দ্বীনের জ্ঞানার্জন ও গৃহত্যাগ এ বিষয় দুটো যেন মরুভূমিতে বালির অবস্থানের মতো। মরুভূমি বললেই মানুষের মনে আসে দিগন্তজুড়ে ধূ ধূ বালির কথা। বালি ছাড়া মরুভূমির কল্পনা যেমন অযৌক্তিক ঠিক তেমনিভাবে গৃহত্যাগ ব্যতিরেকে দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করাও অকল্পনীয় ও অযৌক্তিক। কেননা, ঘরে অবস্থান করে জ্ঞানকে কখনো সমৃদ্ধ করা যায় না। একজন শিক্ষার্থী তার জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করতে চাইলে তাকে ঘর ত্যাগ করে সফর করতে হবে। পবিত্র কুরআনুল কারিমের বাণী- ‘প্রিয় হাবিব সা: আপনি বলুন, তোমরা পৃথিবীতে সফর করো এবং অনুধাবন করো।’ (সূরা আনকাবুত, আয়াত-২০)
জ্ঞানের এক অর্থ ‘অনুধাবন করা’ আর এই অনুধাবনের জন্য মানুষকে ঘর ত্যাগ করে সফর করতে হয়, সেটারই নির্দেশ উপরোল্লিখিত আয়াতে দেয়া হয়েছে। ইলমে দ্বীন তথা জ্ঞানার্জনের জন্য যে ঘর ত্যাগ করতে হয় এ ব্যাপারে ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল আল-বুখারি র: সহিহ বুখারি শরিফে কিতাবুল ইলমে ‘জ্ঞানার্জনের জন্য বের হওয়া’ নামে স্বতন্ত্র একটি অধ্যায় রচনা করেছেন। খেলাফতের পক্ষ থেকে শাম তথা সিরিয়া এলাকার দায়িত্বে থাকা বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উনাইস রা:-এর কাছে শুধু একখানা হাদিসের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের জন্য মদিনাতুল মুনাওয়ারাহর বাসিন্দা জলিলুল কদর সাহাবি হজরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা:-এর ঘর ত্যাগের মাধ্যমে এক মাসের পথ সফর করার কথা সেখানে বলা আছে।
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম আবু হামিদ আল-গাযালী স্বীয় এহইয়াউ উলুমিদ-দ্বীন কিতাবে একজন শিক্ষার্থীর জন্য আবশ্যক হিসেবে ১০টি গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিফা নির্ধারণ করেছেন তন্মধ্যে অন্যতম হলো- শিক্ষার্থীকে ইলমে দ্বীন তথা জ্ঞানার্জনে অবশ্যই অবশ্যই নিজ দেশ ও ঘর ত্যাগ করা আবশ্যক।
ইলমে দ্বীন তথা জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে বড় পীর হজরত আব্দুল কাদের জিলানি রহ:-এর ঘর ত্যাগের কথা জানেন। তিনি তার মা উম্মুল খায়ের ফাতেমার কাছে কুরআনুল কারিমের শিক্ষা গ্রহণ করেন। পিতা আবু ছালেহ মুসা জঙ্গির কাছে জীবন সম্পর্কিত নানা বিষয়ে পাঠ নেন। কিন্তু হঠাৎ পিতা আবু সালেহ মুসা জঙ্গি রহ:-এর ইন্তেকাল করলে তার পরিবার অর্থকষ্টে পড়ে। পরিবারে একমাত্র বৃদ্ধা মা ছাড়া অন্য কোনো সদস্য না থাকায় সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব কিশোর আবদুল কাদেরের ওপর অর্পিত হয়। ফলে তিনি পিতার রেখে যাওয়া জায়গা-জমি চাষ, ফলের বাগান ও গবাদিপশুর পরিচর্যায় আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু জ্ঞানের প্রতি গভীর টান থাকায় কিশোর আবদুল কাদেরের ওই সাংসারিক জীবন ভালো লাগেনি। তার মন আশা-নিরাশা ও সিদ্ধান্তহীনতার দ্বন্দ্বে পড়ে। জ্ঞানের সাধনায় নিজেকে আবারো নিযুক্ত করার জন্য তিনি উন্মুখ হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে ১৮ বছর বয়সে ইলমে দ্বীন অর্জনের জন্য মায়ের নির্দেশে ঘর ত্যাগ করে তিনি পাড়ি জমান তৎকালীন সময়ের জ্ঞানবিজ্ঞানের বাতিঘর খ্যাত বাগদাদ নগরীর মাদরাসায়ে নিজামিয়ায়। (বাহজাতুল আসরারকৃত গাউসে পাক আব্দুল কাদের জিলানি রহ:)
এভাবে খাজা গরিবে নওয়াজ রহ: ও দ্বীনের জ্ঞানার্জনের জন্য ঘর ত্যাগ করে সর্বপ্রথম রাশিয়ার সমরকন্দে সফর করেন, সেখানে কুরআন মাজিদ হিফজ সম্পন্ন করেন এবং জাহেরি ইলম সম্পন্ন করে আবার সেখান থেকে ইরাক সফর করে হজরত খাজা ওসমান হারওয়ানি রহ:-এর সান্নিধ্যে যান। (তারিখে মাশায়েখে চিশতিয়া)
কাজেই জ্ঞানার্জনের জন্য ঘর ত্যাগ করা অতীব জরুরি। ঘর ত্যাগ ব্যতীত ক্ষেত্রবিশেষ জ্ঞানার্জন স্থবির ও বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যুগ-যুগান্তর ধরে জ্ঞানপিপাসুরা যদি জ্ঞানার্জনে ঘর ত্যাগ না করতেন তাহলে জ্ঞানের জগৎ আজ এতটা সমৃদ্ধ হতো না। লেখক : শিক্ষার্থী ও প্রাবন্ধিক