রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৯ অপরাহ্ন

করোনা মহামারী মুক্ত হোক নতুন বছর 

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২১

ভিন্নরূপে এবার এলো নববর্ষ ১৪২৮

শুভ নববর্ষ ১৪২৮। বাঙালি আজ এমন এক পরিবেশে, এমন এক বাস্তবতায় বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে নেবে, যা আগে কখনও আসেনি আমাদের জীবনে। এবার নববর্ষ এসেছে এমন এক সময়ে যখন বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানুষ মহামারী হিসেবে দেখা দেয়া করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তারে আতঙ্কিত। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, ঘরের বাইরে বের হওয়ার পথ হয়ে গেছে রুদ্ধ। কারণ তা ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে নববর্ষ এবার পালিত হবে ভিন্ন এক পরিবেশে, ঘরের ভেতরে। অথচ আমরা জানি, বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটি উপলক্ষে দেশজুড়ে চলে নানা উৎসব-আয়োজন। পহেলা বৈশাখ ভোরবেলায় রাজধানীর রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠান আমাদের বর্ষবরণ উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নববর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে বসে বৈশাখী মেলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে বের করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। চলে আরও নানা আয়োজন। এসবের মাঝে বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার প্রয়াস থাকে। কিন্তু এবার এসবের কিছুই হচ্ছে না।
বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের জনক নিয়েও রয়েছে বিতর্ক ও বিভ্রান্তি। সেসব অহেতুক প্রশ্নবাণে জর্জরিত না করে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন ও বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার দৃষ্টিপটে মহামতি আকবরই বাংলা সনের প্রবর্তক। বাংলা সন বাংলাদেশের নিজস্ব সন। বাংলা নববর্ষ এলে পহেলা বৈশাখে বাঙালিরা আনন্দঘন উল্লাসে বিমোহিত হয়ে পড়ে। সারা বছরই যেন ধরে রাখার মধ্যে আমাদের বাঙালির স্বকীয়তার তাৎপর্য নিহিত রয়ে যায়। বঙ্গাব্দ, বাংলা সন বাংলা বর্ষপঞ্জী হলো বঙ্গদেশের একটি ঐতিহ্যমন্ডিত সৌর পঞ্জিকাভিত্তিক বর্ষপঞ্জী। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সৌদ দিনের গণনা শুরু। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে মোট ৩৬৫ দিন কয়েক ঘণ্টা লাগে।
এই সময়টাই সৌর বছর। গ্রেগরীয় সনের মতো বঙ্গাব্দেও মোট ১২ মাস। বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র। আকাশের রাশিমন্ডলীতে সূর্যের অবস্থানের ভিত্তিতে বঙ্গাব্দের মাসের হিসাব হয়। যেমন যে সময় সূর্য মেষ রাশিতে থাকে সে মাসের নাম বৈশাখ।
বাংলাদেশ ছাড়াও পূর্ব ভারতের পশ্চিম বঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় এই বর্ষপঞ্জী ব্যবহৃত হয়। বঙ্গাব্দ শুরু হয় পহেলা বৈশাখ দিয়ে। বঙ্গাব্দ সব সময়েই গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর অপেক্ষা ৫৯৩ বছর কম। সংশোধিত বাংলা পঞ্জিকা বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয় ১৯৮৭ সালে। সেই অনুযায়ী আজকের তারিখ ৩০ চৈত্র ১৪২৮ বঙ্গাব্দ।
বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৬ সনে বাংলা পঞ্জিকার প্রশ্নে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নেতৃত্বাধীন কমিটির রেখে যাওয়া সুপারিশ গ্রহণ করেছে। তবে ১৪ এপ্রিল বছর শুরুর দিন হিসাবে ধার্য করা হয়েছে। খ্রিষ্টীয় পঞ্জিকার অধিবর্ষের বছরে চৈত্র মাসে একদিন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ভারত সাম্রাজ্যের সম্রাট আকবরের আদেশে ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তারই বিজ্ঞ রাজ জ্যোতিষী আমির ফতেহ উল্লাহ শিরাজীর গবেষণার ঐতিহাসিক ফসল বাংলা সনের উৎপত্তি ঘটে। ব্রিটিশ রাজত্বের আগে এ দেশেও হিজরী সনই প্রচলিত ছিলো। সামাজিক ক্ষেত্র বিশেষ করে মওসুমের প্রতি দৃষ্টিপাত করেই রাজস্ব বা খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে হিজরী সনের পরিবর্তে ঋতুভিত্তিক সৌরসনের প্রয়োজনবোধ করে বাংলা সন বঙ্গাব্দের উদ্ভব ঘটানো হয়।
