বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:৩১ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
শূরা বৈঠক ডেকে আজাদী বাজার মাদ্রাসায় ডুকতেই পারেননি হেফাজত আমীর ধনবাড়ীতে ছেলে মেয়েদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখাতে মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসাকে সরকারী করণের দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান বেনাপোল বিজিবি ও বিএসএফ সেক্টর কমান্ডার পর্যায়ে সীমান্ত সমন্বয় সভা কাপাসিয়ায় তারুণ্যের উৎসব টিউলিপের পদ্যতাগ : এবার তোপের মুখে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কতিপয় ব্যক্তির অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের কারণে ধুঁকছে বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম সংস্কার প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই নির্বাচন: প্রধান উপদেষ্টা মেয়াদ বাড়লো ৬ কমিশনের, ফেব্রুয়ারির শুরুতে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা কিশোরগঞ্জে আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে মামলা

‘গ্যাসলাইটিং’-এর ভয়াবহ পরিণতি

মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা:
  • আপডেট সময় বুধবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২৫

মানুষের মনোবল ভেঙে দিয়ে তাকে মানসিক শোষণের অন্যতম একটি কায়দা হলো গ্যাসলাইটিং। এর ধর্মীয় বিধান জানার আগে আমাদের জানতে হবে, গ্যাসলাইটিং মূলত কী, কেন করা হয়, সমাজের বিভিন্ন স্তরে এটি কিভাবে প্রভাব ফেলছে।
গ্যাসলাইটিং কী : ‘গ্যাসলাইটিং’ পরিভাষাটির সঙ্গে আমরা খুব বেশি পরিচিত না হলেও আমাদের সমাজে এই কাজটির প্রচলন খুব বেশি। কোনো দৃশ্যমান অস্ত্র ব্যবহার না করে মানুষকে তিলে তিলে শেষ করে দেওয়ার হাতিয়ার এটি।
পরিভাষায় পৈশাচিক এই মানসিক অত্যাচারে কারিগরকে কিংবা মানসিক শোষককে বলা হয় গ্যাসলাইটার। আর শোষিত ব্যক্তিকে বলা হয় ভিকটিম। গ্যাসলাইটাররা খুব সূক্ষ্মভাবে তাদের টার্গেটের মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করে, তাকে যত্রতত্র লোক সম্মুখে হেয় করে অসহায় ও দুর্বল করে তোলে। ভিকটিমের মনের মধ্যে তার নিজেকে নিয়ে সংশয়, আত্মবিশ্বাসের অভাব—এ ধরনের বিষয়গুলো পোক্ত করে দেয়। গ্যাসলাইটিং কেন করা হয় : মূলত অন্য ব্যক্তির ওপর এক ধরনের মানসিক নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার জন্য এবং নিজেকে ক্ষমতাশীল পর্যায়ে রাখার জন্যই মানুষ এমন আচরণ করে থাকে। যেসব ব্যক্তি এ ধরনের ব্যবহারের শিকার হন তাঁরা দ্বিধান্বিত ও চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং ক্রমে নিজেদের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন এবং তখনই তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়ে পড়ে নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তির পক্ষে।
আমাদের প্রিয় নবীজি (সা.)-কে হেয় করে মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য তাঁর শত্রুরা অন্যান্য অস্ত্রের মতো এই অস্ত্র ব্যবহার করতেও ভোলেনি। নবীজি (সা.)-এর শিশুপুত্র ইন্তেকাল করলে তারা প্রচার করতে শুরু করে যে, ‘তাঁর বংশ বিস্তৃত হবে না, শিকড় কাটা, তাঁর ধর্ম এখানেই শেষ হয়ে যাবে।
