শাওয়াল শব্দটি আরবি। এর আভিধানিক অর্থের ব্যাপারে আভিধানিকরা বিভিন্ন অর্থ উল্লেখ করেছেন। এখানে তা উল্লেখ করা হলো: এক. শাওয়াল শব্দটি ‘শাওল’ ক্রিয়ামূল থেকে নির্গত। এর অর্থ ওপরে ওঠা, ওঠানো, উঁচু হওয়া, উঁচু করা ইত্যাদি। (লিসানুল আরব, খ–১১, পৃষ্ঠা-৩৭৬, কামুসুল ওয়াহিদ, পৃষ্ঠা-৮৯৯)
আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, এই মাসে (শাওয়াল) নর উট মাদি উটের সঙ্গে সহবাস করে এবং সে সময় তার লেজ সে ওপরে উঠিয়ে নেয়। এ জন্যই এ মাসকে ‘শাওয়াল’ বলা হয়। (তাফসিরে ইবনে কাসির, খ–৭, পৃষ্ঠা-১৯৬)। দুই. শাওয়াল শব্দটি ‘তাশবিল’ ক্রিয়ামূল থেকে নির্গত। অর্থ (উটের দুধ) হ্রাস পাওয়া, কম হওয়া বা কমে যাওয়া ইত্যাদি। (কামুসুল ওয়াহিদ, পৃষ্ঠা-৯০০)
আল্লামা ইবনে মানজুর (রহ.) বলেন, এই মাসে (শাওয়াল) উটের দুধ হ্রাস পেত। এ জন্যই এ মাসকে ‘শাওয়াল’ বলা হয়। (লিসানুল আরব, খ–১১, পৃষ্ঠা-৩৭৭)। তিন. শাওয়াল শব্দের আরেক অর্থ ছেড়ে যাওয়া বা খালি রাখা। যেহেতু এই মাসে (শাওয়াল) আরবরা তাদের বাড়িঘর ছেড়ে শিকারে যেত, তাই এ মাসকে ‘শাওয়াল’ বলা হয়। (তাজুল আরুস, খ–১৪, পৃষ্ঠা-৩৯৭, গিয়াসুল লুগাত, পৃষ্ঠা-৩০০)
চার. আল্লামা ইবনে আসাকির (রহ.) শাওয়াল নামকরণের ব্যাপারে বলেন, এ মাসে সব মানুষের গুনাহ উঠিয়ে নেওয়া হয় (অর্থাৎ ক্ষমা করে দেওয়া হয়)। এ জন্যই এ মাসকে ‘শাওয়াল’ বলা হয়। (তারিখে দামেস্ক, খ–৪৫, পৃষ্ঠা-৩৩৫, কানজুল উম্মাল, খ–৮, পৃষ্ঠা-৫৮৮)
শাওয়াল মাসের ফজিলত : শাওয়াল মাস একটি বরকতময় মাস। এই মাসের বরকত প্রথম রাত থেকেই শুরু হয়। শাওয়ালের প্রথম দিন তথা ঈদুল ফিতর হলো বরকতময় দিন এবং এর রাতও বরকতময়।
শাওয়াল মাসের প্রথম দিন ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়, যা ইসলামের একটি মহৎ উৎসব এবং মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত খুশি ও আনন্দের দিন।
শাওয়াল মাস হজের প্রস্তুতির প্রথম মাস : আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘হজের কয়েকটি নির্দিষ্ট মাস আছে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৯৭)
উলামায়ে কিরাম একমত যে আশহুরে হজ তথা হজের মাস তিনটি, যার প্রথমটি হলো শাওয়াল, দ্বিতীয়টি জিলকদ এবং তৃতীয়টি হলো জিলহজের প্রথম ১০ দিন। (ফাতহুল বারি, খ–৩, পৃষ্ঠা-৪২০)
শাওয়াল মাসের আমল : শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখার ফজিলত বহু হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যা সহিহ সনদে হাদিসের বহু কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো :
সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি শাওয়ালের (রমজানের রোজা রাখার পর) ছয়টি রোজা পালন করবে, তা সারা বছর রোজা রাখার সওয়াব হিসেবে গণ্য হবে। কারণ যে ব্যক্তি একটি নেক আমল করবে, তাকে ১০ গুণ সওয়াব দেওয়া হবে। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৭১৫)
আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখবে এবং তারপর শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখবে, সেগুলো সারা বছরের রোজা হিসেবে গণ্য হবে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৬৬৪)
উপরোক্ত হাদিসে রমজানের রোজা রাখার পর শাওয়ালের ছয় দিন রোজা রাখার জন্য পুরো বছর সওয়াব পাওয়ার কারণ সহিহ ইবনে খুজায়মাতে বর্ণনা করা হয়েছে। সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রমজানের রোজা ১০ মাস এবং (শাওয়ালের) ছয়টি রোজা দুই মাসের (সমান)। অতএব এগুলো সারা বছরের রোজার সমতুল্য।(সহিহ ইবনে খুজায়মা, হাদিস : ২১১৫)
