তবে ট্রফি হাতে প্রেজেন্টশনে এসে ইমরান খান তার অন্য ‘অবসেশনের’ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, এই বিশ্বকাপ জয় ব্যক্তিগতভাবে আমার যে ক্যান্সার হাসপাতাল তৈরির লক্ষ্য সেটাকে এগিয়ে নেবে।’ বিশ্বকাপের পর ইমরান খান পাকাপাকিভাবে ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। নিজের রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন ও পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও হন।
একটি দুর্নীতির মামলায় সম্প্রতি তার সাজা হয়েছে এবং তিনি এখন কারাগারে আছেন। তার সমর্থকরা বলছেন, এই মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কিন্তু ক্রিকেটে ইমরান খানকে নিয়ে এখনো বলা হয়, সব দলেই তো একজন ‘ক্যাপ্টেন’ আছেন, কিন্তু তারা সবাই ‘লিডার’ নন।
অনেক ক্রিকেট বিশ্লেষক মনে করেন, লিডার কেবল একজনই- তিনি হলেন পাকিস্তানের ইমরান খান। সূত্র : বিবিসি