শুক্রবার বেলা ১২ টা বাজে বারবাজারের ঐতিহ্যবাহী গোড়া মসজিদের সামনে কালো রঙের একটি ছাগলের দড়ি হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন আব্দুল গফুর বিশ্বাস। তিনি এসেছেন যশোরের নাভারণ উপজেলা থেকে। ছাগলটি তিনি মসজিদে ‘মানত’ হিসেবে দেবেন বলে এনেছেন। তার সাথে কথা হলে তিনি জানান, আমার মনের একটি আকাঙ্ক্ষা ছিল। সেটি পুরণ হওয়ায় আল্লাহর ওয়াস্তে ঐতিহ্যবাহী এই গোড়ার মসজিদে ছাগলটি দেবো নিয়ত করেছিলাম। তাই ছাগলটি নিয়ে আজ এসেছি। একটু দূরে প্রাচীর ঘেষা দানবাক্সের সামনে লাজুকমুখে মুরগি হাতে দাঁড়িয়েছিলেন রহিমা বেগম(৩০)। তিনি এসেছেন ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলা থেকে। বিয়ের দীর্ঘ ৯ বছর পর তিনি মা হয়েছেন। কোলে ছোট্ট সেই বাচ্চাটিও রয়েছে। এই মসজিদে তিনি মানত করেছিলেন, সন্তানের মুখ দেখতে পেলে মসজিদটিতে এসে একটি মুরগি দেবেন। সেই ওয়াদা পূরণে আজ এসেছেন তিনি। বড় বড় হাড়িতে রান্না করা খাবার নিয়ে পুরো পরিবারের লোকজন সাথে নিয়ে গোড়ার মসজিদে এসেছেন তিন সন্তানের জননী নুসরাত জাহান।কোলে তার একমাত্র কন্যা সন্তান। দুই ছেলের পরে মেয়ে হলে তিনি মানত করেছিলেন গোড়ার মসজিদের ইমামকে দিয়ে মুখে ভাত দেবেন এবং মুসল্লিদের খাওয়াবেন। একারনেই তিনি আজ গোড়ার মসজিদে এসেছেন। শুধু রহিমা বেগম, আব্দুল গফুর বিশ্বাস কিংবা নুসরাত জাহান নয়; এমন অনেক মানুষ বারবাজারের ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদে তাদের মানত হিসেবে অনেককিছু দান করেন প্রতিদিন। দূর-দূরান্ত থেকে এই মসজিদে আসা বেশিরভাগ মানুষই জানিয়েছেন, আল্লাহ তাদের মনোবাসনা পূরণ করেছেন এই মসজিদের মাধ্যমে। সেকারণে মানতের দ্রব্য বা টাকা মসজিদটিতে দিয়ে যান তারা।তবে, মানতের ছাগল, মুরগি, গরু কোথায় যায়-তা তার বলতে পারেন না কেউই। বারোবাজার এলাকায় সুলতানি আমলের ৮ শত হিজরির ৬ শত বছরের পুরানো আমলের ১৯টি মসজিদ রয়েছে। এসব মসজিদের মধ্যে গোড়ার মসজিদটি অন্যতম একটি মসজিদ হিসেবে মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছে। যে কারণে এই মসজিদটিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নানা শ্রেণী পেশার মানুষের সমাগম ঘটে। মসজিদটিতে আসা মানুষের বিশ্বাস এখানে মানত করলে মনের আশা পূর্ণ হবে। আর মানুষের এই মনের বিশ্বাসের সূত্রপাত ঘটে বহুবছর আগে। যখন মাটির নিচে ছিলো গোড়ার মসজিদের ধ্বংসাবশেষের অবশিষ্ট কিছু অংশ; ঠিক সেই সময় থেকেই। ওই সময় এ মসজিদটিতে নামাজ পড়ার উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় নামাজ পড়া বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন। এমতাবস্থায় বারোবাজারের এই মসজিদটিতে একদিন ফুরফুরা শরীফের বড় হুজুরের আগমন ঘটে। তখন তিনি মসজিদটিতে পুনরায় নামাজ চালু করার জন্য ওসিহত করে যান। এরপর চার গম্বুজ সম্বলিত এই মসজিদটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে স্থানীয়রা নামাজ আদায় শুরু করেন। তারপর থেকেই ধীরে ধীরে এই মসজিদটির ব্যাপারে মানুষের মনে একপ্রকার বিশ্বাস বেড়ে যায়। মানুষ তার জীবনের নানা সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট খাস মনে এই মসজিদের নামে মানত করতে শুরু করেন। জনশ্রুতি আছে আল্লাহর ইচ্ছায় অনেকের মনের নেক আশা পূর্ণও হয়। তখন তারা মসজিদে এসে নিয়ত করা মানত, সদকা ও দান করে থাকেন। বিশেষ করে জুম্মার দিন এই মসজিদে প্রচুর লোক সমাগম ঘটে। ছোট এই মসজিদটিতে পবিত্র জুম্মা সালাত প্রায় ১ হাজার থেকে ১৫ শত লোক একসাথে আদায় করেন। মসজিদটি ছোট হওয়ায় এর আশপাশ এলাকাতে পাটি বিছিয়ে জুম্মার সালাত আদায় করতে দেখা যায় আগত মুসল্লিদের। জুম্মার দিনে মানুষ পানির বোতল, তেলের বোতল, জীবন্ত মুরগী, ছাগল এবং রান্না করা খাবার নিয়ে হাজির হন এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদ প্রাঙ্গনে। অনেকে তার সন্তানের মুখে ভাত দেন এই মসজিদের ইমাম সাহেবকে দিয়ে। মসজিদে আগত সকলেই মুক্ত হস্তে দান করেন। বেশ কয়েকটি কাঠের তৈরি ছোট দান বাক্স নামাজ শেষে কাতারে কাতারে পাঠানো হয়। মুসল্লিরা ওই বাক্সে নগদ অর্থ দান করেন।