রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামের এলাহি বক্স ওরফে আফাং মিয়ার ছেলে রনি আহমেদ(৩০) ৩ ভাই/বোনের মধ্যে সে ছোট। বাবা পেশায় কৃষক। রনি আহমেদ ২০১৬ সালে ঢাকার ইউনিভারসিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি এ্যান্ড সাইন্স থেকে ইলেট্রিক্যাল এ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। পরে ঢাকায় জেড থ্রি করপোরেশনে চাকরিজীবন শুরু করেন। বর্তমানে বেসরকারি কোম্পানী এনারজিসিল্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড-এ কর্মরত। রনি জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঢাকার বনশ্রী এলাকায় অংশ নেন তিনি। এক পর্যায়ে শুরু হয় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। পেছন থেকে পুলিশ ও উপরে চক্কর দেওয়া হেলিকেপ্টার থেকে আশপাশে নির্বিচারে গুলি ছুড়ছে। ৪জন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। গুলিবিদ্ধ হন রনি আহমেদ। বিজিবির ছোড়া গুলি তার বাম পায়ের উরুর (হাটুর উপরে ও মাজার নীচে) এপার থেকে ওপারে বের হয়ে যায়। মনে হয়েছিল হয়ত মারা যাবো। গুলিবিদ্ধ হয়ে সাথে সাথে দোয়াই কুনুত পড়া শুরু করলাম। গুলিবিদ্ধ জায়গা থেকে অনেক রক্তপাত হচ্ছিলো। আশপাশে তেমন কেউ ছিল না,তখনো মনে হয়েছিল আর মনে হয় বাঁচবো না।
তখন কালেমা পড়া শুরু করি। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আমাকে রামপুরার বনশ্রী এলাকার এফ ব্লকের ৩ নম্বর রোডে আশ্রয়ে নিয়ে যায়। সে রামপুরা থানার বনশ্রী এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। তিনি আরও বলেন, গত ১৯শে জুলাই দুপুরে বাসায় ফেরার সময় দেখি পুলিশ আসছে আর গুলি করতে করতে চলে যাচ্ছে। নিজেকে স্থির রাখতে পারছিলাম না। তখন আওয়াজ পেলাম এধারছে ফায়ার করো ওধারছে ফায়ার করো। উপরে হেলিকপ্টার চক্কর দিয়ে গুলি ছুড়ছে। পুলিশ-বিজিবি সোসাইটির মধ্যে ঢুকে এভিনিউ রোডে গুলি করা শুরু করলো। সেফ জোনে যাওয়ার জন্য দুরে গেলাম। সামনে ৪/৫জন ছিল,গুলি লেগে তারা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তাদের লাশ নেওয়ার জন্য গুলি করতে করতে ভেতরে ধাওয়া করে চলে আসলো পুলিশ। সেখান থেকে জি ব্লকের ৩ নম্বর রোডের এক মহিলার বাসায় নিয়ে গজ ব্যান্ডেজ দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়। তাৎক্ষনিক একজন চিকিৎসক চিকিৎসা দিয়ে চলে যান। পরে এ্যাডভান্স হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখি বিপুল সংখ্যক গুলি বিদ্ধ মানুষ। সিট ফাকা নাই,ফ্লোরে তাদের চিকিৎসা চলছে। আমি ৩ নম্বর রোডের এফ ব্লকের ২৮ নম্বর বাসায় চলে আসি। সেখান থেকে চুপি চুপি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলাম। ২৬ জুলাই ডাক্তার বললো এখানে আইসেন না, তুলে নিয়ে যাবে। পরে ঢাকা থেকে এলাকায় ফিরলেও ভয়ে নিজ বাসায় না ফিরে পাশের উপজেলায় বোনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে চিকিৎসা নি। সেখান থেকে জানতে পারি পুলিশ খোজ খবর নিচ্ছে ঢাকায় থেকে কারা এলাকায় ফিরেছে। ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়লে নিজ বাড়িতে ফিরে আসি। তিনি বলেন,আমার আগষ্ট মাসের ১০ তারিখ থেকে বাঘা উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছি। এখন গ্রামের বাড়িতে বিছানায় দিন কাটছে। তিনি জানান, বাঘা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডা: আশাদুজ্জামান আসাদ সব সময় আমার পাশে থেকে খোঁজ-খবর রাখছেন এবং আমার চিকিৎসার জন্য ঔষধ বিনামূল্যে সরবরাহ করছেন। বুধবার (১৯ সেপ্টেম্বর২৪) রনির বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তাঁর বাঁ ঊরুতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। পায়ের নিচে বালিশ দিয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। চোখে-মুখে এখনো ভয়-আতঙ্ক ভর করছে তার। গুলিবিদ্ধ বাম পায়ে শক্তি নেই। আগের মতো আর শক্তি ফিরে পাবেন কি-না,তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন,আকাশে হেলিকপ্টার চক্কর দিয়ে উপর থেকে গুলি করছিল। নিচে পুলিশ-বিজিবির সঙ্গে বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলছিল। মনের টানেই আন্দোলনে যোগ দেন। অন্তত ২হাজার মানুষকে গুলবিদ্ধ অবস্থায় দেখেছেন তিনি। নিজ হাতে ৭ জনের লাশ বের করেছেন। রনির মা নিলুফা বেগম বলেন,আমার ছেলের কতদিন চিকিৎসা নেয়া লাগবে তা আল্লাহ ভালো জানেন। গুলিবিদ্ধ পায়ে কোনো শক্তি পাচ্ছে না। ওকে যেভাবে গুলি করেছে তাতে ওর জীবিত ফিরে আসার কথা ছিল না,আল্লাহ ওকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। বাবা এলাহি বক্স ওরফে আফাং মিঞা বলেন,দেশে যেন এমন পরিস্থিতি আর দেখতে না হয়। এবিষয়ে বাঘা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা অফিসার ডাঃ আশাদুজ্জামান আসাদ বলেন, তার সেরে উঠতে সময় লাগবে। তবে তার সুচিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহি অফিসার তরিকুল ইসলাম উজ্জল বলেন, খোঁজ খবর নিয়ে তার চিকিৎসার জন্য ব্যবস্থা নিতে। বাঘা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা অফিসার ডাঃ আশাদুজ্জামান আসাদকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এছাড়া যুগ্ম সচিব মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। বর্তমান কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা মন্ত্রণালয় রথীন্দ্রনাথ দত্ত গত ২৮ আগষ্ট গুলিবিদ্ধ রনির বাড়িতে গিয়ে তার খোঁজ-খবর নেন এবং সুচিকিৎসার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম উজ্জল ও বাঘা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা অফিসার ডাঃ আশাদুজ্জামান আসাদকে নির্দেশ দেন।