বরিশালের বানারিপাড়া, আগৈলঝাড়া ও উজিরপুরের বেশকিছু এলাকা বছরের বেশিরভাগ সময় বর্ষা মৌসুম ছাড়াও পানিতে ডুবে থাকে শত শত একর জমি। এসব জমিতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ভাসমান ধাপ তৈরি করা হয়। এরপর ধাপের ওপর বপন করা হয় বেগুন, পেঁপে, লাউ, শিম, কুমড়া, টমেটো, ঝিঙা, চিচিঙ্গা, কাঁচা ও বোম্বাই মরিচ, করল্লা, শসা ও বরবটির বীজ। বংশ পরম্পরায় ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এভাবে চাষাবাদ করে আসছেন বরিশালের বানারিপাড়ার বিশারকান্দি ইউনিয়নের উমারের পাড় গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দারা। দীর্ঘদিন ধরে চাষাবাদের কারণে এই প্রক্রিয়ায় তাদের কাছে সহজ হয়ে গেছে। তবে চাষাবাদে কোনও ধরনের হাইব্রিড বীজ ব্যবহার করেন না তারা। এই পদ্ধতির চাষাবাদে যুক্ত কৃষক মো. কামাল বলেন, কচুরিপানা, শ্যাওলা ও দুলালীলতা স্তরে স্তরে সাজিয়ে দুই ফুট পুরু ধাপ বা ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়। একেকটি ভাসমান ধাপ ৫০-৬০ মিটার লম্বা ও দেড় মিটার চওড়া। ধাপে সরাসরি বীজ বপন করা যায় না। তাই কৃষকরা প্রতিটি বীজের জন্য এক ধরনের আধার তৈরি করেন। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘দৌল্লা’। ছোট কচুরিপানা ও দুলালীলতার মধ্যে নারকেলের ছোবড়ার গুঁড়া দিয়ে দৌল্লা তৈরি করা হয়। এর মধ্যে বিভিন্ন সবজির অঙ্কুরিত বীজ পুঁতে মাচানে বা শুকনো জায়গায় রাখা হয়। এর আগে ভেজা জায়গায় অঙ্কুরিত করা হয় বীজ। ধাপ তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে নারীরা দৌল্লা গুলো এভাবে তিন থেকে সাত দিন সারি করে রাখা হয়। এরপর বসানো হয় ধাপে। পাঁচ-ছয় দিন পরপর ধাপের নিচের কচুরিপানার মূল বা শ্যাওলা দৌল্লার গোড়ায় বিছিয়ে দেওয়া হয়। একটি অঙ্কুর বীজতলায় রোপণ করার ২০ থেকে ২২ দিনের মধ্যে পূর্ণ বয়স্ক চারা হয়ে ওঠে। ধাপে দৌল্লা স্থাপন থেকে শুরু করে পরিচর্যা পুরুষরা করেন। তবে দৌল্লা তৈরি করেন নারীরা। ৫০-৬০ মিটারের একটি ধাপ তৈরিতে প্রায় দশ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। কৃষকরা জানান, একটি ধাপের ওপর কয়েকবার চাষাবাদ করা যায়। পানি থাকা অবস্থায় দীর্ঘদিন ধাপের কোনও সমস্যা হয় না। একটি চাষ শেষ করার পর ধাপে আবারও কচুরিপানাসহ বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ দিলে তা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। তবে পানি শুকিয়ে গেলে এ ধাপের কোনও কার্যকারিতা থাকে না। ধাপে যা উৎপাদন হয় তা বরিশাল বিভাগের ছয় জেলা শহর থেকে শুরু করে পিরোজপুর, খুলনা, বাগেরহাট ও মাদারীপুরসহ বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যায় খুচরা ও পাইকাররা। তবে এতে আশাতীত লাভ নেই। তারপরও যা আয় হয় তা দিয়ে ভালোভাবে বছর কেটে যায় বলে জানান তারা। পরিবার-পরিজনই ভাসমান ধাপ তৈরিতে সাহায্য করে ধাপ তৈরিতে ব্যবহৃত কচুরিপানা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ নৌকায় করেও বিক্রি করা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কচুরিপানা, দুলালী বন, শ্যাওলা ও ফ্যানা ঘাসসহ বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ। তারা বিভিন্ন স্থান থেকে ওইসব জলজ উদ্ভিদ সংগ্রহ করে তা নৌকায় নিয়ে ধাপে কর্মরতদের কাছে যান। তাদের প্রয়োজন হলে তারা সেভাবে কিনে কাজে লাগান। তবে এর সংখ্যা খুবই কম। এ জন্য বিশারকান্দির খালে প্রতিদিন ভোরে বসে জলজ উদ্ভিদ বিক্রির ভাসমান হাট। স্থানীয়রা জানান, জন্মের পর থেকে এই ভাসমান চাষাবাদ দেখে আসছেন তারা। আর যারা এ চাষাবাদে জড়িত তাদের পরিবার-পরিজনই ভাসমান ধাপ তৈরিতে সাহায্য করে। পরিবারের প্রতিটি সদস্য এ কাজে সম্পৃক্ত। বিশেষ করে নারীরা ধাপ তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছেন। তারা আরও বলেন, পূর্ব পুরুষরা যেভাবে ধাপে চাষাবাদ করে আসছেন, সেই প্রক্রিয়াতেই কাজ করছেন তারা। কৃষি অফিস থেকে এ কাজের জন্য কোনও সহায়তা পান না। উল্টো কষি অফিসের লোকজন এসে ধাপ তৈরির প্রক্রিয়া জানতে চান। বানারীপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিজান মাহামুদ বলেন, বর্তমানে ২০০ হেক্টর জমিতে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ চলছে। তবে এর সঙ্গে কত পরিবার জড়িত সে বিষয়ে কোনও তথ্য নেই। একইভাবে বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার ইউনিয়নের বাশাইল এবং আহুতি-বাটরা গ্রামে ভাসমান ধাপে চারা উৎপাদন করা হচ্ছে। ধাপের ওপর কয়েকবার চাষাবাদ করা যায় আগৈলঝাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দোলন চন্দ্র রায় বলেন, বর্তমানে ২০০ হেক্টর ভাসমান বেডে চাষাবাদ হচ্ছে। সেখানকার প্রায় চার থেকে ৫০০ পরিবার এর সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে সেখানে বাণিজ্যিকভাবে লাউ, শিম, বেগুন, ফুলকপি, ওলকপি, বরবটি, করল্লা, পুঁইশাক, মিষ্টি কুমড়া, ধনেপাতা, ডাঁটা, টমেটো, আদা, হলুদ, পেঁপে ও মরিচসহ বিভিন্ন চারা উৎপাদন করা হচ্ছে। এতে তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছে। এ ছাড়া ধাপে সবজি চাষ এলাকার চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় তা পাঠানো হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আগে বছরে একবারই নিচু এলাকার জমিতে চাষাবাদ করতেন কৃষকরা। বাকি সময় জমিতে পানি জমে থাকায় জমি অনাবাদি থাকতো। বদ্ধ পানিতে আগাছা ও কচুরিপানায় ভরে যেত মাঠের পর মাঠ। বোরো ধান কাটার পর বর্ষা মৌসুমে নিম্নাঞ্চলের ফসলবিহীন আবাদি ক্ষেত যখন পানিতে তলিয়ে থাকে, তখন হাত গুটিয়ে বসে না থেকে গাছের চারা ও ফসল উৎপাদনের এ উপায় বের করেন এখানকার কৃষকরা।