শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪, ০৬:১২ অপরাহ্ন

লিথিয়াম চীনকে আফগানিস্তানের কাছে টেনেছে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বুধবার, ২৬ জুন, ২০২৪
২০২১ সালে জুলাই মানে আফগানিস্তানের ৯ জনের প্রতিনিধি দল চীন সফরে গিয়েছিল। সেখানে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই (বাঁয়ে) ও তালেবানের রাজনৈতিক প্রধান আবদুল ঘানি বারাদার। তিয়ানজিন, ২৮ জুলাই, ২০২১

পৃথিবীর পশ্চিম থেকে পূর্ব অনেক দেশ আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদ লিথিয়ামের মজুতের কিছুটা হলেও পাওয়ার আশায় আছে। আর এই দৌড়ে তালেবান প্রশাসনকে আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে বেইজিং। টিআরটি ওয়ার্ল্ডের অনলাইনে ১৩ জুন লিখেছেন আতা সাহিত্য। দৈনিক প্রথমআলোর সৌজন্যে পত্রস্থ করা হলো।- বার্তা সম্পাদক
লিথিয়াম নিয়ে প্রতিযোগিতা: প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী প্রায় এক লাখ টন লিথিয়াম কার্বনেটের কেনাবেচা হয়। এর ৯৮ দশমিক ৩ শতাংশ রপ্তানি করে চিলি, আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, জার্মানি, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। আর এই লিথিয়ামের ৮৬ দশমিক ৩ শতাংশের আমদানিকারক দেশ হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, বেলজিয়াম, জার্মানি, স্পেন, তুরস্ক, রাশিয়া, থাইল্যান্ড, ফ্রান্স, ভারত ও ইতালি। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, লিথিয়াম নিয়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ এই খাতে ব্যবসা ৪০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। লিথিয়ামের প্রাথমিক প্রক্রিয়াকরণের কাজটি হয় মূলত অস্ট্রেলিয়া, চিলি ও আর্জেন্টিনায়। এর পরের ধাপটি হয় চীনে। শীর্ষ বৈদ্যুতিক পণ্য উৎপাদনকারী দেশ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রও লিথিয়াম উৎপাদনের শেষ ধাপের কাজ করে থাকে। এসব দেশের মধ্যে চীন বিশ্বের মোট লিথিয়াম উৎপাদন, পরিশোধন ও বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারের ৬০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে।
উপরন্তু, বিশ্বব্যাপী বৈদ্যুতিক ব্যাটারির বাজারে চীনের একটি শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। বিশ্বের মোট চাহিদার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ব্যাটারি উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে তাদের। বিশ্বের বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি প্রস্তুতকারক শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের ৬টিই চীনে অবস্থিত। মূল্যবান এসব খনিজের বিষয়ে চীনের নেতৃত্বের ভূমিকা আকস্মিক কোনো ঘটনা নয়, বরং ইচ্ছাকৃত ও কৌশলগত পরিকল্পনার ফল এটি। বিশ্বব্যাপী ইস্পাতশিল্পে নিজেদের অবস্থান থেকে শিক্ষা নিয়ে চীন তাদের শিল্পায়নের কৌশলকে রূপান্তরে পরিবেশবান্ধব জ্বালানিকে প্রাধান্য দিয়েছে। বিশেষ করে বৈদ্যুতিক গাড়ি ও লিথিয়াম ব্যাটারি তৈরির ক্ষেত্রে।
ইস্পাতশিল্পে লভ্যাংশের বেশির ভাগই পেতেন খনির প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকেরা। বিপরীতে বিশ্বের মোট ইস্পাতের ৫০ শতাংশের বেশি উৎপাদন করলেও চীন খুব কম লভ্যাংশ পেত, অথচ এই খাতে তাদের শক্তি ও শ্রম বেশি ছিল। এই অভিজ্ঞতাই বিশ্বব্যাপী লিথিয়াম খনিগুলোতে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে চীনকে উৎসাহিত করেছে।লিথিয়ামে চীনের এই প্রতাপ দেখে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো লিথিয়ামসমৃদ্ধ দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধিতে ব্যাপক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে তারা চীনের এই আধিপত্যের বিরুদ্ধে চাপ প্রয়োগ করে চলেছে।
আফগান লিথিয়ামে চীনের আগ্রহ: লিথিয়াম আফগানিস্তানের জন্য এক আশীর্বাদ। অনুমেয় যে শিগগিরই আফগানিস্তান এই খনিজ নিয়ে বলিভিয়ার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে। ইউএস ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (নাসা) পরিচালিত এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, আফগানিস্তানে অব্যবহৃত লিথিয়াম খনিগুলোর মূল্য আনুমানিক এক ট্রিলিয়ন (এক লাখ কোটি) ডলার।
