সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান বাংলাদেশ বলে জানিয়েছেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট ডক্টর কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বীর বিক্রম। তিনি বলেন, বিগত ৫ আগস্ট থেকে অদ্যবধি ভারতের বিভিন্ন মিডিয়ায় বাংলাদেশে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর জুলুম হচ্ছে, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে হৈচৈ করছে এবং যে ধরনের সংবাদ প্রকাশ করেছে সেগুলো ভিত্তিহীন। তবে, দেশে কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে। কিছু কিছু জায়গায় ক্ষুব্ধ জনতা আওয়ামী জুলুমবাজ এবং গণহত্যাকারীদের ওপর চড়াও হয়েছে। জনগণ ধর্মের বিবেচনায় কারো ক্ষতি সাধন করেনি। বরং গণহত্যাকারীর দোসরদের ওপর আক্রমণ করেছে। এটা যুগে যুগে অনেক দেশে হয়েছে। আমি আবারো বলছি বাংলাদেশ হলো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর মগবাজারের এলডিপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
কর্নেল অলি বলেন, বিগত ১৫ বছর যাবৎ আওয়ামী স্বৈরাচারী সরকার কর্তৃক প্রত্যেক স্তরে কিছু কিছু সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে বিনাভোটে ক্ষমতা দখল, ব্যাংকের টাকা লুণ্ঠন, দুর্নীতি, টাকা পাচার, চাকরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য, বিরোধী দলগুলির ওপর অমানবিক অত্যাচার, নির্যাতন, গুম-খুন, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, জায়গা দখল, দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান উর্ধ্বগতি, মানবঅধিকার লঙ্ঘন, সকল ক্ষেত্রে বিচারহীনতার পুঞ্জীভূত বেদনা সহ্য করে মানুষ নীরব ছিল।
তিনি বলেন, কিন্তু ৫ আগস্ট ২০২৪ ছাত্র-জনতার চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে এদেশের মানুষ আরেক বার দেশ স্বাধীন করেছে। এ ধরনের সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগ পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। আমাদের ছেলে-মেয়েরা এদেশের উপযুক্ত উত্তরসূরী। বর্তমান প্রজন্মকে নিয়ে আমরা গর্বিত।
কর্নেল অলি আরো বলেন, ১৯৭২ সালের পর থেকে অদ্যবধি আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের সদস্যরাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জায়গা-জমি, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে দখল করেছে, উপাসনালয় ধ্বংস করেছে, পক্ষান্তরে তারা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ওপর তার দোষ চাপানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল, এখনো রয়েছে। আশা করি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা আর নতুনভাবে বিভ্রান্ত হবে না। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য বাংলাদেশ হচ্ছে একটি স্বর্গরাজ্য, কারণ এদেশের ১৮ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ৯২ শতাংশ মানুষ মুসলমান। আমরা পবিত্র কোরআন মেনে চলি, অন্যদের ওপর জুলুম করা কোরআনে নিষেধ আছে। আবারো বলি বাংলাদেশ হলো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এলডিপির মহাসচিব ও সাবেক মন্ত্রী ড. রেদোয়ান আহমেদ, এলডিপির প্রেসিডিয়াম সদস্য নূরুল আলম তালুকদার, ড. নেয়ামূল বশির, ড. আওরঙ্গজেব বেলাল, উপদেষ্টা অধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমান, যুগ্ম মহাসচিব বিল্লাল হোসেন মিয়াজি প্রমুখ।
ইতোপূর্বে এলডিপির পক্ষ থেকে গত ৮ আগস্ট অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের উদ্দেশ্যে কিছু পরামর্শ আমরা দিয়েছিলাম, কিছু কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে, অনেকগুলি এখনো হয় নাই। এ বিষয়ে সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টারে কাছে দাবিসমূহ: ১. ২০০৯ সালের পর হতে স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের আমলে গণহত্যাকারী, দেশের সম্পদ লুণ্ঠনকারী, দুর্নীতিবাজ নেতা, চেয়ারম্যান, মেম্বার, এমপি, সাবেক এমপি, সাবেক মন্ত্রীসহ সকল অবৈধ সুবিধাভোগীদের গ্রেফতার করার পূর্ণ মাত্রায় কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না কেন? অবিলম্বে তাদের গ্রেফতার করে তাদের ব্যাংক হিসাব ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত করাও প্রয়োজন।
২. হেফাজত ইসলামের আন্দোলনের সময় যে হত্যাকা- ঘটানো হয়েছিল তাদের বিচারের জন্য কমিশন গঠন করা হউক।
৩. পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর বিদ্রোহের নামে ৫৭ জন অফিসারসহ অন্যান্যদের হত্যার বিচারের জন্য কমিশন গঠন করা হউক।
৪. গণহত্যার দায়ে শেখ হাসিনাসহ দায়ী মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের পদক্ষেপ নেয়া হউক।
