বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২৯ অপরাহ্ন

গাজী টায়ার্সে লুটপাট নিয়ে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে সংঘর্ষে জড়ায় দুই পক্ষ

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৩০ আগস্ট, ২০২৪
শহিদুল ইসলাম ও রবিন হোসাইন ছবি: সংগৃহীত

সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর গ্রেপ্তারের খবর মাইকে প্রচারের পর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার খাদুন এলাকায় তাঁর টায়ার কারখানায় লুটপাট শুরু হয়। গত রোববার দুপুরে শুরু হওয়া লুটপাটকে কেন্দ্র করে একপর্যায়ে দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। যার জের ধরে রাতে কারখানার একটি ভবনে আগুন দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। গত সোমবার সকাল থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন সময় কারখানা এলাকায় আশপাশের বাসিন্দা, কারখানার কর্মকর্তা–কর্মচারী, পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী, সাবেক জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের নেতাসহ শতাধিক মানুষের সঙ্গে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী, গাজী টায়ার্সের কারখানায় লুটপাটকে কেন্দ্র করে শহিদুল ইসলাম ও রবিন হোসাইন ওরফে রাফির নেতৃত্বে সংঘর্ষে জড়ায় দুই পক্ষ। শহিদুল কোনো পদে না থাকলেও তারাব পৌরসভার যুবলীগের নেতা হিসেবে পরিচিত। রবিন তারাব পৌর ছাত্রলীগের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। সংঘর্ষের কথা স্বীকার করলেও দুইপক্ষই লুটপাট ঠেকাতে গিয়ে হামলার শিকার হওয়ার দাবি করেছেন।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ঘটনাস্থলে ছিলেন কারখানাটির এমন অন্তত ১৩ জন কর্মকর্তা–কর্মচারী ও সাতজন স্থানীয় বাসিন্দা সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁরা জানান, শনিবার (২৪ আগস্ট) রাতে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকা থেকে কারখানা মালিক সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী গ্রেপ্তার হওয়ার পর রোববার সকাল থেকেই খাদুন এলাকার বিভিন্ন রাজনৈতিক লোকজন কারখানায় আসতে শুরু করেন। তাঁরা কারখানার নিরাপত্তায় এলাকাবাসীকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য কর্মকর্তাদের চাপ দেন। কেউ কেউ কারখানায় পাহারার জন্য জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত দাবি করেন। কারখানা কর্তৃপক্ষ তাতে রাজি না হলে বেলা ১১টা নাগাদ তারা হুমকি–ধমকি দিয়ে কারখানা থেকে চলে যান।
বেলা সাড়ে ১১টায় খাদুন উত্তরপাড়া জামে মসজিদসহ অন্তত দুটি মসজিদ থেকে গোলাম দস্তগীরের গ্রেপ্তারের খবর মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ছাড়া গোলাম দস্তগীরের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধ আছে এমন লোকজনকে রূপসী মোড় ও খাদুন মোড়ে জড়ো হতে বলা হয়। তার পরই বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন কারখানার আশপাশে জড়ো হতে থাকেন এবং ভেতরে ঢুকে লুটপাট শুরু করে।
খাদুন উত্তরপাড়া জামে মসজিদের ইমাম লুৎফর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কে বা কারা এসে মসজিদের মাইকে ঘোষণা করেছেন তা তিনি জানেন না। তবে মূলত মাইকে ঘোষণার পরই লোকজন জড়ো হতে থাকে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত কারখানার চারপাশে লোক জড়ো হয়। সুযোগ বুঝে একেকজন একেক পাশ দিয়ে লুট শুরু করে। কারখানার লোকজন ঠেকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। বেলা তিনটা নাগাদ খাদুন এলাকার অন্তত তিন শতাধিক লোক কারখানায় লুট শুরু করে। বেলা তিনটার পর থেকে পাঁচটা পর্যন্ত খাদুন এলাকায় লুটপাটকারীদের দুটি পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে উভয় পক্ষ রামদা-সামুরাই ও একটি পক্ষ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। এ সময় তিনটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়।
