করোনা এবং করোনাজনিত উপসর্গ নিয়ে রোগীরা ছুটছে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই সরজমিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও করোনা ওয়ার্ডে দেখা গেছে রোগীদের উপচে পড়া ভিড়। অনেকেই রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে সিট খালি না পেয়ে ভিড় করছেন ঢাকা মেডিকেলে। কিন্তু এখানেও সিট খালি নেই। স্বজনরা এমন রোগীদের নিয়ে চিকিৎসকদের পিছনে হন্যে হয়ে ছুটছেন।
সংকটাপন্ন কভিড রোগীদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা। সারাদেশে মাত্র এক হাজার রাজধানীতে সরকারি সুবিধায় ১৫৭টি। এ দিকে কভিড-১৯ সংক্রমণ পরিস্থিতির ক্রমাবনতি অব্যাহত রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তির তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৫ হাজার ৩৫৮ জনের শরীরে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এ সময় ৫২ জন কভিড-১৯ পজিটিভ রোগী মারা গেছেন, যা সাত মাসে সর্বোচ্চ। এ পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ১১ হাজার ২৯৫ এবং মারা গেছেন ৯ হাজার ৪৬ জন। করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা নিয়ে আজ দুপুরে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
সংকটাপন্ন করোনা রোগীর প্রাণ রক্ষায় অপরিহার্য একটি মেডিকেল ডিভাইস হলো হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা (এইচএফএনসি)। গত বছর মহামারীর সূচনালগ্নেই আলোচনায় আসে ডিভাইসটি। সরকারি হাসপাতালগুলোয় ডিভাইসটির সংকট সে সময় মারাত্মক আশঙ্কার কারণ হয়ে দেখা দেয়। মাঝে কয়েকটি হাসপাতালে কিছু এইচএফএনসি স্থাপন করা হলেও তা ছিল অপ্রতুল। বর্তমানে হাসপাতালগুলোয় বিদ্যমান ডিভাইসগুলোর মধ্যে কিছু কিছু অকেজো হয়ে পড়ারও খবর পাওয়া গেছে। ফলে সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতিতে ডিভাইসটি নিয়ে পুরনো সে শঙ্কা আবার ফিরে এসেছে। বিশেষ করে রাজধানীর বাইরের হাসপাতালগুলোয় এ নিয়ে শঙ্কা সবচেয়ে বেশি। আইসিইউসহ প্রয়োজনীয় নানা সুবিধার অপর্যাপ্ততায় হাসপাতালগুলো বেশ নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। এইচএফএনসির সরবরাহ বাড়ানো গেলে এ পরিস্থিতি অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা যেত বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
দেশে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবার বাড়ছে। গতকালই দেশে ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড সংখ্যক সংক্রমণ শনাক্তের কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মৃতের সংখ্যাও এরই মধ্যে ৯ হাজার ছাড়িয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, চলতি মাসে সংক্রমণ পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে। এরই মধ্যে হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ শয্যাসহ সংকটাপন্ন রোগীদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের মারাত্মক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার সংখ্যা বাড়ানো গেলে এ সমস্যা অনেকাংশেই কাটিয়ে ওঠা যাবে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে এইচএফএনসির সংখ্যা হাজারেরও কম। সারা দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে এইচএফএনসি রয়েছে মোটে ৯৮০টি। এর মধ্যে শুধু সরকারি (কভিড ও নন-কভিড) হাসপাতালগুলোয় ডিভাইসটি রয়েছে ৭২৭টি। গত বছরের মাঝামাঝি বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে নতুন করে এইচএফএনসি সরবরাহ করা হয়। তবে বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে মেডিকেল ডিভাইসটি নষ্টের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
দেশে করোনা পরিস্থিতি সবচেয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে রাজধানীতে। এখানে সরকারিভাবে করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতাল রয়েছে আটটি। এসব হাসপাতালে এইচএফএনসি রয়েছে মোটে ১৫৭টি। এর মধ্যে আবার ২২টিই নষ্ট। সংকটাপন্ন করোনা রোগীদের চিকিৎসা অব্যাহত রাখতে আরো অন্তত ১২২টি এইচএফএনসি প্রয়োজন বলে মনে করছে হাসপাতালগুলো।