৫. সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক ও বিচারপতি মানিক, জন-বিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশকে অনিশ্চিয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই দুইজনের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
৬. ২০০৯ সালের পর হতে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে যে সমস্ত রাজনৈতিক মিথ্যা মামলা বা গায়েবি মামলা হয়েছে তা প্রত্যাহার করে নিতে হবে।
৭. পুলিশে অসংখ্য আওয়ামী ক্যাডার লুকিয়ে আছে। যে সমস্ত পুলিশ কর্মকর্তা ও মন্ত্রী গণহত্যার জন্য উস্কানি দিয়েছে, সুষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে তাদেরকে কঠোর বিচারের আওতায় আনতে হবে।
৮. স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গসংগঠনগুলি গণহত্যাকারী, দুর্নীতিগ্রস্ত, টাকা লুণ্ঠনকারী ও টাকা পাচারকারী সন্ত্রাসী সংগঠনে পরিণত হয়েছে। তাদেরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। এ ব্যাপারে আমরা বিগত ৮ আগস্ট সর্ব প্রথম দাবি জানাই।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এলডিপি এবং জনগণের পক্ষে বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রতি সুপারিশ সমূহ: ১. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ খুবই জরুরি : ১৮ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। বিভিন্ন দেশের সংবিধান পর্যালোচনা করে আমাদেরকে প্রয়োজনে কয়েকটি প্রদেশ করতে হবে এবং ওই আলোকে নতুন সংবিধান তৈরি করতে হবে। তাহলে ঢাকা বসবাসের উপযুক্ত নগরী হবে। জনগণের সমস্যার লাঘব হবে। একজন ঝাড়ুদারের চাকরি হলেও ঢাকা থেকে অনুমোদন নিতে হয়। তাহলে নতুন বাংলাদেশ কিভাবে বিনির্মাণ করবে।
২. প্রত্যেক বিভাগে হাইকোর্ট স্থাপন করতে হবে।
৩. স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতকে গুরুত্ব দিয়ে প্রত্যেক বিভাগে অন্তত ৩/৪টি আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল নির্মাণ করতে হবে। সেই সাথে বিদেশ থেকে অভিজ্ঞ বাংলাদেশী ডাক্তারদের দেশে ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে।
৪. বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন, নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সমস্ত কমিশনগুলোকে স্বাধীন এবং রাজনীতিমুক্ত রাখতে হবে। একইসাথে তাদের দায়বদ্ধতা ও জাবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. ডিজিএফআই ও ডিজিএনএসআইসহ সকল গোয়েন্দা সংস্থার কাজ সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে। র্যাব ও পুলিশের ক্ষমতা প্রয়োগের সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। র্যাবের প্রধান সব সময় সশস্ত্র বাহিনী থেকে পদায়ন করতে হবে।
৬. সকল স্তরে পদায়নে রাজনীতিমুক্ত রাখার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের আমলে যারা তাবেদারী করেছে তাদেরকে প্রমোশন দিয়েছে। আশাকরি অন্তর্র্বতীকালীন সরকার তা শুধরানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। আগামীতে যেন কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা কোনো দলের সেবাদাস না হয় বা দলের সদস্য না হয়, তা নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশের মাটিতে আর স্বৈরশাসক, দুর্নীতিবাজ, টাকা পাচারকারী, লুঠেরাদের স্থান হবে না।
৭. খুনী-লুঠেরা ব্যবসায়ীরা রাতারাতি রং পরিবর্তন করছেন। সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ প্রাপ্ত, সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পোস্টিং করে দেয়াটা শুধুমাত্র সমাধান নয়। ভুলবশত কোনো বদলি বা পদায়ন হয়ে থাকলে তা পুনরায় শুধরায় নিয়ে তদন্ত করে শান্তির ব্যবস্থা করতে হবে। যে সকল কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছে, অবসর দেয়া হয়েছে বা বরখাস্ত করা হয়েছে, তাদের বিগত দিনের অপকর্ম এবং দুর্নীতির তদন্ত করতে হবে। তাদের কাছে থেকে জনতার টাকা উদ্ধার করে সরকারি কোষাগারে জমা করতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ গণপূর্ত ও রাজউক এর কথা বলা যায়।
৮. দুর্নীতিমুক্ত, দারিদ্রমুক্ত, জবাবদিহিমূলক এবং সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করা আমাদের সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য। নীতি ও নৈতিকতা তলানীতে ঠেকেছে। তা পুনরায় সমাজে ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যথায় নতুন বাংলাদেশ গঠন হবে না।
৮. নতুন প্রজন্মের আধুনিক চিন্তাধারা, টেকনোলজি ও পুরাতনদের অভিজ্ঞতার সমন্বয় ঘটিয়ে নতুন বাংলাদেশ গঠন করা একান্ত প্রয়োজন।