সচিবালয় এলাকায় গত রোববার রাত সাড়ে নয়টার দিকে আনসার সদস্যদের বেধড়ক মারধরের শিকার হন প্রথম আলোর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক আসিফ হাওলাদার। চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে গতকাল দিনভর সচিবালয় ঘেরাও করে রাখার পর রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান আনসার সদস্যরা। সচিবালয়ের সামনে দুই পক্ষের এই সংঘর্ষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহসহ অন্তত ৪০ শিক্ষার্থী আহত হন। এ সময় কয়েকজন আনসার সদস্যও আহত হন।
সংঘর্ষকালে সচিবালয় এলাকায় পেশাগত দায়িত্বপালন করছিলেন আসিফ। পরিচয় দেওয়ার পরও একদল উত্তেজিত আনসার সদস্য তাঁকে মারধর করেন। আহত আসিফ গতকাল রাতে হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। চিকিৎসকের পরামর্শে এখন তিনি বিশ্রামে আছেন। গতকাল রাতে মারধরের শিকার হওয়ার ঘটনার আদ্যোপান্ত গতকাল সোমবার দুপুরের দিকে প্রথম আলোকে জানান তিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ গতকাল রাত সাড়ে ৮টার দিকে তাঁর ফেসবুকে একটা পোস্ট দেন। ফেসবুক পোস্টে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, তাঁদের সবাইকে সচিবালয়ে আটকে রেখেছেন আনসার সদস্যরা। তিনি সবাইকে রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানান। হাসনাত আবদুল্লাহর আহ্বানের ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে হাজারো শিক্ষার্থী রাজু ভাস্কর্য এলাকায় জড়ো হন। সচিবালয়ে আটকে থাকা উপদেষ্টাসহ অন্য সবাইকে উদ্ধারে শিক্ষার্থীরা লাঠিসোঁটাসহ সংগঠিত হয়ে রাজু ভাস্কর্য এলাকায় আসেন। রাত ৯টা ৫ মিনিটের দিকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে টিএসসি এলাকা থেকে সচিবালয়ের দিকে রওনা দেন। তাঁরা অনেকটা দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছিলেন। শিক্ষার্থীদের মিছিলটি অনুসরণ করছিলেন আসিফ। চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে দিনভর সচিবালয় ঘেরাও করে অবস্থান করছিলেন আনসার সদস্যরা। শিক্ষার্থীরা যখন মিছিল নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনো আনসার সদস্যরা সচিবালয়ের সামনে উত্তেজিত অবস্থায় অবস্থান করছিলেন। আনসার সদস্যরা শিক্ষা ভবন থেকে জিরো পয়েন্টমুখী সড়কে ছিলেন। শিক্ষার্থীদের মিছিলটি দোয়েল চত্বর হয়ে শিক্ষাভবন পেরিয়ে সচিবালয়ের দিকে যাচ্ছিল। তখন রেল ভবন ও খাদ্য ভবনের সামনে পাওয়া কয়েকজন আনসার সদস্যকে মারধর শুরু করেন উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা। এ সময় অন্য শিক্ষার্থীরা নিবৃত্ত করেন। পরে শিক্ষার্থীদের মিছিলটি সচিবালয়ের দিকে এগোতে থাকে। সচিবালয়ের আগের বিদ্যুৎ ভবনের সামনে অবস্থান করছিলেন আসিফ। সেখান থেকে তিনি দেখতে পান, শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেওয়ার জন্য আনসার সদস্যরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সচিবালয়ের সামনে সড়কে ঢুকে পড়া শিক্ষার্থীদের ধরে ফেলার জন্য একদল আনসার সদস্য কিছুটা এগিয়ে গিয়ে সড়কে ব্যারিকেড দেন।
ঘটনার দৃশ্য ধারণ করার জন্য পকেট থেকে স্মার্টফোন বের করতেই একদল আনসার সদস্য আসিফকে ধাওয়া দেন। তিনি সাংবাদিক বলে নিজের পরিচয় দেন। আনসার সদস্যরা তাঁর কোনো কথাই শুনছিলেন না। অন্তত ১০-১৫ জন আনসার সদস্য একজোট হয়ে আসিফকে কিল, ঘুষ, লাথি মারতে থাকেন।
বেদম মারধরে আসিফ সড়কে পড়ে যান। এ সময় বুট পায়ে থাকা আনসার সদস্যরা তাঁকে লাথি মারতে থাকেন। কোনো কোনো আনসার সদস্য তাঁদের কোমরে থাকা বেল্ট খুলে আসিফকে পেটাতে থাকেন। একপর্যায়ে তাঁরা ক্লান্ত হয়ে থামেন। চলে যাওয়ার সময় আসিফের স্মার্ট ফোনটি নিয়ে নেন আনসার সদস্যরা। ফোনটি ফেরত চাইলে এক আনসার সদস্য সজোরে তাঁকে থাপ্পড় দেন।
আনসার সদস্যরা ছেড়ে দিলে আসিফ কোনোমতে সামনে আগান। তখন কিছু শিক্ষার্থী তাঁকে একটি রিকশায় তুলে দেন। এক শিক্ষার্থী তাঁর সঙ্গে রিকশায় ওঠেন। তিনি তাঁকে ফজলুল হক মুসলিম হলের অতিথিকক্ষে নিয়ে যান। সেখানে তাঁর মাথায় পানি দেওয়া হয়। খবর পেয়ে সহকর্মী সাংবাদিকেরা এসে আসিফকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীর ভিড় বেশি থাকায় আসিফকে রাজধানীর বেসরকারি ল্যাবএইড হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তাঁর শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ চিকিৎসা হয়। পরে তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। রাতে তিনি পরিচিত একজনের বাসায় গিয়ে ওঠেন।
আসিফ যে বাসায় অবস্থান করছেন, সেখানে গত রোববার দিবাগত রাতে তাঁকে দেখতে যান অন্তর্র্বতী সরকারের দুই উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই দুই সমন্বয়ক আহত আসিফের খোঁজখবর নেন।
গতকাল সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আসিফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পরও আনসার সদস্যরা উন্মত্ত হয়ে আমাকে বেদম মারধর করেছেন। আমার মাথাসহ সারা শরীরে আঘাত লেগেছে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের কালচে দাগ পড়ে গেছে। পেশিতে প্রচ- ব্যথা আছে। চিকিৎসক বলেছেন, আমি আশঙ্কামুক্ত। তবে পরবর্তী সময়ে অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলেছেন। আর আপাতত বিশ্রাম নিতে বলছেন চিকিৎসক।’