রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:২৮ অপরাহ্ন

মুমিন শ্রেণী ভেদ

মুফতি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, অতঃপর আমি তাদেরকে কিতাবের অধিকারি করেছি যাদেরকে আমি আমার বান্দাদের মধ্য থেকে মনোনীত করেছি। তাদের কেউ কেউ নিজের প্রতি অত্যাচারী, কেউ মধ্যমপন্থা অবলম্বনকারী এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহর নির্দেশক্রমে কল্যাণের পথে এগিয়ে গেছে। এটাই মহাঅনুগ্রহ। (সূরা ফাতির- ৩২) এ আয়াতে উম্মতে মুহাম্মাদীকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তা হলো জালিম, মধ্যপন্থী ও সৎকর্মে অগ্রগামী।
নিজের ওপর জুলুমকারী দল : জালিম অর্থ জুলুমকারী, অত্যাচারী। এরা এমন সব ব্যক্তি যারা আন্তরিকতাসহকারে কুরআনকে আল্লাহর কিতাব এবং হজরত মুহাম্মদ সা:-কে আল্লাহর রাসূল সা: বলে মানে কিন্তু কার্যত আল্লাহর কিতাব ও মহানবী সা:-এর সুন্নাতের অনুসরণের হক আদায় করে না। তারা মুমিন তবে গুনাহগার, অপরাধী কিন্তু বিদ্রোহী নয়। দুর্বল ঈমানদার, তবে মুনাফিক এবং চিন্তা ও মননের দিক দিয়ে কাফির নয়। ফলে আত্মনিপীড়ক হওয়া সত্ত্বেও তারা আসমানি কিতাবের ওয়ারিসদের অন্তর্ভুক্ত এবং আল্লাহর নির্বাচিত বান্দাদের মধ্যে শামিল। বিদ্রোহী, মুনাফিক এবং চিন্তা ও মনের দিক দিয়ে কাফিরদের প্রতি এ গুণাবলি আরোপিত হতে পারে না। ইবনে কাসীর বলেন, জালিম সে ব্যক্তি যে কোনো কোনো ফরজ ও ওয়াজিব কাজে ত্রুটি করে এবং কোনো কোনো নিষিদ্ধ কাজেও জড়িত হয়ে পড়ে। তিন শ্রেণীর ঈমানদারের মধ্যে এ শ্রেণীর ঈমানদারের সংখ্যা বেশি। তাই এদের আলোচনা প্রথমে করা হয়েছে।
মধ্যমপন্থী দল : মধ্যমপন্থী মুমিন হলো এমন ব্যক্তিবর্গ যারা আসমানি কিতাবের উত্তরাধিকারি হওয়ার হক কমবেশি আদায় করে কিন্তু পুরোপুরি করে না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-এর হুকুম পালন করে এবং অমান্যও করে। নিজেদের প্রবৃত্তিকে পুরোপুরি লাগামহীনভাবে ছেড়ে দেয় না; বরং তাকে আল্লাহর অনুগত করার জন্য নিজেদের সাধ্যমতো চেষ্টা চালায় কিন্তু কখনো গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। অনুরূপভাবে এদের জীবনে ভালো-মন্দ পাপ-পুণ্য উভয় ধরনের কাজের সমাবেশ ঘটে। ইবনে কাসীর বলেন, মধ্যমপন্থী সেসব ব্যক্তি যারা সব ফরজ ও ওয়াজিব কর্মসম্পাদন করে এবং যাবতীয় নিষিদ্ধ কার্য থেকে বেঁচে থাকে। কিন্তু কোনো কোনো মাকরুহ কাজে জড়িত হয়ে পড়ে। এরা সংখ্যায় প্রথম দলের চেয়ে কম এবং তৃতীয় দলের চেয়ে বেশি। তাই এদের রাখা হয়েছে দু’নম্বরে।
অগ্রবর্তী দল : যারা ভালো কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে তারা অগ্রবর্তী দল। তারা আল্লাহর কিতাবের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে প্রথমসারির লোক। এরাই মূলত আসমানি কিতাবের উত্তরাধিকারের হক আদায়কারী। তারা কুরআন ও সুন্নাতের অনুসরণের ক্ষেত্রে অগ্রগামী। আল্লাহর বাণী তাঁর বান্দাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রেও এরা এগিয়ে থাকে। সত্যদ্বীনের জন্য ত্যাগ স্বীকারেও এরা অগ্রগামী। তাছাড়া সত্য, ন্যায়, সুকৃতি ও কল্যাণের যে কোনো কাজেও তারা অগ্রবর্তী হয়। তারা জেনে বুঝে আদৌ গোনাহ করে না। কখনো অজান্তে কোনো গোনাহর কাজ হয়ে গেলেও সে সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সাথে সাথেই এদের মাথা লজ্জায় নত হয়ে যায়। প্রথম দু’টি দলের তুলনায় উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যে এদের সংখ্যা কম। তাই এদের কথা শেষে বলা হয়েছে। যদিও উত্তরাধিকারের হক আদায়ের ক্ষেত্রে এরাই অগ্রবর্তী।
