শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ০৮:১৬ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
চিতলমারীতে জমি সংক্রান্ত বিরোধে প্রাণ নাশের হুমকি : থানায় জিডি গজারিয়ায় মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে চমক দেখালেন মীনা খাগড়াছড়িতে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান আজিজ উদ্দিন বগুড়া ও জয়পুরহাটে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে যারা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন জামালপুর সদর উপজেলা পরিষদে বিজন কুমার চন্দরকে বিজয়ী ঘোষণা ডিমলায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন মেলান্দহে দুগ্ধ সমবায় প্রকল্পের সদস্যদের মাঝে ঋণের চেক বিতরণ গলাচিপায় জেলেদের মাঝে বকনা বাছুর বিতরণ তারাকান্দায় অগ্নিকা-ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে বিএনপির ত্রাণ নুরে আলম সিদ্দিকী শাহীন নাজিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত

টাঙ্গাইল মধুপুরে নৃ-গোষ্ঠির ঐতিহ্যবাহী বন আলু সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণে ভরপুর

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় সোমবার, ১ জানুয়ারী, ২০২৪

বন আলু সংগ্রহ যেন নৃ-গোষ্ঠির সংসারের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। মনের আনন্দে বা স্বাচ্ছন্দ্যে তারা তাদের দ্বিতীয় প্রধান বুনোখাদ্য আলু সংগ্রহ করতো। এসব আলু সিদ্ধ করে খেতো। সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণে ছিল ভরপুর। তাদের অন্যতম উৎসব ওয়ানগালায় সালজং দেবতা বা শস্য দেবতাকে উৎসর্গ করে বনআলু। কৃষ্টি-কালচার ও ঐতিহ্যের বন আলুর জুড়ি নেই। অতিথি কিংবা আত্মীয়-স্বজন এলে আপ্যায়নের জন্য সামনে দেয়া হতো বন আলু। এখনও বনে বিভিন্ন জাতের যত সামান্য পাওয়া যায়।
টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ের শালবনের লাল মাটিতে ছিল হরেক প্রজাতির বুনো খাদ্য বন আলু। ছিল বুনোখাদ্যের সুবিশাল ভান্ডার। এই খাদ্যই ছিল গোটা জনপদের অভাবের সময়কার জীবন জীবিকার একটা উপাদান। এখন আর সেদিন নেই। নানাভাবে নানা কারণে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হওয়ায় বিলীন হচ্ছে অফুরন্ত বুনো খাদ্যের ভান্ডার। অবশিষ্ট যে বন টিকে আছে, তাতে আগের মতো নেই বন আলু।
ইতিহাস ঐতিহ্যখ্যাত টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবন ছিল গভীর অরণ্যে ঘেরা। বনের চারপাশে ছিল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি গারো, মান্দিসহ অন্যান্যদের বসবাস। গারো সম্প্রদায়ের খামালরা (কবিরাজ) বনের নানা গাছগাছরা দিয়ে চিকিৎসা করতো। স্থানীয় বসতিরাও ভেষজ চিকিৎসা নিতো। অরণ্যচারী গারো সম্প্রদায়ের লোকেরা ভক্ষণ করতো বুনো বাহারি খাবার। বনের বিশাল খাদ্যভান্ডারে হতো তাদের অনেকেরই অন্নের জোগান। খারি গপ্পার নানা উপকরণ আহরণ হতো বন থেকেই। পুষ্টিগুণে ভরা বন আলু ছিল তাদের অভাবের সময়কার খাদ্যের মধ্যে অন্যতম নিয়ামক। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির গারোরা তাদের ভাষায় বন আলুকে থা’মান্দি বা থা’জং বলে থাকে। থা’মান্দি আচিক শব্দ। এর অর্থ বন আলু।
মধুপুর উপজেলার গায়ড়া, পীরগাছা, ধরাটি, মমিনপুর, জলছত্র, গাছাবাড়ি, ভুটিয়া ও চুনিয়াসহ বিভিন্ন গারো পল্লীতে গিয়ে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আবিমা অ লের গারোরা বন আলুকে তাদের গারো বা আচিক ভাষায় থা’মান্দি বা থা’জং বলে থাকে।
