আল-আকসা, বায়তুল মোকাদ্দাস, আল-কুদস, মসজিদুল হারাম যে নামেই বলি না কেন, তা নিছক কোনো স্থাপনা নয়। বরকতময় একাধিক স্থাপনার মিলন মোহনা। অসংখ্য নবী-রাসূল ও মনীষীর পবিত্র ইবাদতের স্থান। প্রিয় জায়গাটি মুসলমানদের হৃদয়ের খুব গভীরে জায়গা করে নিয়েছে। উপচেপড়া ভালোবাসা এর প্রতি অহর্নিশ। উন্মুখ সারা বিশ্ব মুসলিম বায়তুল মোকাদ্দাস ও ফিলিস্তিনের বিজয় সংবাদ শোনার জন্য। নিরাপদ ভূমিতে দুই রাকাত নামাজ আদায়ের জন্য। আল-আকসার রয়েছে অগণিত ফজিলত। অসংখ্য গুণ-বৈশিষ্ট্য। তন্মধ্যে অনন্য ১০টি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করছি।
১. আকসা প্রথম কিবলা : সব নবী ও রাসূল বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে ফিরেই সালাত আদায় করেছেন। নবীজী সা:ও মক্কা থাকাবস্থায় বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেছেন। মদিনায় হিজরতের পরও ১৬ মাস নামাজ পড়েছেন। দ্বিতীয় হিজরির শাবান মাসের মাঝামাঝি সময়ে নবীজী সাহাবিদের নিয়ে বনু সালামা গোত্রের মসজিদে জোহর মতান্তরে আসরের নামাজের দ্বিতীয় বা তৃতীয় রাকাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে আদেশ হলে নবীজী সাহাবিদের নিয়ে নামাজেই ঘুরে যান কাবা শরিফের দিকে। যার জন্য আগে থেকেই তিনি আকাক্সক্ষী ও উদগ্রিব ছিলেন। যার আলোচনা সূরা বাকারায় এসেছে। সেই মসজিদকে বলা হয় মসজিদে কিবলাতাইন বা দুই কিবলার মসজিদ। সারা বিশ্বের মানুষ একমুখী হয়ে এক আল্লাহর ইবাদতের জন্য কাবা শরিফ হলো কেন্দ্রবিন্দু। প্রথম কিবলা। (সিরাতে খাতামুল আম্বিয়া-৬৯, সিরাতে মোস্তফা)
২. আকসা পৃথিবীর দ্বিতীয় মসজিদ : কাবা হলো পৃথিবীর প্রথম ঘর, প্রথম মসজিদ। এর ৪০ বছর পর নির্মিত হয় বায়তুল মোকাদ্দাস। যা পৃথিবীর দ্বিতীয় মসজিদ। হজরত আবুজর গিফারি রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি রাসূল সা:-কে জিজ্ঞেস করলাম, বিশ্বের সর্বপ্রথম মসজিদ কোনটি? তিনি বলেন, ‘মসজিদে হারাম’। অতঃপর আমি আরজ করলাম, এরপর কোনটি? তিনি বলেন, ‘মসজিদে আকসা’। আমি জিজ্ঞেস করলাম, উভয়ের নির্মাণের মধ্যে কত দিনের ব্যবধান রয়েছে? তিনি বলেন, ‘৪০ বছরের’। তিনি আরো বলেন, ‘এ তো হলো মসজিদদ্বয়ের নির্মাণক্রম। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা পুরো ভূপৃষ্ঠকেই আমাদের জন্য মসজিদ বানিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং যেখানেই নামাজের সময় হয় নামাজ পড়ে নাও।’ (মুসলিম, তাফসিরে মারেফুল কুরআন-৭৬৫)
৩. আকসায় দাজ্জাল প্রবেশ করতে পারবে না : কিয়ামতের আগে দাজ্জাল দাপিয়ে বেড়াবে পুরো পৃথিবী। ফেতনা ছড়িয়ে ভূপৃষ্ঠে বিচরণ করবে। কিন্তু চারটি মসজিদ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে না- ১. মদিনার মসজিদ; ২. মক্কার মসজিদ; ৩. মসজিদে আকসা ও ৪. মসজিদে তুর। (তাফসিরে মারেফুল কুরআন-৭৬৬)
৪. আকসা বরকতময় ও মনোনীত ভূমি : আল্লাহ তায়ালা বায়তুল মোকাদ্দাস ও তার আশপাশের এলাকায় অসংখ্য বরকত রেখেছেন। সূরা বনি ইসরাইলের ১ নম্বর আয়াতের খ-াংশে বিবৃত হয়েছে- ‘বারাকনা হাওলাহু’। আমি তার আশপাশ বরকতময় করেছি। এখানে হাওল দ্বারা পুরো সিরিয়া উদ্দেশ্য। বরকত দুই ধরনের- ১. ইহলৌকিক ও ২. পারলৌকিক। ইহলৌকক বরকত হলো জমি উর্বর, ফল-ফসলের সারি সারি উদ্যান, দিগন্তজুড়ে সবুজ বিস্তীর্ণ মাঠ, ঝরনা প্রভৃতি।