মানুষ কাল বা সময় বিভাজনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে আসছিলো, সভ্যতার বিকাশের আদি যুগ থেকেই। প্রয়োজনের তাগিদে বছর, মাস, সপ্তাহ দিন ইত্যাদি গণনার প্রচলন করে। বাংলায় শকাব্দ, লক্ষনাব্দ, পালাব্দ, চৈতন্যাব্দ ইত্যাদি সনের প্রচলন ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায় বাংলা বা বঙ্গাব্দের প্রচলন শুরু হলে। এই সন প্রচলনের ইতিহাসে সংযোগ ঘটেছে বাঙালি জাতির একান্ত নিজস্ব অব্দ। ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনভুক্ত হয়। ১২০১ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ জয়ের পর মুসলমান শাসনামলে তৎকালীন প্রচলিত শকাব্দ ও লক্ষনাব্দ সনের পাশাপাশি শাসনতান্ত্রিক কর্মকা-ে হিজরী সনের প্রচলন শুরু হয়। সন শব্দটি আরবি শব্দ হতে উদ্ভূত, অর্থ বর্ষ। আর সাল কথাটা ফার্সি শব্দ হতে।
বাংলা সনের জনক নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। ভারত সম্রাট আকবরের পাশাপাশি রাজা শশাঙ্ক, সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এর নামও কোনো কোনো লেখক উল্লেখ করেছেন তাদের মনগড়া যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে। যদিও ঐতিহাসিকদের যুক্তিবলে প্রমাণিত যে, মহামতি আকবরই বাংলা সন প্রবর্তনকারী। এদেশে সবাই হিজরি সনই ব্যবহার করতো। ফলে ফসল কাটার খুব অসুবিধার সম্মুখীন হতে হতো, কারণ আগের বছর যে তারিখে ফসল কাটতো, পরের বছর সে তারিখ ১১ দিন এগিয়ে যেতো। আকবর যে হিজরি সন ছিল তখন থেকেই এক সৌরসংবত প্রবর্তন করেন। এটিই হচ্ছে বঙ্গাব্দ। সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের বছর ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ (হিজরি ৯৬৩) এবং ৯৬৩ বঙ্গাব্দ।
এই থেকে ঐতিহাসিকরা একমত হন যে, হিজরি থেকেই বঙ্গাব্দ চালু করা হয়। ৫২২ খ্রিষ্টাব্দে অর্থাৎ হিজরি সনের শুরু হযরত মোহাম্মদ নবী করিম (স.) এর সময় হতে হিজরতের স্মৃতি রক্ষার্থে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা.) খিলাফতকালে হিজরি সনের সৃষ্টি। এই সনের শুরু ১৬ জুলাই ৬২২অব্দ ধরা হলেও আসলে হিজরতের তারিখ রবিউল আওয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার। ২০ সেপ্টেম্বর ৬২২ অব্দ ধরা হলে আরব দেশের নিয়মানুযায়ী বছরের প্রথম মাস পহেলা মহরমের তারিখ হতে বছর ধরা হয়েছে। হিজরি সন ছিল চন্দ্রমাস। ঔই মাসই হিজরি সন ও তারিখের হেরফের হতো, অর্থাৎ সৌর বছরের হিসাবের দিন তারিখ মাসের গরমিল হতো প্রচুর। সে কারণেই ৯৬৩ হিজরি = ৯৬৩ বাংলা সন সমন্বয় করে গণনা শুরু করা হয়। এভাবে ৯৬০= হিজরি = ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ এর ১১ এপ্রিল, সম্রাট মহামতি আকবরের সিংহাসন আরোহণের ও পহেলা বৈশাখ, ৯৬০ বাংলা সন। এসব একদিকে নবী করিম (স.) এর হিজরতের (৬২২ খ্রিষ্টাব্দ), বাংলা সনের শুরু ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে। এবং আকবর সিংহাসন বসার (১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ) স্মৃতিবহ এবং ইংরেজি সন থেকে ৫৯৩ বছর ৩ মাস ১১ দিন কম। বাংলা সনের সঙ্গে ৫৯৩ যোগ দিলেই ইংরেজি সন মিলতে পারে। আকবর অবশ্য তার রাজত্বের ২৯তম বর্ষে ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে এই বাংলা সন চালু করেন। আকবর সিংহাসনে বসেন ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ এপ্রিল। যদিও তার সিংহাসনে বসার প্রকৃত দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি।
