ঘূর্ণিঝড় রিমাল তা-বলীলা চালিয়েছে লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলার মেঘনা নদীর উপকূলীয় এলাকায়। লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চরফলকন ইউনিয়নের মাতব্বরহাট এলাকার বাসিন্দা ৬৫ বছরের বৃদ্ধা বিবি কহিনুর। ছেলে, ছেলের বৌ, মেয়ে এবং নাতিসহ পাঁচজন মিলে যে ঘরে থাকতেন, সেই ঘরটি ল-ভ- করে দিয়েছে ঘূর্ণিঝড় রিমাল। ফলে আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে পরিবারটি। শূন্য ভিটায় এখন কোনো ভাবে অস্থায়ীভাবে দুটো টিন দাঁড় করিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছেন। কিন্তু ঘর তৈরি করার মতো সামর্থ্য নেই এ পরিবারটির। সাম্প্রতিক সময়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে মেঘনা নদীর সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে তার ঘরটি ল-ভ- হয়ে যায়। এখন দুঃশ্চিন্তায় ঘরের সামনে বসিয়ে কি যেন ভাবছেন কহিনুর। একই এলাকার গৃহবধূ শামসুন নাহারের ঘরটিও ভেঙে ল-ভ- করে দিয়েছে গেছে রিমাল। সে ঘরটি তিনি ধারদেনা করে মেরামত করে নিচ্ছেন। কারণ ঘরে থাকা বিবাহ উপযুক্ত দুই মেয়েকে নিয়ে তো অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ নেই। তাই ঘরের খুব কাছে নদী থাকায় জোয়ারের পানি থেকে রক্ষা পেতে ঘরের নিচের অংশে মাচা তৈরি করে সংস্কার করে নিচ্ছেন তিনি। একই বাড়ির মো. জাহাঙ্গীরের ঘরটিও ল-ভ- হয়ে গেছে। একাংশ মেরামত করে কোনো রকম বসবাস করছেন, বাকী অংশ মেরামতের মতো অর্থ তার কাছে নেই। ওই বাড়ির এক বিধবা নারীর বসতভিটাসহ ঘরটিই নদীতে তলিয়ে গেছে। তিনি এখন আশ্রয়হীন হয়ে বাড়িই ছেড়েছেন। কারণ বসতভিটা যে স্থানে ছিল, ওই স্থানটি এখন উত্তাল নদীর অংশ। কমলনগর উপজেলার মাতাব্বরহাট, লুধুয়া, নবীগঞ্জ, সাহেবেরহাট, নাছিরগঞ্জ, পাটারীরহাট ও মতিরহাট এবং রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার, বাংলাবাজার, জনতাবাজার, আসলপাড়া, চররমিজ, চরআলগী, বড়খেরী ও চরগাজী ইউনিয়নের মেঘনা নদীর তীর সংলগ্ন এসব এলাকার বাসিন্দাদের অধিকাংশরা ঘর হারিয়েছে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাব ও মেঘনা নদীর সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে। মেঘনা নদীর তীরবর্তী হওয়ায় বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত নদী ভাঙন, অতিরিক্ত জোয়ারের প্লাবিত এবং বসতি হারানোর মধ্যে দিয়ে বসবাস করে যাচ্ছেন। নদীর সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস কারো বসতভিটেসহ ঘর কেড়ে নিয়েছে, কারো বসতঘর ভাসিয়ে নিয়েছে। আবার কারও ঘর ভেঙে দিয়েছে। এদের মাঝে নেই কোন ঈদের আনন্দও। এসব পরিবারের কারো মাথায় এখন ঈদের আনন্দের খবর নেই। সবাই ব্যস্ত নিজ নিজ বাড়ীঘর ও বসতভিটা তৈরী নিয়ে টেনশনে দিনাতিপাত করছেন সবাই। বসতঘর হারিয়ে এখন অনেকেই আশ্রয়হীন। আর ভিটে হারিয়ে কেউ ভূমিহীন। ঘরের ভেতর থাকা মালামাল হারিয়ে কেউবা আবার সহায়সম্বলহীন হয়ে পড়েছে। রামগতি ও কমলনগর উপজেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে,আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা রামগতি, এরপর কমলনগর উপজেলা। রামগতি উপজেলাতে ২৫৩টি বসতঘর সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪ হাজার ৮৪টি। কমলনগরে পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৪৫টি, আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৮০টি। সরকারি হিসেবে দুউপজেলায় মোট ৩৯৮টি বসতঘর সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪ হাজার ৩৬৪টি। এর বাহিরেও দুউপজেলায় আরও শতাধিক ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। ঘূর্ণিঝড় রিমালে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, এদের অনেকেই কৃষক কিংবা জেলে। প্রতিনিয়ত এরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্য পড়ে সর্বহারা হচ্ছেন। যাদের ‘নুন আনতে পান্তা ফুরাই’ অবস্থা, তাদের পক্ষে এসব দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। আর ক্ষতিগ্রস্ত এসব বাসিন্দাদের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সহযোগিতা করা হয়নি। সহায়তা করার কোন সম্ভাবনাও দেখছেননা স্থানীয়রা। জনপ্রতিনিধিরা কোনো কোনো এলাকা পরিদর্শন করে গেলেও সহযোগিতার আশ্বাস দেননি। আর অর্থকড়ি না থাকায় নতুন বসতি স্থাপন বা ঘর মেরামতের উদ্যোগ নিতে পারছেন না উপকূলের ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পারছেন না উপকূলীয় অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দাবি, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। বরাদ্দ আসেনি, তাই সহায়তা করা যাচ্ছে না। কমলনগরের চরফলকন এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত শামছুন নাহার, বিবি কহিনুর,পাখি বেগম, ফাতেমা আক্তার, মো. জাহাঙ্গীর, বিবি আয়েশা এ প্রতিবেদককে বলেন, আমাদের থাকার ব্যবস্থা নেই। রান্না করার মতো অবস্থাও নেই। কিন্তু আমাদের কোনো সহযোগিতা করা হয়নি। চেয়ারম্যান-মেম্বার এসে দেখে গেছেন, ল-ভ- বাড়িঘরের ছবিও তুলে নিয়ে গেছেন। কিন্তু কোনো খাদ্য সহায়তা বা আর্থিক সহায়তা করেননি। ঘর নির্মাণ তো দূরে থাক, দুই বেলা ভাত জোগাড় করতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে। তারা বলেন, শুনেছি দুর্যোগে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু সরকারি সহায়তা আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়নি। নদী আমাদের খুব কাছেই, যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হই। আমাদের অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। নদীর পাড়েই থাকতে হয়। জলোচ্ছ্বাসে ঘর নিয়ে গেছে, বসতভিটাও নিয়ে যাবে। এ বিষয়ে জানতে পাটারীরহাট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এডভোকেট নুরুল আমিন রাজু বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে আমরা উপজেলা প্রশাসনকে দিয়েছি। এখন পর্যন্ত কোন সহায়তা ক্ষতিগ্রস্তরা পায়নি। রামগতির চরগাজী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাওহিদুল ইসলাম সুমন বলেন, কমলনগরের তুলনায় রামগতিতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে উপজেলা পরিষদে জমা দিয়েছি। কমলনগর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা পরিতোষ কুমার বিশ্বাস এ প্রতিবেদককে বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু ঘর মেরামত বা নির্মাণের জন্য নগদ অর্থ কিংবা টিন বরাদ্দ আসেনি। তাই সহযোগিতা করা যায়নি। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য খাদ্য সহায়তাও চাওয়া হয়েছে। বরাদ্দ পেলে সহায়তা করা যাবে। কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুচিত্র রঞ্জন দাস বলেন, বরাদ্দ এলে ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা করা হবে। রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ আমজাদ হোসেন বলেন,এ উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর তালিকা আমরা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে প্রেরণ করেছি। বরাদ্দ আসলে দেওয়া হবে।