কারখানার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রবিন ও তাঁর ভাই বাবুর লোকজন লুটের শুরু করে। শহিদুলের লোকজন পরে লুট করতে এলে দুই পক্ষে সংঘর্ষ হয়। লুটপাটের খবর ছড়িয়ে পড়লে বিকেল পাঁচটা নাগাদ বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার লোক লুটপাটে জড়িয়ে পড়ে। এরই মধ্যে কে বা কারা রাত নয়টায় ছয়তলা ভবনটির নিচতলায় আগুন দেয়। বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী, সেই আগুনের পর থেকে লুটপাটের সময় কারখানায় আসা অন্তত ১৭৫ জন নিখোঁজ থাকার দাবি করছেন স্বজনেরা।
গত মঙ্গলবার কারখানার খাদুন অংশে কথা হয় তারাব পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর বিএনপি নেতা তোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে। সংঘর্ষের বিষয়ে জানতে চাইলে তোফাজ্জল হোসেন তাঁর সঙ্গে থাকা খাদুন এলাকার গুলজার হোসেনের ছেলে মো. বাবুকে ঘটনার বিষয়ে বলতে বলেন। বাবু প্রথম আলোকে বলেন, ‘বরপা এলাকার যুবলীগ নেতা শহীদুল ইসলাম লোকজনসহ মোটরসাইকেলে করে কারখানা লুট করতে আসে। আমরা তখন এলাকাবাসীকে নিয়ে তাদের বাধা দিই। এ কারণে শহীদুল আমার মাথায় ও তার এক সহযোগী আমার কোমরে পিস্তল ধরে। পরে আমাদের ধাওয়ায় তারা এলাকা ছেড়ে চলে যায়।’
এ সময় তার সঙ্গে তার ছোট ভাই ছাত্রলীগ নেতা রবিন হোসেন ছিলেন বলে জানান বাবু। বাবু ও রবিন হোসেন তারাব পৌরসভা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক রায়হান মীরের ছোট ভাই। তবে রায়হান মীর প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন, ভাইয়েরা তাঁর কথা শোনেন না।
ঘটনার বিষয়ে রবিন হোসাইন বলেন, ‘শহিদুল লোকজন নিয়ে খাদুন আয়েত আলী উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কারখানা থেকে লুট করে আনা মালামাল রেখে দিচ্ছিল। বিনা কারণে সে আমার ভাইকে অস্ত্রের মুখে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করে। আমরা তখন এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে শহিদুলদের ধাওয়া দিই। লুটপাটকারীরাও আমাদের পক্ষ নিয়ে শহিদুলদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়।’
তবে শহিদুলের দাবি এলাকাবাসী নয়; বরং লুটপাটকারীদের সঙ্গেই তাঁদের সংঘর্ষ হয়েছে। ঘটনার বিষয়ে শহিদুল বলেন, ‘লুটপাটের কথা শুনে বেলা তিনটার পর আমরা মোটরসাইকেলে করে কয়েকজন কারখানায় যেতে চেয়েছিলাম; কিন্তু কারখানায় প্রবেশ করতে পারিনি। খাদুন আয়েত আলী উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে ছাত্রলীগ নেতা মো. রবিনের নেতৃত্বে তার ভাই মো. বাবু এবং তাদের সহযোগী গোফরান, সুমন, সোহেল, মাহিম, আল আমিন, মোস্তাকিম, ইয়াসিন, সাজ্জাদ রামদা চাপাতি-সামুরাই হাতে আমাদের বাধা দেয়। তারা আমাদের তিনটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে জ্বালিয়ে দেয়। একটি মোটরসাইকেল লুট করে। তাদের নেতৃত্বে মুখে কালি মেখে তিন শতাধিক লোক তখন কারখানায় লুট করছিল।’ এ সময় পৌরসভা বিএনপির সভাপতি হাফিজুর রহমান কারখানার লোকজন নিয়ে লুটপাটকারীদের বাধা দিতে এলে হাফিজুর রহমানদেরও মারধর করা হয় বলে দাবি শহিদুলের।
গাজী টায়ার্সের পুড়ে যাওয়া ভবনটি বৃহস্পতিবার সকালে পরিদর্শন করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক রাকিব আহসান। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ছয়তলা ভবনটিতে প্রবেশ করে উদ্ধার কার্যক্রম চালানো অত্যন্ত বিপজ্জনক। এর ফলে এখনই হতাহতের খোঁজে সম্পূর্ণ ভবনে অনুসন্ধান চালাচ্ছে না ফায়ার সার্ভিস। তারা ভবনটির বেজমেন্টে অনুসন্ধান চালিয়ে জানিয়েছে, বেজমেন্টে আগুন পৌঁছায়নি। সেখানে যেসব মেশিন ছিল, সেগুলোও অক্ষত রয়েছে। সেখানে কোনো হতাহত মানুষ পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনার তদন্তে গঠিত তদন্ত দলের প্রধান নারায়ণগঞ্জের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় অবশ্যই মামলা হবে। ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com