শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৫:২৯ পূর্বাহ্ন

ভরা মৌসুমে পেঁয়াজ আমদানি, চাষিদের লোকসানের আশংকা

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শনিবার, ৯ মার্চ, ২০২৪

ভরা মৌসুমে পেঁয়াজ আমদানির খবরে চাষিরা হতাশা হয়ে পড়েছেন। দাম পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় অনেক চাষি অপরিপক্ব পেঁয়াজ তুলতে শুরু করেছেন। এতে ফলন কম হওয়ায় সারা বছরের চাহিদার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চাষি সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন, বছর শেষে পেঁয়াজের দাম বাড়লেও সে লাভ মজুতদার-মহাজনদের পকেটে ওঠে। মৌসুমের শুরু ভালো দাম হলে চাষিরা লাভবান হন। কিন্তু এই ভরা মৌসুমে আমদানি করে দাম কমিয়ে দেওয়া কৃষকের লাভ কেড়ে নেওয়ার মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, জেলার সুজানগর, সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলার মাঠজুড়ে এখন আধা পাকা পেঁয়াজের ক্ষেত। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে পুরোদমে পেঁয়াজ তোলা শুরু হবে। তবে ভালো বাজার ধরতে কিছু চাষিকে অপরিপক্ব পেঁয়াজ তুলে ফেলতে দেখা গেছে। চাষিরা বলছেন, তাদের আশঙ্কা পেঁয়াজের দাম কমে যেতে পারে। অনেক চাষি আবার সংসারের খরচ মেটাতে আগাম পেঁয়াজ তুলতে মহাব্যস্ত। সম্প্রতি সাঁথিয়া উপজেলার বিল গ্যারকা ও গাজনা পাড়ের কয়েকজন চাষির সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, এখন পর্যন্ত ভালো লাভবান হচ্ছেন। তবে গত কয়েক বছর তারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এবার মুড়িকাটা পেঁয়াজ থেকে লাভ পাওয়া শুরু করেছেন। টিকে থাকার জন্য মুনাফার দরকার আছে বলে জানান চাষিরা।
তবে ভরা মৌসুমে আমদানির সিদ্ধান্তে চাষিরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। চাষিরা জানান, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পেঁয়াজ আবাদেও লেগেছে। গত পাঁচ বছরের তুলনায় উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হয়েছে। সেক্ষেত্রে পেঁয়াজের দাম বাড়লেই কেবল চাষিরা টিকে থাকতে পারবেন। চাষিদের দাবি, তাদের কথা না ভেবে ভরা মৌসুমে পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে। এতে চাষিদের পথে বসা ছাড়া উপায় থাকবে না। বেশকিছু চাষি জানান, খুচরা বাজারে যে দরে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে সে দর তো তারা পাচ্ছেন না। তারা এর চেয়ে কম দর পান। উৎপাদন খরচ বাদ দিলে কিছু লাভ থাকছে। এবার পেঁয়াজের দরপতন হলে আবাদ ছেড়ে দেওয়ার কথা জানান অনেক চাষি।
এদিকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে পেঁয়াজ আবাদ করেছেন অনেক কৃষক। দাম কমে গেলে তারা বেশি বিপদে পড়বেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, জেলায় এবছর ৫৩ হাজার ২৭৫ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাত লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর জেলায় ৪৪ হাজার ৮১০ হেক্টর জমিতে চারা পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ছয় লাখ ৯০ হাজার ৪৪৫ মেট্রিক টন। গতবারের তুলনায় এবার জেলায় ৯ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে হালি পেঁয়াজের চাষ হয়েছে। কৃষি কর্মকর্তারা জানান, দেশে প্রতি বছর পেঁয়াজের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ২৫-২৬ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে পাবনা জেলা থেকেই উৎপাদন হয় প্রায় সাড়ে ছয় লাখ মেট্রিক টন, যা মোট উৎপাদনের এক চতুর্থাংশ। আবার জেলার সাঁথিয়া-সুজানগর উপজেলা থেকে উৎপাদন হয় প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ টন পেয়াঁজ। সে হিসেবে সারা দেশে মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের এক প মাংশ উৎপাদিত হয় পাবনার এ দুটি উপজেলা থেকে।