হাসপাতালগুলোর চাহিদাপত্রের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক এইচএফএনসি রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেÍ৪৮টি। এর মধ্যে ১৬টি নষ্ট। আরো ২০টি এইচএফএনসি স্থাপনের চাহিদা রয়েছে হাসপাতালটির। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে ৩০টি। এর মধ্যে নষ্ট ছয়টি। এ হাসপাতালে আরো ২৫টি এইচএফএনসি স্থাপন করা প্রয়োজন। এছাড়া কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে বিদ্যমান ৩৯টির সঙ্গে আরো ছয়টি স্থাপনের চাহিদা দেয়া হয়েছে। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে এ ডিভাইস রয়েছে ২০টি। হাসপাতালটি এ সংখ্যা দ্বিগুণ করতে চাইছে। শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এইচএফএনসির সংখ্যা বিদ্যমান ছয়টি থেকে বাড়িয়ে ২১টি করার কথা বলা হয়েছে। সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে চারটি এইচএফএনসি রয়েছে। এ ডিভাইস আরো ছয়টি স্থাপন করতে চায় হাসপাতালটি। এছাড়া স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে কোনো এইচএফএনসি নেই। এখানে জরুরি ভিত্তিতে আরো ১০টি স্থাপন করা প্রয়োজন বলে মনে করছে হাসপাতালটি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা আক্রান্ত রোগীর মারাত্মক শ্বাসকষ্টের ক্ষেত্রে অনেক সময়েই আইসিইউ সুবিধা পাওয়া যায় না। অভাব থাকে ভেন্টিলেটরেরও। এ ধরনের সংকটে কার্যকর একটি সমাধান হলো এইচএফএনসি। এর মাধ্যমে রোগীর দেহে নিরবচ্ছিন্নভাবে উচ্চচাপে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়। প্রাথমিকভাবে এটিকে ভেন্টিলেটরের বিকল্প হিসেবে দেখা হয়।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরামর্শক ও সাবেক প্রধান বিজ্ঞানী ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘সংকটাপন্ন রোগীদের জন্য সহজ সমাধান হলো হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা। শ্বাসকষ্টের রোগীকে আইসিইউতে না নিয়েও এ যন্ত্রের সাহায্যে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচানো যায়।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এইচএফএনসির জন্য আলাদা কোনো অবকাঠামোর প্রয়োজন নেই। যেসব হাসপাতালে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের সুযোগ রয়েছে, সেখানেই এর সংযোগ দেয়া যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি হাসপাতালগুলোয় দ্রুততম সময়ের মধ্যে ডিভাইসটি স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য।
এইচএনএফসির সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ানো কঠিন নয় বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. বে-নজির আহমেদ। তিনি বলেন, এপ্রিলে দেশে সংকটাপন্ন রোগীর সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। বর্তমানে যে সংখ্যক হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে, তাতে চিকিৎসা অব্যাহত রাখা যাবে না। সংকট থাকলেও তা বাড়ানো সরকারের পক্ষে কঠিন নয়। সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন থাকলে ক্যানুলার সংযোগ দেয়া যায়। স্থাপনের জন্য ভিন্ন কোনো অবকাঠামোর দরকার নেই। ক্যানুলা দিলে আইসিইউর ওপর চাপ কমবে। একই সঙ্গে অন্যান্য যন্ত্রাংশও বাড়াতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও জানিয়েছে, সরকারি হাসপাতালগুলোয় নতুন করে এইচএফএনসি সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে নতুন করে ৩০০টির বেশি এইচএফএনসি বিতরণ করা হবে। তবে এখনই রাজধানীর বাইরে ডিভাইসটি সরবরাহ করা হবে না। অন্যদিকে রাজধানীর কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোকেও চাহিদা অনুযায়ী ক্যানুলা দেয়া হবে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অনুমোদনের পর কেন্দ্রীয় ঔষধাগার চাহিদা অনুযায়ী হাসপাতালগুলোকে এসব ডিভাইস পৌঁছে দেবে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. ফরিদ হোসেন মিয়া বলেন, প্রয়োজনীয় ডিভাইসের মজুদ রয়েছে। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ক্যানুলা (এইচএফএনসি) বাড়ানো হচ্ছে। তাদের চাহিদা অনুযায়ী এসব ডিভাইস সরবরাহ করা হবে।