পারলৌকিক হলো- সব নবী-রাসূলের কিবলা হওয়া, আগমন ঘটা, পদভারে ধন্য হওয়া, বাসস্থান হওয়া, কবরস্থান হওয়া, পবিত্র প্রাঙ্গণে ইবাদত করে প্রভূত কল্যাণ অর্জন করা ইত্যাদি।
হাদিসে কুদসিতে এসেছে- আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে শাম ভূমি! জনবসতিগুলোর মধ্যে তুমি আমার মনোনীত ভূভাগ। আমি তোমার কাছেই স্বীয় মনোনীত বান্দাদেরকে পৌঁছে দেবো।’ (তাফসিরে মাআরেফুল কুরআন, পৃষ্ঠা-৭৬৬)
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা সেই পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করো, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছেন এবং নিজেদের পেছনের দিকে ফিরে যেয়ো না, তা হলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।’ (সূরা মায়িদা-২১)
অন্য জায়গায় ইরশাদ করেন- ‘আর তাঁকে ও লুতকে উদ্ধার করে সেই ভূখ-ের দিকে নিয়ে গেলাম, যেখানে বিশ্ববাসীদের জন্য বরকত রেখেছি।’ (সূরা আম্বিয়া-৭১)
৫. সওয়াবের উদ্দেশে আকসা ভ্রমণ জায়েজ : পৃথিবীর কোনো মসজিদে শুধু সওয়াবের উদ্দেশে ভ্রমণ করা জায়েজ নেই। শুধু তিনটি মসজিদ ব্যতীত। তার অন্যতম বায়তুল মোকাদ্দাস। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেন, ‘শুধু তিনটি মসজিদ অভিমুখে ইবাদতের নিয়তে সফর করা যাবে। আল-মাসজিদুল হারাম, মাসজিদুন নববী ও মাসজিদুল আকসা।’ (বুখারি শরিফ-১৮৬৪)
৬. আকসার মুসল্লিদের পাপমুক্তির আশ্বাস : বায়তুল মোকাদ্দাসে যারা নামাজ পড়বে বের হওয়ার সাথে সাথে নিষ্পাপ শিশুর মতো গোনাহমুক্ত হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ। নি¤েœাক্ত হাদিস দ্বারা এমন মুগ্ধকর লোভাতুর আশ্বাসের কথাই বিবৃত হয়েছে।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেন, ‘সুলাইমান ইবনে দাউদ আ: বায়তুল মাকদিসের নির্মাণকাজ শেষ করে আল্লাহ তায়ালার কাছে তিনটি বিষয় প্রার্থনা করেন- আল্লাহর হুকুমমতো সুবিচার, এমন রাজত্ব যা তার পরে আর কাউকে দেয়া হবে না এবং যে ব্যক্তি বায়তুল মাকদিসে কেবল নামাজ পড়ার জন্য আসবে, তার গোনাহ যেন তার থেকে বের হয়ে যায় তার মা তাকে প্রসব করার দিনের মতো। এরপর নবী সা: বলেন, প্রথম দুটো তাঁকে দান করা হয়েছে এবং আমি আশা করি তৃতীয়টিও তাঁকে দান করা হবে।’ (ইবনে মাজাহ-১৪০৮)
৭. কিয়ামতের আগে আকসা বিজয় : প্রিয়নবী সা: ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন, কিয়ামতের আগে আল-আকসা (ফিলিস্তিন) বিজয়ের। হজরত উমর রা: জেরুসালেমসহ বায়তুল মোকাদ্দাস জয় করেছিলেন। পরে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি রহ: ১১৮৭ সালে আবার জয় করেছিলেন। পরে মুসলমানদের উদাসীনতায় আবার তা হাতছাড়া হয়ে যায়; যা অদ্যাবধি রয়েছে। তবে মুসলিম উম্মাহ আবারো তা জয়ের দ্বারপ্রান্তে ইনশা আল্লাহ। এত শহিদান ও নিষ্পাপ রক্ত তারই ইঙ্গিত বহন করছে।
নবী সা: বলেন, ‘কিয়ামতের আগে ছয়টি বস্তু গণনা করো। তার মধ্যে বায়তুল মাকদিস বিজয় অন্যতম।’ (বুখারি, অধ্যায় : কিতাবুল জিযইয়াহ)
উমর ইবনুল খাত্তাব রা:-এর শাসনামলে হিজরি ১৬ সালে বায়তুল মাকদিস বিজয়ের মাধ্যমে নবী সা:-এর ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হয়েছে।
