২০২৩ সালে ১৮৪ বছরের চা শিল্পে উৎপাদনে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করলেও সদ্য বিদায়ী ২০২৪ সালে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। ২০২৩ সালে ১৬৮টি চা-বাগান ও ক্ষুদ্রায়তন চা-চাষিদের হাত ধরে ১০ কোটি ২৯ লাখ ১৮ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। কিন্তু সদ্য বিদায়ী ২০২৪ সালে শ্রমিক অসন্তোষ, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, বিরূপ আবহাওয়া ও কাঙ্খিত দাম না পাওয়াসহ নানা কারণে এবার চায়ের উৎপাদন কমেছে। গত বছর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পযন্ত মাত্র ৮ কোটি ৬৬ লাখ ৫১ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম। যদিও গত ডিসেম্বরের উৎপাদনের হিসাব এখনো সম্পন্ন হয়নি। চা বোর্ডের ধারণা, ডিসেম্বর মাসে ৮০ লাখ কেজি চা যোগ হতে পারে। এই ৮০ লাখ কেজি চা যোগ করা হলেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ কোটি ১২ লাখ ৬৯ হাজার কেজি চা উৎপাদন কম হবে। চা বোর্ড শ্রীমঙ্গল অফিসের দেয়া পরিসংখ্যান মতে, ক্ষুদ্রায়তনের বাগানসহ দেশের ১৬৯টি চা বাগানে জানুয়ারি-নভেম্বর পর্যন্ত অর্জিত ৮ কোটি ৬৬ লাখ ৫১ হাজার কেজি চা এরমধ্যে জানুয়ারিতে ১৭লা ৫০ হাজার, ফেব্রুয়ারিতে ৪লাখ২০ হাজার, মার্চে ১৫ লাখ ৯৩ হাজার, এপ্রিলে ৪৮ লাখ ৮২ হাজার, মে মাসে ৪৭ লাখ৭৫ হাজার, জুনে ১ কোটি ২৮লাখ ২৪ হাজার, জুলাইয়ে ১ কোটি ১৪ লাখ ৩৫ হাজার, আগস্টে ১ কোটি ৩৮ লাখ ৬হাজার, সেপ্টেম্বরে ১ কোটি ২২ লাখ ১৭ হাজার, অক্টোবরে ১ কোটি ৪৯ লাখ ২৩ হাজার ও নভেম্বরে ৯৯ লাখ ৭৮ হাজার কেজি চাউৎপাদন হয়েছে। শেষ হওয়া চা বছরের জানুয়ারি-ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশের বাজারে ৪৫ কোটি ৯৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা মূল্যে ২৪ লাখ ৫০ হাজার কেজি চা রপ্তানি হয়েছে। চলতি বছরে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। উৎপাদন আশানুরূপ না হওয়ায় চা শিল্প সংশ্লিষ্টরা লক্ষ্য অর্জন নিয়ে শঙ্কায় আছেন। চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর দেশে ১০ কোটি ৮০ লাখ কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু গত জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে ৭ কোটি ৬৬ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু দেশে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১ কোটি ৯৮ লাখ কেজি চা উৎপাদনের রেকর্ড রয়েছে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দুই মাসে ১ কোটি ১৫ লাখ কেজি চা বেশি উৎপাদন করা দরকার, যেটাকে অসম্ভবই মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। চা শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা জানান, বিরূপ আবহাওয়া বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে তীব্র খরা এবং মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রা চা উৎপাদনের জন্য প্রতিকূল ছিল। এ ছাড়া সার, সেচ ও কীটনাশকের উচ্চমূল্য এবং শ্রমিক ধর্মঘট চা উৎপাদনে প্রভাব ফেলেছে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং নিলামে চায়ের কাক্সিক্ষত দাম না পাওয়ায় গত চা মৌসুমে উৎপাদন আশানুরূপ হয়নি। কাক্সিক্ষত উৎপাদন পেতে হলে দেশের চা শিল্পে শ্রমিক অসন্তেুাষ, খরচ বৃদ্ধি এবং বাজারমূল্যের সমস্যা দূর করতে প্রয়োজনীয় কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে হবে। একই সাথে উন্নত প্রযুক্তি ও গবেষণার মাধ্যমে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়ার আর কোনো বিকল্প নেই, যোগ করছেণ বলছেন চা সংশ্লিষ্টরা। এ বছর চায়ের উৎপাদন কম হওয়ায় চট্টগাম, শ্রীমঙ্গল ৩০ টি নিলাম বাজারে চা সরবরাহ কমেছে এ বছর নিলাম প্রতি কেজি চায়ের গড় দাম ২১০ টাকা ৫৬ পয়সা। গত বছর ছিল ১৯২ টাকা। সরবরাহ কমে যাওয়ায় চায়ের দাম এবার কিছুটা বেড়েছে। গত বছর এক কেজি চায়ের উৎপাদন খরছ ছিল ২২৬ টাকা। এ বছর চা সংশ্লিষ্ট সব উপকরণের দাম বাড়ার কারনে উৎপাদন খরছ আরো বেড়েছে। একদিকে চায়ের উৎপাদন কমেছে, অপরদিকে বেড়েছে ব্যয়। তাই এ বছর বাগান মালিকদের লোকসানের মুখে পড়তে হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ২০২৪ সালে দেশের চা বাগানগুলোতে অনেক সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছে। ক্রমাগত লোকসানের কারনে অনেক চা বাগানের