মসজিদের পূর্ব প্রান্তে প্রাচীর ঘেষা দুইটি বড় মুরগির খাঁচা তৈরি করা রয়েছে। মানুষ তাদের মানতের মুরগি ওই খাঁচাতে রাখেন। আর এই খাঁচার সামনে মসজিদ পরিচালনা কমিটির দুই একজন সদস্য সব সময় অবস্থান করে এসব দেখভালের জন্য। প্রতি জুম্মার দিন মানতের মুরগি ছাগল ও নগদ অর্থ সব মিলিয়ে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা আদায় হয়। বারোবাজারের গোড়ার মসজিদটি তিন বছর মেয়াদী ১১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এই মসজিদে মানুষের দান, সদকা ও মানতের টাকা যৌথ নামে দুইটি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয় বলে জানা যায়। মসজিদটিতে বেতনভুক্ত একজন খতিব, ইমাম ও মুয়াজ্জিন রয়েছেন। দীর্ঘদিন গোড়ার মসজিদে নামাজ আদায় করা স্থানীয় বাসিন্দা আলী আকবর জানান, ঐতিহাসিক এই মসজিদটি আল্লাহর অলি আওলাদের হাতে নির্মিত। তাই মানুষ মনে করে অন্যান্য মসজিদের থেকেও এই মসজিদটির আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে। মানুষের মনের এই বিশ্বাস থেকেই মানুষ দলে দলে এই মসজিদে আসছেন। বারবাজার প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ দেখভাল করার জন্য প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনা অফিস কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত সাইট পরিচালক পদে থাকা গোলাম মোস্তফার সাথে কথা হলে তিনি জানান, আমি দীর্ঘদিন ধরে বারোবাজারের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহ দেখাশোনা করছি। এই এলাকার অন্যান্য প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহের মধ্যে গোড়ার মসজিদ সম্পর্কে মানুষের মনে অন্যরকম একটি বিশ্বাসের জায়গা তৈরি হয়েছে। যে কারণে মানুষ এখানে আসছে, নামাজ আদায় করছে এবং মনোবাসনা পূর্ণ হওয়ার জন্য যে মানত করেছিল তাও দিয়ে যাচ্ছে। জানা মতে, মসজিদ কমিটির মাধ্যমে সবকিছুই সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী বারোবাজার গোড়ার মসজিদ কমিটির সভাপতি শেখ হাবিবুর রহমান বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে এই মসজিদ কমিটির পরিচালনা পরিষদে রয়েছি। মাত্র ৩ শতক জমির উপরে সুলতানি আমলের এই গোড়ার মসজিদে বর্তমানে মানুষের ব্যাপক সমাগম ঘটছে। তারা এখানে মুক্ত হস্তে দান, সদকা ও মানত দিচ্ছেন। এসব টাকা মসজিদের উন্নয়নের পাশাপাশি এই মসজিদের নামে গড়ে তোলা একটি মাদ্রাসার সার্বিক উন্নয়নে ব্যয় হচ্ছে। বর্তমানে গোড়ার মসজিদ কমিটির ফান্ডে প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা জমা রয়েছে বলেও তিনি জানান। কালীগঞ্জ সরকারি মাহাতাব উদ্দিন কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপক এনামুল হক জানান, মসজিদে মানত কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা এক ধরনের ব্যাবসা। মানত সম্পূর্ণ মানুষের মনগড়া। “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর”- এই তত্ত্বের উপর মানুষ মানত চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ইসলামী শরিয়া মোতাবেক দান সাদকা করার নির্দেশনা রয়েছে। কালীগঞ্জ ইমাম পরিষদের সভাপতি মুফতি মাহমুদুল হাসান বলেন, মসজিদ কেন্দ্রিক মানত করা জায়েজ নয়। ইসলামী শরিয়া মোতাবেক বৈধ ও হালাল যে কোন কিছুই আল্লাহর জন্য হবে। মসজিদ, দরগা, খানকায় মানতের বিধান ইসলামি শরীয়ায় নেয়। তবে মসজিদের উন্নয়নের জন্য দান-সাদকা জায়েজ রয়েছে।