৮. আল-আকসা ইসরা ও মিরাজের জ্বলন্ত সাক্ষী : বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর শ্রেষ্ঠ মুজেজা ইসরা ও মিরাজ শরিফ। তিনি রাতের সামান্য অংশে মসজিদে হারাম (কাবা প্রান্তর) থেকে মসজিদে আকসায় ভ্রমণ করেছেন অতঃপর সেখান থেকে ঊর্ধ্বগগনে ভ্রমণ করেছেন। বায়তুল মোকাদ্দাস সেই ইসরা ও মিরাজেরই স্মৃতি ধারণকারী সাক্ষ্য বহনকারী।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘পবিত্র মহান সে সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে নিয়ে গেছেন আল-মাসজিদুল হারাম থেকে আল-মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার আশপাশে আমি বরকত দিয়েছি, যেন আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সূরা বনি ইসরাইল-১)
৯. আকসা হাশরের ময়দান হবে : আল-আকসা ফিলিস্তিন এই দেশ ও আশপাশের শহর হবে হাশরের ময়দানের সূচনা। হজরত মাইমুনা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! বায়তুল মোকাদ্দাস সম্পর্কে কিছু বলুন, তিনি বলেন, ‘বায়তুল মোকাদ্দাস হলো হাশরের ময়দান, পুনরুত্থানের জায়গা। তোমরা সেখানে নামাজ আদায় করো। কারণ বায়তুল মাকদিসের এক রাকাতে অন্য মসজিদের তুলনায় এক হাজার রাকাতের সওয়াব।’ (মুসনাদে আহমাদ)
১০. আকসা দখল ও অধিকার গ্রহণ : তিন ধর্মের তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত পবিত্র আল-আকসা নগরীর নির্লজ্জ দখলবাজি যুগ যুগ ধরে চলছে। মুসলমানরা শক্তিসামর্থ্যরে গুণ-বৈশিষ্ট্য অর্জন করে আল্লাহর তাওফিকে দেরিতে হলেও তা মুক্ত করছে। এ নগরীর মতো রক্তস্নাত, হৃদয়বিদারক, ত্যাগের ইতিহাস আর কোনো ভূখ-ে নিয়ে নেই। পবিত্র এই নগরীর স্থাপনাগুলো দু’বার পরিপূর্ণ ধ্বংস করা হয়। ৫২ বার আক্রমণ করা হয়, ৪৪ বার উদ্ধার করা হয় এবং ২৩ বার অধিকৃত হয়। সবচেয়ে দুঃখের ও হৃদয়ছেঁড়া ইতিহাসের নির্মম দিন হলো ৯ জুলাই ১০৯৯ সাল। পোপ আরবান দ্বিতীয় ১০৯৫ সালে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে ইউরোপজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে। আওয়াজ ওঠায় ঈসা মসিহের কথিত কবর ও আল-আকসা মুসলমানদের কবল থেকে রক্ষা করতে হবে। কিছু মুসলিমের মোনাফিকি ও উদাসীনতায় ১০৯৯ সালে ক্রুসেডারদের দখলে চলে যায় প্রিয় আল-আকসা। চালায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। হাঁটু সমান রক্তের বন্যায় ভেসে যায় মুসলিমের কর্তিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে। অতপর সালাহউদ্দিন আইয়ুবি রহ:-এর পুনরুদ্ধারের পর আবার দখলে নেয় অভিশপ্ত জায়নবাদী ইসরাইলি ইহুদি। অদ্যাবধি তাদের দখলেই। মুসলমানরা রক্তের নাজরানা এখনো দিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধাদের ঐতিহাসিক ‘তুফান’ অপারেশনের পর থেকে ফিলিস্তিনি ভূখ- গাজায় নেমে এসেছে ইতিহাসের বর্বরোচিত ভয়াবহ হামলা। মুহুর্মুহু বোমা ও গোলাবর্ষণ। অনবরত বিমান হামলায় গাজা এখন মৃত্যুপুরী। পুড়ছে গাজা জ্বলছে ফিলিস্তিন। ইহুদিদের হামলা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, মসজিদ, বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি হাসপাতাল পর্যন্তও। দেশে দেশে চলছে বিক্ষোভ দোয়া-কুনুতে নাজেলার আমল। আল্লাহ তায়ালা তাদের সহায় হোন এবং পৃথিবীকে নিরাপদ করে দিন। লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইবনে আব্বাস রা:, সামান্তপুর, জয়দেবপুর, গাজীপুর সিটি