’ (নাউজুবিল্লাহ!), প্রিয় নবীজি (সা.)-এর মনোবল ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশ্যে করা তাদের সেই দোষারোপের জবাব মহান আল্লাহ নিজে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে একটি সুরা অবতীর্ণ হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘(হে রাসুল) নিশ্চয়ই আমি আপনাকে কাউসার দান করেছি। সুতরাং আপনি নিজ প্রতিপালকের (সন্তুষ্টি অর্জনের) জন্য নামাজ পড়ুন ও কোরবানি করুন। নিশ্চয়ই যারা আপনার শত্রু, তারাই শিকড় কাটা। (সুরা : কাউসার, আয়াত : ১-৩)
গ্যাসলাইটিংয়ের বিভিন্ন রূপ : গ্যাসলাইটিং আমাদের সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন রূপে বাস করে। এটা শুধু স্বামী-স্ত্রীর টক্সিক রিলেশনে সীমাবদ্ধ নয়। যেমন—১ নম্বরে রয়েছে পারিবারিক গ্যাসলাইটিং। এটি বিভিন্ন রকম হতে পারে, যেমন—স্বামী কিংবা স্ত্রী তার জীবনসঙ্গীকে মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রণ কিংবা ছোট করতে গ্যাসলাইটিং করে। তার বিভিন্ন দুর্বল দিক বের করে তাকে খোঁটা দেয়, অন্যদের সামনে হেয় করে, অসম্মান করে। তার প্রাপ্য সম্মান তো তাকে দেয়ই না, বরং বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইল করে তাকে হতাশায় ফেলে দেয়। অথচ পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শন এবং একে অপরের মতকে গুরুত্ব দিলে পরিবার অনেক সুখময় হয়। আমাদের নবীজি (সা.)-এর স্ত্রীরা সব সময় তাঁর মতকে সম্মান করেছেন। তিনিও বিভিন্ন বিষয়ে স্ত্রীদের মতকে সম্মান ও গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন—হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় তাঁর স্ত্রী উম্মে সালামাহ (রা.)-এর মতকে গুরুত্ব দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছিলেন। (বুখারি, হাদিস : ২৭৩১)
অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবাও নিজেদের অজান্তে তাঁদের আদরের সন্তানের সঙ্গে গ্যাসলাইটিং করে বসেন। সন্তানকে অন্যের সামনে দুর্বল, বোকা, লেখাপড়ায় খারাপ, কিছু পারে না—এ ধরনের কথা বলে শাস্তি দেন। এতে সন্তানের আত্মবিশ্বাস ও কর্মোদ্দীপনা একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। সে নিজেকে চরম গৌণ বা অচ্ছুত বলে ভাবতে শুরু করে। এ ধরনের কাজ সন্তানের ব্যক্তিত্ব গঠনে প্রতিবন্ধক। এ ধরনের আচরণের ফলে সন্তানের বিপথে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি থাকে। ইসলাম সন্তানকে আদব শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজনে প্রহার করারও সুযোগ দিয়েছে, কিন্তু এমন কাজ করা যাবে না, যা তাকে বেপরোয়া করে তোলে, যা তাদের জীবনে অকল্যাণ বয়ে আনবে। হজরত আলী (রা.) বলেন, ‘তোমরা নিজেরা শেখো এবং পরিবারবর্গকে শেখাও সব কল্যাণময় রীতি-নীতি এবং তাদের আদব শিক্ষা দাও এবং এসব কাজে অভ্যস্ত করে তোল।’ (ফাতহুল কাদির : ৫/২৪৬)
সামাজিক গ্যাসলাইটিং : আমাদের সমাজে অনেকেই আছে যারা ইচ্ছা করে অন্য মানুষের বয়স, চেহারা, পোশাক, লিঙ্গ, জাতি, ধর্ম ও বিশ্বাস নিয়ে বাজে মন্তব্য করে বা ছোট করে। এটাকে জাতিগত গ্যাসলাইটিং বলে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদাররা, কোনো সম্প্রদায় যেন অন্য কোনো সম্প্রদায়কে বিদ্রুপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রুপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর কোনো নারীও যেন অন্য নারীকে বিদ্রুপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রুপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর তোমরা একে অপরের নিন্দা কোরো না এবং তোমরা একে অন্যকে মন্দ উপনামে ডেকো না। ঈমানের পর মন্দ নাম কতই না নিকৃষ্ট! আর যারা তাওবা করে না, তারাই তো জালিম।’
(সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১১)