আল্লামা নববী (রহ.) বলেন, প্রতিটি নেক আমলের সওয়াব ১০ গুণ। এই হিসাব অনুযায়ী রমজান মাস ১০ মাসের সমপরিমাণ এবং শাওয়ালের ছয়টি রোজা দুই মাসের সমতুল্য। ফলে সব মিলিয়ে পূর্ণ এক বছর হয়। আর এভাবেই সারা বছর রোজা রাখার সওয়াব পাবে। (শারহুন নববী, খ–১, পৃষ্ঠা-৩৬৯)। আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.) শাওয়ালের ছয় দিনের রোজার ব্যাপারে কয়েকটি ফজিলত উল্লেখ করেছেন—
এক. সারা বছর রোজা রাখার সওয়াব পাওয়া যায়।
দুই. হাশরের দিন নফলের মাধ্যমে ফরজের ঘাটতি ও ত্রুটি পূরণ করা হবে। যেমনটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে : কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দার নামাজের হিসাব নেওয়া হবে। আর হিসাব অনুযায়ী বান্দার আমল পরিমাপ করা হবে। ফরজ আমলে যদি কমতি বা ঘাটতি থাকে তাহলে নফল আমলের মাধ্যম তা পূরণ করা হবে। আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের বলবেন, দেখো! আমার বান্দার কোনো নফল আমল আছে কি না। যদি থাকে তাহলে আমার বান্দার ফরজের ঘাটতি নফলের মাধ্যমে পরিপূর্ণ করে দাও। (আবু দাউদ, হাদিস : ৭৬৬)
উল্লেখ্য, শাওয়ালের ছয় রোজা নামাজের আগে ও পরের সুন্নত ও নফলের মতোই। এগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা রমজানের রোজাগুলোর ঘাটতি ও ত্রুটি পূরণ করে দেবেন।
তিন. রমজানের পর শাওয়ালের রোজা রাখা রমজানের ফরজ রোজা কবুল হওয়ার প্রমাণ ও নিদর্শন। হাদিস থেকে প্রমাণিত যে আল্লাহ তাআলা যখন কোনো বান্দার নেক আমল কবুল করেন, তখন তাকে আরো নেক আমল করার সুযোগ দেন। হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কি (রহ.) বলেন, একটির পর দ্বিতীয় নেক আমল করা প্রথম নেক আমল কবুল হওয়ার লক্ষণ। (ইসলাহি মাজালিস, খ–৬, পৃষ্ঠা-৩১৪)
চার. আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের জিকির, হামদ, তাসবিহ, তাকবির ইত্যাদির মাধ্যমে রমজানের রোজা পালনের নিয়ামত ও তাওফিকের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদের পক্ষে যা সহজ সেটাই চান, তোমাদের জন্য জটিলতা চান না এবং (তিনি চান) যাতে তোমরা রোজার সংখ্যা পূরণ করে নাও এবং তোমাদের হিদায়াত দান করার দরুন আল্লাহ তাআলার মহত্ত্ব বর্ণনা করো, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৫)
অতএব, রমজানের বরকত এবং গুনাহ মাফের জন্য কৃতজ্ঞতাস্বরূপ রমজানের পরে কয়েকটি রোজা রাখা কাম্য। ওয়াহিব বিন আল ওয়ার্দ (রহ.)-কে কোনো ভালো কাজের পুরস্কার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলতেন, কোনো ভালো কাজের পুরস্কার ও প্রতিদান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা কোরো না, বরং কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করো। কারণ আল্লাহ তাআলা তোমাকে নেক আমল করার তাওফিক দান করেছেন। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা-৪৯৩)
জরুরি মাসআলা: এক. শাওয়ালের ছয়টি রোজা রাখা মুস্তাহাব। তাই রমজানের রোজা রাখার পরপর এই ছয়টি রোজা রাখার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া বাঞ্ছনীয়। কেননা এই ছয়টি রোজা সারা বছর রোজা রাখার সওয়াবের সমতুল্য।
দুই. এই ছয়টি রোজা ফরজ বা ওয়াজিব নয়। তাই কেউ রোজা না রাখলে গুনাহগার হবে না। সুতরাং কেউ রোজা না রাখলে তাকে দোষারোপ করা উচিত নয়, কারণ এটি মুস্তাহাব রোজা, যা পালন করলে সওয়াব পাওয়া যায়, কিন্তু না রাখলে কোনো গুনাহ নেই।
তিন. শাওয়ালের প্রথম দিন (ঈদের দিন) ছাড়া মাসের যেকোনো দিন এই ছয়টি রোজা পালন করা যেতে পারে। একটানা বা বিরতি দিয়ে (উভয়ভাবেই) রাখতে পারবে, যেটি সুবিধাজনক। (আদ দুররুল মুখতার, খ–২, পৃষ্ঠা-৪৩৫) আল্লাহ তাআলা আমাদের রমজানের রোজা ও অন্যান্য ইবাদতের শোকরস্বরূপ শাওয়াল মাসের রোজা রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন। লেখক : অনুবাদক ও গবেষক