আফগানিস্তানের লিথিয়াম খনি হেরাত থেকে নুরিস্তান প্রদেশ পর্যন্ত আছে বলে জানা গেছে, যার দৈর্ঘ্য ৮৫০ থেকে ৯০০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৫০ থেকে ২০০ কিলোমিটার। অনুমান করা হচ্ছে, এই লিথিয়াম খনিগুলোর জীবনকাল প্রায় ৭০ বছর। ১৯৮০-এর দশকে সোভিয়েত খনির বিশেষজ্ঞরা প্রথম আফগানিস্তানে লিথিয়াম আছে বলে আবিষ্কার করেছিলেন। যা-ই হোক, তাঁরা এই তথ্য ২০০৪ পর্যন্ত বেশ ভালোভাবেই গোপন রেখেছিলেন। মার্কিন ভূতাত্ত্বিকদের একটি দল কাবুলে আফগানিস্তান ভূতাত্ত্বিক জরিপ গ্রন্থাগারে পুরোনো মানচিত্র এবং তথ্যউপাত্ত ঘাঁটতে গেলে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা পুরোনো রুশ মানচিত্র ধরে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির নজরদারি বিমান ব্যবহার করে আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদের তথ্য সংগ্রহ করে।
২০০৭ সালে মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা একটি সুসজ্জিত ব্রিটিশ বোমারু বিমান দিয়ে ভূগর্ভস্থ খনিজ মজুতের একটি ত্রিমাত্রিক প্রোফাইল পেয়েছিল। আর এ কারণেই লিথিয়ামে সমৃদ্ধ আফগানিস্তানে চীনের আগ্রহ বেড়েই চলেছে এবং এ লক্ষ্যে জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছে। ২০২১ সালের আগস্টে তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসার পরও চীন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছিল, দেশটির সঙ্গে তাদের পূর্ববর্তী চুক্তিগুলো অব্যাহত থাকবে।
প্রকৃতপক্ষে, বর্তমানে ২০টির বেশি চীনা প্রতিষ্ঠান আফগানিস্তানে কাজ করছে এবং শতাধিক চীনা কোম্পানি দেশটির খনিতে কাজ করার জন্য আফগানিস্তানের খনি মন্ত্রণালয়ে তাদের নাম নিবন্ধন করেছে। তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর আনুমানিক ৫০০ চীনা ব্যবসায়ী আফগানিস্তান সফর করেছেন। কাছ থেকে দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদ পরখ করে দেখাই তাঁদের ওই সফরের উদ্দেশ্য ছিল। বেশির ভাগ চীনা কোম্পানি ও তাদের বিনিয়োগ খনি ও খনিজ উন্নয়নের ওপর জোর দিচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে লিথিয়াম খনি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
আফগানিস্তানের সংবাদমাধ্যমের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, আফগানিস্তানের গজনি প্রদেশে লিথিয়ামের ব্যাপক মজুত এবং ওয়াখান সীমান্ত দিয়ে চীনে সহজে যাতায়াতের সুযোগের কারণে তাদের দেশের প্রতি চীনের ব্যাপক আগ্রহ জন্মেছে। মূলত ২০২৩ সালের এপ্রিলে আফগান গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, চীনের গোচিন কোম্পানি প্রাথমিক পর্যায়ে আফগানিস্তানের লিথিয়াম খনিতে এক হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
আফগানিস্তানের লিথিয়াম সম্পদ মার্কিন কর্মকর্তাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। ২০১০ সালে মার্কিন গণমাধ্যম পেন্টাগন কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে দাবি করেছিল, আফগানিস্তান যে বিপুল পরিমাণ লিথিয়াম আছে, সেই কারণে দেশটি ‘লিথিয়ামের সৌদি আরব’ হয়ে যাবে। সাধারণভাবে চীন-আফগানিস্তান পারস্পরিক সম্পর্কে অর্থনৈতিক স্বার্থ প্রাধান্য পায়। তালেবান আবার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসার পর তাদের সঙ্গে যে কয়েকটি দেশ সম্পর্ক বজায় রেখেছে, তার মধ্যে চীন অন্যতম।
পারস্পরিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ দুই পক্ষকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। আফগানিস্তানের ভূখ- থেকে মার্কিন বাহিনীকে প্রত্যাহারের পরই দেশটিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য সেই সুযোগ চীন কাজে লাগিয়েছে।
তালেবানের দেওয়া নিরাপত্তা চীনকে আফগানিস্তানে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়নের একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে, যার মধ্য দিয়ে বেইজিং তার কৌশলগত স্বার্থ হাসিল করতে চায়।
অন্যদিকে তালেবান তাদের অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে চীনা প্রকল্পগুলোকে কার্যকর একটি সুযোগ হিসেবে দেখছে। চীনের অর্থনৈতিক প্রকল্প ও বিনিয়োগের প্রস্তাবগুলো নিজেরা যাচাই করার পর তালেবান বুঝতে পেরেছে, দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্কের পেছনে লিথিয়াম হবে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এককথায় বলতে গেলে লিথিয়াম ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কৌশলগত একটি পণ্যে রূপ নিচ্ছে। আর আফগানিস্তান-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই পণ্য একটি কৌশলগত অবস্থান হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com