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, জেলার চাষিরা দুটি পদ্ধতিতে পেঁয়াজের আবাদ করে থাকেন। এর একটি কন্দ ( মূলকাটা বা মুড়ি) ও অন্যটি চারা (হালি) পদ্ধতি। মূলকাটা পদ্ধতিতে পেঁয়াজের আবাদ শুরু হয় অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ও হালি পদ্ধতিতে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে। মূলকাটা পদ্ধতিতে আবাদ করা নতুন পেঁয়াজ ডিসেম্বর মাসে হাটে উঠতে শুরু করে। আর হালি পদ্ধতিতে চাষ করা পেঁয়াজ হাটে ওঠে মার্চের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে এপ্রিল মাস পর্যন্ত। স্থানীয় চাষিরা বলেন, হাটে প্রতি মণ নতুন হালি পেঁয়াজ ২৫০০ থেকে তিন হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে নি¤œমানের পেঁয়াজ দুই হাজার টাকা দরেও পাওয়া যাচ্ছে। আর খুব ভাল মানের কিছু পেঁয়াজই শুধু তিন হাজার টাকা মণ দরে বেচা কেনা হচ্ছে। এবছর, এবার মূলকাটা বা মুড়ি পেঁয়াজ চাষে চাষিরা কিছুটা লাভবান হয়েছেন। এজন্য হালি পেঁয়াজ আবাদে চাষিরা ঝুঁকেছেন।
সাঁথিয়ার কুমিরগাড়ীা গ্রামের পেঁয়াজ চাষি মহসিন আলী জাগো নিউজকে জানান, পেঁয়াজ চাষের উপকরণ যেমন সার, বীজ, চাষের খরচ, শ্রমিক খরচ বেড়ে গেছে। এমনকি এক বস্তা পেঁয়াজ মাঠ থেকে বাড়ি নিতেও ৭০ টাকা লাগছে। পেঁয়াজ কাটাতে নারী শ্রমিকদের খরচ দিতে হয় প্রতি মণ ৩০-৪০ টাকা। এরপর হাটে নিতে আরও খরচ ২০ টাকা। হাটের খাজনা দিতে হয়। সে হিসেবে উৎপাদনের পরও তাদের প্রতিমণ ১০০ টাকা বাড়তি খরচ চলে যাচ্ছে। কিন্তু সরকারের নীতি নির্ধারকমহল বিষয়টি বুঝছেন না। চাষিরা একটু লাভবান হতে গেলেই আমদানি করে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিশ্বাসপাড়া গ্রামের বড় পেঁয়াজ চাষি জুয়েল হোসেন জাগো নিউজকে জানান, যে শ্রমিক খরচ হয়েছে ও চাষের যে খরচ তাতে প্রতি মণ দুই হাজার টাকা উৎপাদন খরচই চলে যায়। মৌসুমের শুরতে তিন হাজার টাকা মণ বাজার দর থাকলে তাদের কিছুটা লাভ হয়।
তিনি আরও জানান, প্রতি বছরই যদি ক্ষতি বা উৎপাদন খরচের সমান দাম ওঠে তাহলে তারা কিভাবে পেঁয়াজ চাষ করবেন। তিনি সরকারে কাছে এলসি বন্ধ ও চাষের উপকরণের দাম কামানোর দাবি জানান।
কুমিরগাড়ী গ্রামের পেঁয়াজ চাষি খাজা আবু সাইদ জাগো নিউজকে জানান, জমিতে পেঁয়াজ চাষ করতে হলে শুরুতেই পিঁয়াজ বীজ কেনা, চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলা ভাড়া করতে হয়। জমি চাষ সেচ, সার, গোবর, নিড়ানি, শ্রমিক ও উত্তোলন খরচ মিলিয়ে তাদের প্রায় ৪০-৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। এক বিঘা জমি লিজ নিলে দিতে হয় ২৫-৩০ হাজার টাকা। পেঁয়াজের গড় ফলন হয় ৪০-৫০ মণ। সে হিসেবে মণ প্রতি প্রায় দুই হাজার টাকা উৎপাদন খরচেই চলে যায়। বছর শেষে তো পেঁয়াজ পঁচে ও ওজন কমে অর্ধেকে নেমে আসে। এজন্য মৌসুমের শুরুতেই তিন হাজার টাকা দাম না পেলে তারা লাভের মুখ দেখবেন না। পদ্মবিলা গ্রামের ডাবলু শেখ বলেন, ‘আমার জমি লিজ নেওয়া। এজন্য উৎপাদন খরচ আরও বেশি। পেঁয়াজ আমদানি হলে চাষিদের ভাত বিনে মরতে হবে।’ কুমিরগাড়ী গ্রামের সাইদুল ইসলাম জানান, তিনি দুই বিঘা জমি পেঁয়াজ করেছন। কিন্তু বিঘা প্রতি যে খরচ হয়েছে তাতে মণ প্রতি তিন হাজার টাকা পেঁয়াজ বিক্রি না করলে তার পোষাবে না।
বাংলাদেশ ফার্মার্স এসোসিয়েশন (বিএফএ) এর কেন্দ্রীয় সভাপতি শাহজাহান আলী বাদশা বলেন, বছরের শেষ দিকে অনেক সময় পেঁয়াজের দাম বাড়ে। তবে সে দাম সাধারণ চাষিরা পায় না। কারণ চাষের খরচজনিত দেনার কারণে তাদের মৌসুমের শুরুতেই সিংহভাগ পেঁয়াজ বেঁচে ফেলতে হয়। এজন্য চাষিকে লাভবান করতে হলে মৌসুমের শুরুতেই তাদের ফসলের নায্য দাম প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. জামাল উদ্দিন জানান, এবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েননি চাষিরা। তাই তারা বেশ নিরাপদেই পেঁয়াজ ঘরে তুলতে পারছেন। এবার চাষিরা লাভবান হবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।- জাগো নিউজ




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com