বাংলায় আদি হতে ঋতু বৈচিত্র্য অনুসারে বাংলা সন চালু করা হয়। রাজার অভিষেক শুরু রাজ্যাভিষেকের বছর ধরে যে সব পঞ্জিকার বছর গণনা শুরু করা হয়, সে সকল বছরের যে দিনেই রাজার অভিষেক হোক না কেন, ঐতিহ্যের খাতিরে বছর শুরুর দিন অপরিবর্তিত রাখা হয়। ঋতু বৈচিত্র্যের ভিত্তিতে সৃষ্ট বাংলা পঞ্জিকা বাঙালির জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বাংলা সনের প্রবর্তন হয়েছিল খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে। নববর্ষে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে দোকানে দোকানে হালখাতা খোলার রীতি আজও প্রচলিত। বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক ধরনের প্রাণসঞ্চার হয় প্রতি বছর। হস্তশিল্পের প্রসারে এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ক্ষুদ্র ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে এ শিল্প। এসব কর্মকা- আমাদের অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে যুক্ত করছে নতুন মাত্রা। তাই ব্যবসায়ীরা এ দিনটির অপেক্ষায় থাকেন। দুঃখজনক, এবার এসবের কিছুই হবে না বিদ্যমান বাস্তবতায়।
বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বিপুল লোকের সমাগম আমাদের অতি পরিচিত দৃশ্য। ঘরের বাইরে না বেরিয়ে নববর্ষ উদযাপন, বাঙালি জীবনে এ যেন কল্পনাই করা যায় না। কিন্তু এবার বাস্তবতাই মানুষকে ঘরে থাকতে বাধ্য করছে। তবে মানুষ ঘরে থাকলেও তাদের অন্তরে থাকবে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার তাগিদ। অনেকে ঘরে বসেই বাঙালি সংস্কৃতিচর্চায় আত্মনিয়োগ করবেন নিশ্চয়ই। বস্তুত আমরা তেমনটিই আশা করি। সবার ঘরে ঘরে উদযাপিত হোক নববর্ষ।
বাংলা নববর্ষ একান্তই আমাদের জাতিসত্তার অংশ। বাঙালির জীবনে বছরে একবারই আসে এমন দিন। আমাদের বর্ষবরণের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, এটি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার উৎসব। তবে বর্তমানে এ উৎসব হয়ে উঠেছে কিছুটা শহরকেন্দ্রিক। অথচ গ্রামই এ দেশের প্রাণ। গ্রামের মানুষ, মূলত কৃষকরাই বাংলা দিনপঞ্জি অনুসরণ করে থাকেন। বাংলা ঋতুচক্র মেনে করেন চাষাবাদ। পহেলা বৈশাখের একটি অসাম্প্রদায়িক চরিত্র থাকায় এ দিনটির একটি প্রতীকী তাৎপর্যও রয়েছে। আমরা জানি, প্রতিক্রিয়াশীলরা গণতন্ত্র, প্রগতি, বাঙালি সংস্কৃতি- এসবকিছুরই বিরুদ্ধে। দুই দশক আগে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার কথা আমরা ভুলে যাইনি। ওই ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন অন্তত নয়জন। আহত হয়েছিলেন অনেকে। নববর্ষ উদযাপনের মূল চেতনা এ ধরনের হামলাকারীসহ সব অপশক্তির বিরুদ্ধে। আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে জোরদার করে, প্রগতির পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে, বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চরিত্র আরও বিকশিত করেই অপশক্তিকে রুখতে হবে।
বাংলা নববর্ষের হাত ধরে প্রায় একই সময়ে উদযাপিত হয় ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীর বৈসাবি, বিজু ইত্যাদি উৎসব। চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখের নানা আয়োজন চলে বিভিন্ন পাহাড়ি গোষ্ঠীর মধ্যে। উপমহাদেশের অন্যান্য জাতির নববর্ষও আসে প্রায় একই সময়ে। তবে এবার সর্বত্রই প্রায় অভিন্ন পরিস্থিতি থাকায় সব উৎসবই উদযাপিত হবে সীমিত পরিসরে। এর মধ্যেও আমরা নতুন বছরকে বরণ করে নেব। আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির ধারাকে ঋদ্ধ ও বেগবান করার শপথ নেব। সব রোগ-শোক-জরা-গ্লানি ঝেড়ে ফেলে নতুন বছর দেশবাসীর জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধির বার্তা বয়ে আনবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। শুভ নববর্ষ।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com