তিন শ্রেণী লোকের বিধান : আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা অনুযায়ী তিন শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গই তাঁর মনোনীত, উম্মতে মুহাম্মদী এবং আসমানি কিতাবের উত্তরসূরি। হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রথম শ্রেণীর লোক তথা যারা নিজের ওপর জুলুম করে তাদেরকে পরিশেষে ক্ষমা করে দেয়া হবে। যারা মধ্যমপন্থী তাদেরকে সহজ হিসাব নিয়ে ছেড়ে দেয়া হবে। আর যারা নেক আজে অগ্রগ্রামী তাদের হিসাব গ্রহণ করা ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। ইবনে কাসীর বলেন, সৎকর্মে অগ্রগামী সে ব্যক্তি, যে যাবতীয় ফরজ ও ওয়াজিব ও মোস্তাহাব কাজ সম্পাদন করে এবং যাবতীয় হারাম ও মাকরুহ কাজ থেকে বেঁচে থাকে। কোনো কোনো মোবাহবিষয়ও ছেড়ে দেয়। হজরত ইবনে আব্বাস রা:-এর অপর বর্ণনানুযায়ী যারা নিজের আত্মার প্রতি জুলুম করেছে তারা রাসূল সা:-এর সুপারিশে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যারা মধ্যমপন্থা অবলম্বনকারী তারা আল্লাহর রহমতে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যারা নেক কাজে অগ্রবর্তী তারা হিসাব ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করবে।
হজরত আবু সাঈদ খুদরী রা: মহানবী সা: থেকে বর্ণনা করেন, তিনি এ আয়াত প্রসঙ্গে বলেন, আয়াতে বর্ণিত সবাই এক দলভুক্ত এবং সবাই জান্নাতি। তবে জান্নাতের স্তরে তারতম্য হবে। হজরত আবু দারদা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন- যারা নেক কাজে অগ্রগামী তারা হিসাব ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করবেন, আর যারা মধ্যমপন্থী তাদের সহজ হিসাব নেয়া হবে। আর যারা নিজের ওপর জুলুম করেছে তথা পাপী মুমিন তারা হাশরের মাঠের দীর্ঘ সময়ে আটকে যাবে। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা স্বীয় রহমতে তাদের ক্ষমা করে দেবেন। তারা তখন বলবে, আল্লাহর শোকর, যিনি আমাদের দুঃখ মোচন করেছেন। অবশ্যই আমাদের রব ক্ষমাশীল ও গুণের সমাদরকারী, যিনি নিজ অনুগ্রহে আমাদের স্থায়ী আবাসস্থল দিয়েছেন। এখন এখানে আমাদের হয় না কোনো কষ্ট হয় এবং আসে না কোনো ক্লান্তি। (সূরা ফাতির : ৩৪-৩৫)
হজরত আউফ ইবন মালেক রা: রাসূলুল্লাহ সা: থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, আমার উম্মত তিন ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ হিসাব ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করবে। কোনো শাস্তিত্ম তাদের হবে না। আরেক ভাগের সহজ হিসাব হবে। অতঃপর জান্নাতে প্রবেশ করবে। অপর ভাগ আটকে যাবে। ফেরেশতারা তাদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালাকে বলবেন, আমরা তাদের তাওহিদবাদী পেয়েছি। তখন আল্লাহ তায়ালা বলবেন, তারা সত্য বলেছে, আমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তাওহিদের স্বীকৃতির কারণে তাদের জান্নাতে প্রবেশ করাও। আর তাদের পাপসমূহ জাহান্নামিদের প্রদান করো।
মোদ্দা কথা, অধিক মুফাস্সির ও মুহাদ্দিস বলেন, তিন শ্রেণীর মুমিনই জান্নাতে যাবে। কেউ হিসাব ছাড়া, কেউ হিসাবের পর, কেউ আল্লাহর দয়ায়। কারণ, সবাই তাওহিদবাদী। অথচ আমরা সব তাওহিদবাদী এক হতে পারছি না। আমরা সুন্নি, ওহাবি কাওমি, গাইরেকাওমি, মাযহাবি, লা মাযহাবি, কিয়ামি, লা কিয়ামি, দুয়াল্লিন-যুয়াল্লিম, আহলে হাদিস-গাইরে আহলে হাদিস ইত্যাদি নানাভাবে বিভক্ত হয়ে একে অন্যকে খারাপ ও ভ- বলে গালি দিয়ে থাকি। শিরক, বিদআত, নেফাক, কুফরি, কবিরা গুনাহ ইত্যাদিতে জড়িত না হয়ে থাকলে কাউকে খারাপ বলা ঠিক হবে না। অনুরূপভাবে কেউ সহিহ হাদিস অনুযায়ী আমল করলে তাকেও খারাপ বলা যাবে না। অথচ আমরা নিজের মতের সাথে না মিশলে ঢালাওভাবে খারাপ বলে থাকি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন। লেখক : প্রধান ফকিহ্, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদ্রাসা, ফেনী




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com