কারখানা দিনের পর দিন বন্ধ রয়েছে। বিশেষ করে উৎপাদনের ভরা মৌসুমে দেশের অন্যতম ন্যাশনাল টি কোম্পানি (এনটিসির) ১২টি চা বাগান বন্ধ ছিলো। মজুরি না পেয়ে এসব বাগেনের শ্রমিকরা কর্মবিরতি পালন করেন প্রায় তিন মাস। এর প্রভাব পড়েছে দেশের জাতীয় চা উৎপাদনে। এছাড়া টাকার অভাবে সব বাগানে সময়মতো সার দিয়ে পরিচর্যা না করতে পেরে গত বছরের চেয়ে উৎপাদন কমেছে। চা চাষের জন্য প্রয়োজন পরিমিত বৃষ্টি। কিন্তু অনাবৃষ্টির কারণেও চা উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটেছে। ন্যাশনাল ব্লেকার্সের সিনিয়র ম্যানেজার অনজন দেব বর্মন জানান, নিলামে গত বছরের চেয়ে এ বছর চায়ের সরবরাহ কমেছে। তবে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চায়ের চাহিদা সাড়ে ৯ কোটি কেজি চা পাতা। যে পরিমাণ চা পাতা বাগানে উৎপাদিত হবেদেশের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ চা সংসদের সিলেট অঞ্চলের চেয়ারম্যান ও জেমস ফিনলে চা কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার গোলাম মোহাম্মদ শিবলী বলেন, ২০২৪ সালে চা বাগানে গ্রীষ্মকালে তীব্র খরা বয়ে গেছে। তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ছিল। এই তাপমাত্রা চা গাছের জন্য অনুকূল ছিল না। এছাড়া সার, সেচ, কীটনাশকের মূল্য বৃদ্ধি, উৎপাদন খরচের কম মূল্যে চা বিক্রির প্রভাবের কারণে চায়ের উৎপাদন কম হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ১০ ভাগ অবদান রাখা এনটিসি চা বাগানগুলোতে বকেয়া বেতন আদায়ের দাবিতে গত চা মৌসুমে দীর্ঘ সময়জুড়ে শ্রমিক ধর্মঘট চলায় বাগানের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এসব মিলিয়ে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় ব্যাঘাত ঘটে। দেশের বৃহত্তম চা কোম্পানি ফিনলের চা বাগানগুলোতেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮ ভাগ চা কম অর্জিত হয়। সরকারি মালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানির (এনটিসি) ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর ও গোবিন্দ শ্রী চা হোল্ডিংসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন মিয়া মধু বলেন, হু হু করে চায়ের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। সরকারিভাবে চায়ের দাম ১৬০ টাকা ন্যূনতম নির্ধারণ করে দেয়া হলেও বাগান মালিকদের এক কেজি চা তৈরিতে খরচ পড়ে ২০০ থেকে ২২০ টাকা। সেখানে নিলামে চা বিক্রি করতে হয় ১৮০ থেকে ২০০ টাকা দরে। এতে উৎপাদন খরচই উঠছে না। ফলে ছোট ছোট বাগান মালিকদের টিকে থাকা নিয়ে লড়াই করতে হচ্ছে। এতে করে চা উৎপাদনে বাগান মালিকরা কিছুটা হলেও আগ্রহ হারাচ্ছে। অন্যদিকে পঞ্চগড়ের উৎপাদিত নিম্ন মানের চা পাতার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে উন্নত মানের চা প্রস্তুতকারী বাগানগুলো মার খাচ্ছে। গত মৌসুমে চা উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা কম হওয়ার এটাও অন্যতম কারণ। বাংলাদেশ চা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. ইসমাইল হোসেন বলেন, ২০২৪ সালে চা মৌসুমে উৎপাদনের পুরো হিসেবটা এখনো আমরা পাইনি। কয়েকটা বাগানের হিসাব এখনো বাকি রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত ৯১ মিলিয়ন কেজি বা ৯ কোটি ১০ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। উৎপাদন কম হওয়ার কারণ ন্যাশনাল টি কোম্পানির বাগানে শ্রমিক অসন্তোষের ফলে প্রায় ৫ মিলিয়ন কেজি উৎপাদন কম হয়েছে। এ ছাড়া উত্তরবঙ্গের বাগানগুলোতে এবার ৪-৫ মিলিয়ন কেজি উৎপাদন কমেছে। উত্তরবঙ্গে কেন উৎপাদন কম হলো সেটা জানার জন্য অনুসন্ধান চালানো হবে। জানা যায়, দেশের ১৬৯টি চা বাগানের মধ্যে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম ও ক্ষুদ্রায়তনের বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এবং পঞ্চগড় জেলা মিলে ৫৯ হাজার ১৮ হেক্টর জমিতে চা উৎপাদন করা হয়। এরমধ্যে কেবল মৌলভীবাজার জেলায় রয়েছে ৯০টি চা বাগান। দেশের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম ও ক্ষুদ্রায়তনের বান্দরবন, খাগড়াছড়ি এবং পঞ্চগড় জেলা মিলে ৫৯হাজার ১৮ হেক্টও জমিতে ১৬৯টি বাগানে চা উৎপাদন হয়। এরমধ্যে কেবল মৌলভীবাজার জেলায় চা বাগানের সংখ্যা ৯০ এবং চা চাষের ভূমির পরিমান ৩৩ হাজার ১ শ’ ৬০ হেক্টর। যা জেলার মোট আয়তনের ৫৫.১৯ শতাংশ বলে জানা গেছে।