তাদের মতে, নৃ-গোষ্ঠির গারো সম্প্রদায়ের লোকেরাই মধুপুর শালবনে সর্ব প্রথম এসব বাহারি নানা জাতের আলুর সন্ধান পেয়েছিলেন। প্রাকৃতিক শালবনের মধুপুর, ঘাটাইল, শেরপুর, নেত্রকোনা, হালুয়াঘাটে এ আলু পাওয়া যেত। লালমাটির শালবনে প্রাকৃতিকভাবে এসব আলু জন্মায়। এ আলু ছাড়াও বনের অভ্যন্তরে পাওয়া যেত বাহারি রকমের জানা ও নাম না জানা অনেক ধরনের আলু। অরণ্যচারী গারোরা বনের চারপাশে বাস করার কারণে তারা এর প্রথম সন্ধান পান। এক সময় জুম চাষের কারণে এসব আলুর সন্ধান পেতে সহজ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ওই সময় ছনের ছোট ঘর বা মাচাং তুলে তারা থাকার জায়গা করতেন। ছাউনিতে বনের ছন আর বনের তারাই বাঁশ কিংবা ছোট-ছোট সরু আকারের ছোট গাছ দিয়ে সুন্দরভাবে বানাতেন ঘর। আগের দিনে খাবার সংকট হলেই যেতেন বনে। আধাবেলা আলু সংগ্রহ করলেই পরিবারের অন্নের যোগান হতো কয়েক দিনের।
তারা জানান, কার্তিক থেকে চৈত্র্য মাসে খাদ্যের জন্য তাদের অনেকেরই সংসারে অভাব থাকতো। এ সময়ে বনবাসীরা আলু তুলে খেতেন, ছুটতেন বনে। এভাবে চলতো তাদের খাবার যোগান। বনের নিচু জায়গাকে স্থানীয়ভাবে বাইদ বলে অভিহিত করে থাকেন গারোরা। এসব বাইদে ছিল প্রচুর ঝরণাধারা। ধান আবাদ ও খাবার পানি সংগ্রহ করতেন। হতো না তাদের পানিও জলের সংকট। তাদের উৎপাদিত ধানে চলত সংসার। বনের সবজি ও লতাপাতায় হতো সবজি তরকারি। ছিল না বিষ কিংবা হরমোনের বালাই। বন এলাকার গারোদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, এক সময় মধুপুরের এই বনে গাতি আলু, গারো আলু, পান আলু, গইজা আলু, দুধ আলু, শিমুল আলু, কাসাবা, ধারমচ আলুসহ বিভিন্ন ধরনের বন আলু পাওয়া যেত। এসব আলু তাদের প্রিয় খাবারের তালিকায় অন্যতম। এসব তথ্য বন এলাকা ঘুরে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে।
অর্চনা নকরেক (৫০) বলেন, অনেকেই আবার স্থানীয়ভাবে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করতো। এই আলু দূরের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতেও পাঠানো হতো। বন আলুর বংশবিস্তারের জন্য আলু সংগ্রহের পর গাছগুলো আবার মাটিতে পুঁতে দিতেন গারোরা। আবার গাছ বেড়ে উঠতো। শাল-গজারিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সঙ্গে লতার মতো জড়িয়ে থাকত। এ আলু কার্তিক-চৈত্রমাসে সবচেয়ে বেশি সংগ্রহ তোলা হতো। রোদে শুকিয়ে ঘরে তুলে রাখা হতো। প্রাকৃতিক বন কমে যাওয়ায় এখন আর আগের মতো আলু পাওয়া যায় না।
আচিক মিচিক সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সুলেখা ম্রং বলেন, বছরের পর বছর সামাজিক বনায়নে আদা-কচুর মতো কৃষি ফসল করতে গিয়ে বন হারাচ্ছে তার ঐতিহ্য। বিদেশি প্রজাতির গাছ ভাবিয়ে তুলেছে প্রকৃতি ও পরিবেশকে। বিশাল অংশ থেকে বিদায় নিচ্ছে বহু প্রজাতির আলু, সবজি, ফল-ফসল, গুল্মলতা-পাতা। এজন্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির গারো সম্প্রদায় ও গড় এলাকার মানুষেরা পাচ্ছে না প্রাকৃতিক বুনো খাবার।
অঞ্জনা নকরেক (৪৮) বলেন, বউ হিসেবে তিনি লালমাটির এ বন এলাকায় এসেছেন প্রায় ৩০ বছর। এসেও দেখেছেন এ বনে নানা ধরনের আলু পাওয়া যেতো। নানা ধরনের শাক-সবজি পাওয়া যেতো। প্রাকৃতিক বন সংকুচিত হওয়ায় বুনো খাদ্য হারিয়ে যাচ্ছে।
আকবর হোসেন (৫০) বলেন, তাদের বাড়ির চারপাশে আগে প্রচুর আলু পাওয়া যেতো। বন থেকে আলু তুলে খেতো। আলুগুলো খেতেও স্বাদ। এখন বনে নেই আগের মতো আলু। প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর শাক ও সবজি পাওয়া যেতো। বন কমে যাওয়ায় বনের ভেষজ, শাকসবজি, আলু বিভিন্ন বুনো খাদ্য হারিয়ে যাচ্ছে।
বৃহত্তর ময়মনসিহ ডেভেলাভমেন্ট কালচারাল ফোরামের সভাপতি অজয় এ মৃ জানায়, অভাবের সময় কার্তিক থেকে চৈত্র্য মাসে বনের আলু তোলে খেতেন। বর্তমানে প্রাকৃতিক বনে কমে সামাজিক বনায়ন বাড়ায় কমছে বন আলু। নৃ-গোষ্ঠি ছাড়া অন্য যারা আলু সংগ্রহ করেন তারা আলু তোলে আর গাছ লাগিয়ে দেয় না। ফলে কমছে বন আলু। খাদ্য হিসেবে বন আলু পুষ্টিগুণে ভরা। প্রাকৃতিক বন কমে যাওয়া, আলু উঠানোর পর গাছ পুনরায় না লাগানোর ফলে কমে যাচ্ছে বাহারি রকমের বন আলু।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com