আমাদের সমাজে আলেমরাও এই গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হন, বিশেষ করে মাদরাসাপড়ুয়া ছাত্ররা অনেক সময় তাদের আত্মীয় থেকে শুরু করে বন্ধুবান্ধবের দ্বারাও গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হয়, যা তাদের প্রতি চরম অন্যায়। উবাদা ইবনে সামেত (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ওই ব্যক্তি আমার আদর্শের ওপর নেই, যে আমাদের বড়দের সম্মান করে না, ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের আলেমদের প্রাপ্য মর্যাদা প্রদান করে না।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২২১৪৩, মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদিস : ৩৮৪)আরেক প্রকারের গ্যাসলাইটিং হলো, রাজনৈতিক গ্যাসলাইটিং। রাজনৈতিক গ্যাসলাইটিং হচ্ছে যখন একটি রাজনৈতিক দল অন্য রাজনৈতিক দলকে হেয় করার জন্য মিথ্যা বলে বা জনগণের কাছে মিথ্যা বলে। অনেক সময় নিজেদের ভুল ঢাকার জন্য এমন বিতর্কের জন্ম দেয় যে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরে যায়।
চাকরির ক্ষেত্রেও মানুষ নানাভাবে হেয় হয়। একজন দক্ষ কর্মীকেও তার আত্মবিশ্বাস নষ্ট করার মাধ্যমে পেশাগতভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও গ্যাসলাইটিং হয়। সৎ ও যোগ্য কর্মীরাই কর্মক্ষেত্রের সিন্ডিকেটগুলোর দ্বারা নানাভাবে গ্যাসলাটিংয়ের শিকার হয়। সামনে-পেছনে অযৌক্তিক সমালোচনা করে তাদের ফোটানো ফুলকে ভুল আখ্যা দিয়ে, তাদের নিষ্ঠা ও ত্যাগকে কৌশলে অবমাননা করে তাদের কোণঠাসা করে দেওয়া হয়। ইসলামে এ ধরনের কাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, দুর্ভোগ আছে প্রত্যেক এমন ব্যক্তির, যে পেছনে অন্যের বদনাম করে (এবং) মুখের ওপরও নিন্দা করে। (সুরা : হুমাজাহ, আয়াত : ১)
আর মিথ্যা দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা এবং অন্যের চরিত্র হরণের জন্য মিথ্যা অপবাদ দেওয়া মুনাফিকের স্বভাব। মুনাফিকরা আয়েশা (রা.)-কে হেয় করে মূলত নবীজি (সা.) ও মুসলমানদের সংশয়ে ফেলে দেওয়ার জন্য আয়েশা (রা.)-এর চরিত্র নিয়ে মিথ্যা রটিয়েছিল। তখন মহান আল্লাহ আয়াত নাজিল করে তাদের সেই মিথ্যা প্রপাগান্ডার জবাব দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই যারা এ অপবাদ রটনা করেছে, তারা তোমাদেরই একটি দল। এটাকে তোমরা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর মনে কোরো না, বরং এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের থেকে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য রয়েছে, যতটুকু পাপ সে অর্জন করেছে। আর তাদের থেকে যে ব্যক্তি এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, তার জন্য রয়েছে মহা আজাব। (সুরা : নুর, আয়াত : ১১)
গ্যাসলাইটাররা যে পদ্ধতিই অবলম্বন করে, তার উদ্দেশ্য থাকে ভিকটিমকে ‘ওয়াসওয়াসায়’ ফেলে দেওয়া। সম্ভবত এরাও তাদের একটি অংশ, সুরা নাসে মহান আল্লাহ যে মানব শয়তানের অনিষ্ট থেকে বাঁচতে মানুষকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন।
এককথায় বলতে গেলে গ্যাসলাইটিং পদ্ধতিতে সাময়িক কাউকে ঠকিয়ে ও দমিয়ে পৈশাচিক শান্তি পেলেও এর পরিণাম ভয়াবহ। কারণ গ্যাসলাইটের শিকার হওয়া ব্যক্তি মাজলুম হয়। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, বিশ্বনবী (সা.) যখন মুয়াজ (রা.)-কে ইয়েমেনে পাঠান এবং তাঁকে বলেন, মাজলুমের ফরিয়াদকে ভয় করবে। কেননা, তার ফরিয়াদ এবং আল্লাহর মাঝে কোনো পর্দা থাকে না। (বুখারি, হাদিস : ২৪৪৮) মহান আল্লাহ সবাইকে এ কাজ থেকে হেফাজত করুন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com